কেন্দ্রীয় সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। চারটি শ্রমবিধি (Labour Laws) রূপায়ণ ঘোষণা। বিধিগুলি হল মজুরি বিধি ২০১৯, শিল্প সম্পর্ক বিধি ২০২০, সামাজিক নিরাপত্তা বিধি ২০২০ এবং পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের শর্ত বিধি ২০২০। ২১ নভেম্বর থেকেই এগুলি কার্যকরী হল। ২৯টি শ্রমবিধির জায়গায় নতুন এই চারটি বিধি আনা হয়েছে।

ভারতের শ্রম আইনগুলি (Labour Laws) বেশিরভাগই স্বাধীনতার আগের বা স্বাধীনোত্তর প্রাথমিক অবস্থা (১৯৩০ থেকে ১৯৫০) এই সময়কালে তৈরি হয়েছিল। সেই সময় বিশ্ব পরিস্থিতি এবং অর্থনীতির পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। বেশিরভাগ প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন দেশ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাদের শ্রমবিধির সংস্কার এবং আধুনিকীকরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু ভারতে সেকেলে ২৯টি কেন্দ্রীয় শ্রমবিধি চালু ছিল। এই নিয়ন্ত্রণমূলক পরিকাঠামো পরিবর্তিত অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে, এক ধরণের অনিশ্চয়তা এবং শিল্প ও শ্রমিক উভয় ক্ষেত্রেই উত্তরোত্তর বাধ্যবাধকতার বোঝা সৃষ্টি করে। বহু কাঙ্খিত প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে চারটি শ্রমবিধির রূপায়ণ শুধুযে ঔপনিবেশিক সময়কালের কাঠামোর চৌহদ্দিকে ডিঙিয়ে যেতে পারবে তা নয়, আধুনিক বিশ্ব চলতি ধারার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হবে। এই চারটি ধারা একত্রে কর্মী এবং উদ্যোগ ক্ষেত্রগুলির ক্ষমতায়ণ ঘটিয়ে এমন এক শ্রমশক্তি গড়ে তুলবে, যাকে ঘিরে নিরাপত্তার বাতাবরণ থাকবে এবং তা উৎপাদনমুখী হয়ে উঠবে। সেইসঙ্গে পরিবর্তিত বিশ্ব কর্মধারার সঙ্গেও তা সঙ্গতিপূর্ণ হবে। ফলে তা আরও স্থিতিস্থাপক, প্রতিযোগিতামুখী এবং আত্মনির্ভর রাষ্ট্রের পথ গড়ে দেবে।

নির্দিষ্ট মেয়াদি কর্মচারীরা স্থায়ী কর্মীদের অনুরূপ ছুটি, চিকিৎসা এবং সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ পাবেন। ৫ বছরের পরিবর্তে ১ বছর সম্পূর্ণ হলেই গ্র্যাচুইটির আওতাভুক্ত হবেন তাঁরা। স্থায়ী কর্মীর অনুরূপ বেতন, বেতন হার বৃদ্ধি এবং সুরক্ষার সুযোগ পাবেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে হাজারো বাধ্যবাধকতা জটিলতা কমবে।

গিগ, প্ল্যাটফর্ম কর্মী এবং সমষ্টিকারীরা এই প্রথম সুনির্দিষ্ট সুবিধার আওতাধীন হলেন। আধার ভিত্তিক ইউনিভার্সাল অ্যাকাউন্ট নম্বর সমস্ত দেশজুড়ে কেউ এক স্থান থেকে অনত্র গেলেও কল্যাণকর সুবিধার যাবতীয় সুযোগ অনায়াসে পেতে পারবেন।

নির্দিষ্ট মেয়াদী চুক্তিভিত্তিক কর্মীর ফলে কর্মী নিয়োগের সুযোগ বাড়বে। সামাজিক সুরক্ষা এবং আইনি সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্থায়ী কর্মীদের অনুরূপ সুযোগ তাঁরা পাবেন। ১ বছরের বেশি কাজ হয়ে গেলেই স্থায়ী কর্মীর মতো গ্র্যাচুইটির সুযোগ পাবেন তাঁরা। এছাড়াও স্বাস্থ্য, সুবিধা এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষাও মূল নিয়োগকারীকে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিতে হবে।

লিঙ্গ বৈষম্য আইনিভাবে নিষিদ্ধ। সম কাজের জন্য সম বেতন নিশ্চিত করতে হবে। রাতের শিফ্টে এবং অন্য যে কোনও কাজেই তাঁদের নিয়োগে কোনও বাধা নেই। এমনকী ভূগর্ভস্থ খনিতে বা ভারী শিল্পে তাঁদের সম্মতি সাপেক্ষে এবং বিধিবদ্ধ সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় নিয়োগ করা যাবে।

