ওঁরা থাকেন ওধারে

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। আপামর বাঙালি একে কেন্দ্র করে মেতে ওঠেন। কিন্তু সত্যিই কি সবাই শামিল হতে পারেন এই প্রাণের উৎসবে? পুজোকে কেন্দ্র করে চারদিকে যখন আলোর রোশনাই, তখন তাঁরা থাকেন একটু আঁধারে। যেমন বীরভূমের নিষিদ্ধ পল্লির বাসিন্দারা।

তাদের কাছে দুর্গাপূজা মানে আলোর রোশনাই, খাওয়া-দাওয়া, নতুন জামা, ঠাকুর দেখা নয়, তাঁদের কাছে এই ক’টা দিন একটু বাড়তি রোজগারের। সারা বছর যা রোজগার হয়, তার থেকে দুর্গাপুজোর সময় বেশি হয়। যেখানে এই উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বঙ্গবাসী, তখন তাঁরা বেশি খদ্দেরের আশায় বসে থাকেন। কারণ, তাদের রোজগারে সংসারের উনুনে ভাতের হাঁড়ি চড়ে। তাই ইচ্ছা থাকলেও এই আনন্দ উৎসবের শরিক হওয়ার সুযোগ হয় না শেফালি, যুথিকা, মালতিদের।

প্রণতি দাস (নাম পরিবর্তিত) বয়স এখন প্রায় ৫০। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই দু’মুঠো খাবারের জন্য এই পেশায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। ছোটবেলাতে বাবা ভাগ চাষে পাওয়া কুমড়ো বিক্রি করে পুজোর সময় একটা কিছু একটা কিনে দিতেন। তা দিয়েই পুজো ক’দিন এবং সারা বছর চলে যেত। অন্য কিছু পরার ইচ্ছা থাকলেও অভাবের সংসারে তা সম্ভব হত না। এখন সময় বদলেছে। নিজের রোজগারে দূর হয়েছে সংসারের অভাব। সারাবছর সকলের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা সহ পুজোর সময় নতুন জামাকাপড় ব্যবস্থা করেন তিনি।

আরও পড়ুন – সপ্তমীর সকাল বৃষ্টি দিয়ে শুরু

সরস্বতী অধিকারী (নাম পরিবর্তিত) বয়স এখন তিরিশ। ভ্যান চালক বাবার সংসারের অভাব দূর করতে গিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই দালালের খপ্পরে পড়ে যৌনপল্লিতে পাচার। পরে এক যুবকের সহায়তায় সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পরে তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিধিবাম! পথ দুর্ঘটনায় স্বামী কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে, ফের যৌনপল্লিতে ফিরতে হয় তাঁকে। পরিবারের ভার এখন তার হাতেই। সন্তান নেননি। কারণ তাহলে খদ্দের কমে যাবে। ছোটবেলায় পুজো চারদিন ভাইবোনের সঙ্গে সারাদিন এপাড়া ওপাড়ার পুজো মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতেন। আর এখন সবই অতীত। ইচ্ছা থাকলেও পুজো প্যান্ডেলে যাওয়া হয় না সব বছর। যদি বাজার খারাপ থাকে তাহলে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সারারাত শহরের বিভিন্ন প্যান্ডেলে ঘোরা এবং রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া। নতুন জামাকাপড় দুর্গাপূজা উপলক্ষে আলাদা কিছু কেনা হয় না। কারণ সারা বছরই নিজেকে ফিটফাট রাখার জন্য কিনতেই হয় নতুন পোশাক।

লক্ষী কর্মকার (নাম পরিবর্তিত) বয়স এখন তিরিশের কোঠায়। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়াই বাধ্য হয়ে এই পেশায় আসা। ছোট থেকেই সংসারের কাজকর্ম করতে গিয়ে উৎসবের দিনগুলি তাঁর কাছে ফিকে ছিল। আর এখন সময় বদলেছে। রোজগারও বেশ ভালই হয়। এক শিশু সন্তানের মুখে তাকিয়ে নিজেকে কঠিন করে রাখেন। যদিও পুজোর সময় ছেলেকে নিয়ে নিয়ম করে দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাওয়া হয়।

সোনাগাছিতে দুর্বার সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌনকর্মীদের জন্য দুর্গাপুজো হলেও বীরভূমের একমাত্র যৌনপল্লিতে তা হয় না। কিন্তু আনন্দে মাতোয়ারা না হলেও বাড়তি উপার্জন এর জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন তাঁরা। দশভূজা তাঁদের কাছে ধনদায়িনী।

আরও পড়ুন – মুখ্যমন্ত্রীর লেখা গান সেরা থিম সঙ, বিশ্ববাংলার শারদ সম্মান ৭৯ পুজো কমিটিকে

Previous articleমহাষ্টমীতে কুমারী পুজো, মণ্ডপে মণ্ডপে পুষ্পাঞ্জলি
Next articleঢাক বাজিয়ে পুজো উদ্বোধন সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের