ডিজিটাল ইন্ডিয়া (Digital India Vision) দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্লকচেইন (Blockchain) প্রযুক্তিতে (Technology) শক্তিশালী প্রশাসন গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে সেপ্টেম্বরে ন্যাশনাল ব্লকচেইন ফ্রেমওয়ার্কের জন্য ৬৪.৭৬ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। ন্যাশনাল ব্লকচেইন (Blockchain) ফ্রেমওয়ার্ক-এর মূল উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে নির্ভরযোগ্য ব্লকচেইন স্তর, এনবিএফ লাইট, প্রামাণ্য জাতীয় ব্লকচেইন পোর্টাল। ভুবনেশ্বর, পুনে, হায়দয়াবাদে ব্লকচেইন প্রযুক্তি স্তর তথ্য কেন্দ্রগুলিতে স্থাপিত হয়েছে। এ বছর ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪ কোটি তথ্য ব্লকচেইন প্ল্যাটফর্মে (Platform) যাচাই করা হয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রেক্ষিতে প্রযুক্তির মাধ্যমে যেগুলি গণনামূলক ক্ষমতা থেকে শক্তি পায়, ব্লকচেইনের মান নির্ভর করে মধ্যস্থতাকারীদের ছাড়া যাচাইযোগ্য বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার উপর।

ব্লকচেইন কী?
ব্লকচেইন একটি স্বচ্ছ, নিরাপদ ও অপরিবর্তনীয় তথ্যভান্ডার- যা লেনদেনের রেকর্ডের মতো কাজ করে। অস্থায়ী প্রতিরোধী এবং কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য। ব্লকচেইন প্রযুক্তি এই সমস্যা সমাধান করে বিকৃত-প্রতিরোধী, বিতরণকৃত লেজার ব্যবস্থার মাধ্যমে, যেখানে রেকর্ডগুলি একাধিক কেন্দ্রের মধ্যে নিরাপদভাবে সংরক্ষিত হয়। এই নকশা অনুমোদনবিহীন পরিবর্তনকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে, ডেটার অখণ্ডতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।

ভারতের বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রায়ই কেন্দ্রীভূত ডেটাবেসের উপর নির্ভরশীল, যা ত্রুটি, জালিয়াতি ও স্বচ্ছতার অভাবে দুর্বল হতে পারে। প্রশাসনের কার্যকারিতা উন্নত করতে, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল ব্লকচেইন ফ্রেমওয়ার্ক (Frame Work) তৈরি করেছে। এর লক্ষ্য হল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তির প্রয়োগের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো প্রদান করে জনসেবায় স্বচ্ছতা, ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা।

চার ধরনের ব্লকচেইন রয়েছে।
সর্বজনীন ব্লকচেইন: এই নেটওয়ার্কে সকল অংশগ্রহণকারী রেকর্ড যাচাই এবং নতুন ব্লক যোগ করতে পারে।
বেসরকারি ব্লকচেইন: এটি একটি অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্লকচেইন, যা নির্বাচিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা নিরাপত্তা এবং অ্যাক্সেস নির্ধারণ করে। এটি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং ডেটা গোপনীয়তা নিশ্চিত করে।
সমষ্টি ব্লকচেইন: এই নেটওয়ার্ক আংশিকভাবে বিকেন্দ্রীভূত, একাধিক সংস্থা যৌথভাবে তথ্য যাচাই ও পরিচালনা করে।
হাইব্রিড ব্লকচেইন: এটি সর্বজনীন এবং বেসরকারি ব্লকচেইনের সংমিশ্রণ, যা নির্বাচিত ডেটার অ্যাক্সেস দেয়।

ব্লকচেইনের মূল শক্তি হল স্বচ্ছতা, অপরিবর্তনীয়তা, বিকেন্দ্রীকরণ এবং আস্থা। এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিরাপদ ও কার্যকর ডিজিটাল ব্যবস্থা গঠনে সহায়ক- যা প্রশাসন রূপান্তর, নাগরিক সেবা উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক জট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ।

৬৪.৭৬ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ নিয়ে মার্চ ২০২১-এ ন্যাশনাল ব্লকচেইন ফ্রেমওয়ার্ক, যার সূচনা হয়েছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের মাধ্যমে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে পৌঁছয়। এনবিএফ-এর লক্ষ্য হল, অনুমোদিত ব্লকচেইন-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনগুলির উন্নয়ন ও বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করা, যা ভারতের জন্য একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং সম্প্রসারণযোগ্য ডিজিটাল কাঠামো গড়ে তোলার পথে এক কৌশলগত পদক্ষেপ।

ডিজিটাল দুনিয়ায় মোবাইল অ্যাপের প্রতারণা ও ভুল তথ্য থেকে রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ব্লকচেইনের মাধ্যমে অ্যাপের সত্যতা যাচাই করা, ব্যবহারকারীর তথ্য নিরাপদ রাখা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব। যখন ব্যবহারকারীরা কোনও অ্যাপ স্ক্যান করেন বা পরীক্ষা করেন, প্রামাণিক ব্লকচেইন রেকর্ডের সঙ্গে সেই অ্যাপের তথ্য মিলিয়ে তার বৈধতা যাচাই করে। এর ফলে মোবাইল ইকোসিস্টেমে আস্থা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।

টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ট্রাই) ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার টেকনোলজি (ডিএলটি) টেলিকম ব্যবস্থায় একত্রিত করেছে। এর মাধ্যমে সব প্রিন্সিপল এন্টিটি (PE) ও টেলিমার্কেটার (TM)-দের বার্তা প্রেরণের শৃঙ্খল নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে এসএমএস প্রেরণ থেকে সরবরাহ পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ট্র্যাক করা যায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পরিষেবা প্রদানকারীদের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত এই উদ্যোগটি ভোক্তা সুরক্ষা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে, স্প্যাম বার্তা হ্রাস করেছে এবং বিধিনিষেধ কার্যকরভাবে প্রয়োগে ও ডিজিটাল আস্থার ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তির কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। এই বৃহৎ পরিসরের বাস্তবায়ন, যা ১.১৩ লক্ষেরও বেশি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই), সেবি, ন্যাশনাল এনআইসি এবং সি-ড্যাক-এর সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়েছে।
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের জন্য একাধিক পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মধ্যে অন্যতম হল ডিজিটাল রুপি (e₹)। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি সীমিত গ্রাহক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হওয়া এই খুচরা পাইলট প্রকল্পটি প্রদর্শন করে কীভাবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি তাৎক্ষণিক, অনুসরণযোগ্য ও স্বচ্ছ লেনদেনকে সম্ভব করে তোলে। পাশাপাশি, এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও পেমেন্ট সিস্টেমে উদ্ভাবনকেও উৎসাহিত করছে।
ডিজিটাল ইন্ডিয়া ও আত্মনির্ভর ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল প্রশাসনে আস্থা ও স্বচ্ছতার ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ন্যাশনাল ব্লকচেইন ফ্রেমওয়ার্ক (NBF) উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত একটি সংহত ও পারস্পরিক কার্যক্ষম ব্লকচেইন ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে, যা সরকার-নাগরিক (G2C) ও সরকার-ব্যবসা (G2B) পরিষেবাকে সহায়তা করে এবং প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা ও উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করছে। নীরবচ্ছিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন ও দেশীয় ব্লকচেইন সমাধান বিকাশের মাধ্যমে ভারত ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির জন্য ব্লকচেইন ব্যবহারে বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথে রয়েছে।