ন্যূনতম মজুরি সমস্ত কর্মীদের ক্ষেত্রেই সুনিশ্চিত করা হবে। কর্মীরা নিয়োগপত্র পাবেন। কর্মক্ষেত্রে মালিক দ্বারা কর্মী শোষন নিষিদ্ধ। অবসরকালীন বেতন প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সমস্ত এমএসএমই কর্মীরাই সামাজিক সুরক্ষা বিধি ২০২০-র আওতাধীন হবেন। তাঁদের ন্যূনতম বেতন সুনিশ্চিত করা হবে। সুনির্দিষ্ট সময়ের কাজের বাইরে বাড়িতে কাজ করতে হলে ওভার টাইম মজুরি দিতে হবে। তাদের সময়মতো বেতন প্রদান সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

সমস্ত কর্মীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত। প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজের সময় বেধে দেওয়া। সপ্তাহ ভিত্তিতে ৪৮ ঘন্টা কাজের সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। বছরে ৩০ দিন কাজ করলে কর্মীরা বোনাসের আওতায় আসবেন।

বৃক্ষরোপণ কর্মীদের ওএসএইচডব্লিসি বিধির আওতাধীন আনা হয়েছে এবং সামাজিক সুরক্ষা বিধি সুনিশ্চিত করা হয়েছে। ১০জনের বেশি কর্মী ৫ অথবা তার বেশি হেক্টর জমিতে কাজে শ্রম আইন বিধি কার্যকর হবে। সুরক্ষা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ডিজিটাল এবং অডিও ভিস্যুয়াল কর্মী, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে সাংবাদিক, ডাবিং শিল্পী, স্টান্ট কর্মীরাও পূর্ণ সুবিধা পাবেন। সকল কর্মীকেই নিয়োগপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সময়মতো মজুরি প্রদান সুনিশ্চিত। সুনির্দিষ্ট কাজের সময়সীমার বাইরে কাজের ক্ষেত্রে ডাবল মজুরি প্রদানের সংস্থান।
খনি কর্মীদের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা বিধি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্বাস্থ্য এবং পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে। সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা হবে। নিখরচায় বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ থাকবে। দিনে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজের সময়সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সপ্তাহে ৫৮ ঘণ্টা কাজের সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পের কর্মীদের নিখরচার বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হবে। মহিলারাও এই জাতীয় ক্ষেত্রে কাজ করতে পারবেন। বাধ্যতামূলকভাবে সুরক্ষা কর্মীকে সমস্ত জায়গায় কাজের নজরদারি করতে হবে।
সমস্ত বস্ত্র কর্মীরাই (সরাসরি চুক্তি ভিত্তিক এবং স্বেচ্ছা পরিযায়ী) সম বেতন এবং সম কল্যাণকর সুবিধা পাবেন। ওভার টাইমের জন্য দ্বিগুণ বেতনের সংস্থান রয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মীদের প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন দেওয়া হবে। সম কাজের সম বেতন বাধ্যতামূলক। মহিলাদের কাজের সুযোগ বাড়বে। রাতের শিফ্টেও মহিলাদের কাজের সুযোগ এবং উচ্চ বেতনের কাজের সুযোগও পাবেন তাঁরা। কোনোরকম অভিযোগ দেখা দিলে সময়মতো তা নিষ্পত্তি করতে হবে। তাঁদের বিধিবদ্ধ নিয়োগপত্র এবং সামাজিক সুরক্ষা বিধিকে সুনিশ্চিত করা হবে।
সমস্ত ডক কর্মীরাই প্রথাগত পরিচিত এবং আইনি সুরক্ষা পাবেন। সমস্ত সামাজিক সুযোগের ক্ষত্রে তাঁদের জন্য সুনিশ্চিত থাকবে। বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, পেনশন এবং বিমার সুবিধা অন্যদের মতোই চু্কি ভিত্তিক এবং অস্থায়ী কর্মীরাও পাবেন। বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
রফতানি ক্ষেত্রের কর্মীরা গ্র্যাচুইটি, প্রফিডেন্ট ফান্ড এবং অন্য সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাবেন। বছরে ১৮০ দিন কাজের পর বার্ষিক ছুটির সুবিধা থাকবে সকলের জন্য। সময়মতো বেতন এবং বেতনের ক্ষেত্রে কোনও ঊর্ধসীমা থাকবে না। মহিলারা রাতের শিফ্টে সম্মতি সাপেক্ষে কাজ করতে পারবেন। উচ্চ আয়ের সুযোগ থাকবে তাঁদের। সকলের জন্য সুরক্ষা এবং অন্য কল্যাণকর সুযোগ সুনিশ্চিত করা হবে। নিরাপদ যাতায়াত, ওভার টাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি, সিসিটিভ নজরদারি এবং অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থাও থাকবে।


