রামে যাওয়া বাম ভোট এবারও ফিরবে না, কণাদ দাশগুপ্তের কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

কয়েকমাস আগে, লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর রাজ্যজুড়েই আওয়াজ উঠেছিলো, ‘বাম ভোট রামে গিয়েছে বলেই বিজেপির এই চমকপ্রদ ফল’। তৃণমূল তো বটেই, এই একই অভিযোগ তুলেছিলো কংগ্রেসও। লোকসভা ভোটে বাম-কং আসন সমঝোতা ছিলনা। একে অপরের বিরুদ্ধেই লড়েছে। বিজেপির ভোট একলাফে 40% পৌঁছে যাওয়া এবং সিপিএম তথা বামেদের ভোট 7%-এ নেমে আসার তথ্যকেই সামনে এনে বলা হয়েছে ‘বামভোট রামে’ গিয়েছে। বিজেপিও যে এই প্রচারের প্রতিবাদ করেছে, তেমন নয়। কারন, বিজেপি বুঝেছিলো, শুধুই বামভোট নয়, কংগ্রেসের ভোটের একটা অংশও পদ্ম-প্রতীকে এসেছে বলেই, এতখানি ভোট বেড়েছে। তৃণমূলের বক্তব্য ছিল, তাদের হারাতে সিপিএম গোপনে এবং পরিকল্পিতভাবে
বিজেপিতে ভোট ট্রান্সফার করেছে। রাজনৈতিক সেই চাপান-উতোরের নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভব নয়, হয়ওনি। এখনও তৃণমূল নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করে, গত লোকসভা নির্বাচনে ‘বাম ভোট রামে’ গিয়েছিলো।

সমীকরণের বদল ঘটেছে রাজ্যের তিন বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে। রাজ্যের 3 কেন্দ্রের বিধানসভার উপনির্বাচন 25 নভেম্বর। খড়গপুর, কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরের উপনির্বাচন নিয়ে সব পক্ষই একুশের ফাইনালের আগে কার্যত রুদ্ধশ্বাস ‘সেমিফাইনাল’ খেলতে নেমেছে। এই উপনির্বাচনে বাম-কং জোটবদ্ধ। তিন আসনের দু’টিতে, খড়্গপুর-সদর এবং কালিয়াগঞ্জে কংগ্রেস এবং করিমপুরে সিপিএম লড়ছে জোট গড়ে। দু’দলই আশাবাদী, শরিক দলের ভোট এবার তাঁদের প্রার্থীর পক্ষেই যাবে। কংগ্রেসের আশা একটু বেশি, খড়্গপুর-সদর এবং কালিয়াগঞ্জ একসময় কংগ্রেসের দুর্গ ছিলো। খড়্গপুর-সদরে এখনও প্রয়াত জ্ঞানসিং সোহনপালের প্রভাব আছে। কালিয়াগঞ্জ আসনটিতে বহু বছর ধরেই কংগ্রেস অপরাজিত। এই দুই আসনে বাম-ভোট সন্তোষজনকভাবে পাওয়া গেলে, তারা চমক দেখাতে পারে বলেই মনে করছে কংগ্রেস। কিন্তু এই সম্ভাবনা কতখানি ? লোকসভা ভোটে বামেদের যে ভোট বিজেপিতে গিয়েছে,  চলে যাওয়া ভোটের সেই অংশ কি এবার ফিরে আসবে? কেন ফিরবে? ফিরিয়ে সিপিএমের আদৌ কোনও লাভ হবে?

খড়গপুর, করিমপুর ও কালিয়াগঞ্জ উপনির্বাচনে বিজেপি লোকসভার ভোটে প্রাপ্ত ভোট ধরে রাখতে মরিয়া। খড়গপুর ও কালিয়াগঞ্জ আসন কখনই তৃণমূল পায়নি। করিমপুর অবশ্য তৃণমূলের। শাসক তৃণমূল তিন আসনই দখলে আনতে মরিয়া। ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে রাজ্যে এই প্রথমবার কোনও উপনির্বাচনে দলীয় ইস্তেহার প্রকাশ করেছে তৃণমূল। তিন কেন্দ্রের জন্য তিনটি আলাদা ইস্তেহার। তৃণমূল জানে, ফল খারাপ হলে নিশ্চিতভাবেই সেই ফলের প্রভাব পড়বে একুশের ভোটে।

2016-র বিধানসভা নির্বাচনের পর বাম- শরিকদের অভিযোগ ছিল, তাঁরা কংগ্রেস প্রার্থীদের ভোট দিলেও কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বামপ্রার্থীদের ভোট দেননি। আবার বামভোটে জিতে অসংখ্য কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূলে চলে গিয়েছেন। বাম-শরিকরা এখনও মনে করে, 2016-তে কংগ্রেসের ভোট বামপ্রার্থীরা পাননি। তার ‘বদলা’ বামেরা এবার নিলে কংগ্রেস কোথায় দাঁড়াবে? বামেরা তিন কেন্দ্রের একটিতেও নিজেদের ক্ষমতায় জেতার জায়গায় নেই। অথচ তৃণমূলকে হারানোর তাগিদ আছে ষোলো আনা। এই লজিক’কে সামনে রেখেই গত লোকসভায় বামেদের একটা অংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। বিজেপি বাড়তি এই ভোট নিয়ে 18 কেন্দ্রে তৃণমূলকে হারিয়েও দিয়েছে। 18 কেন্দ্রে নিজেদের ক্ষমতায় তৃণমূলকে হারিয়ে দেওয়া এখনও বামেদের কাছে স্বপ্ন। লোকসভায় একটু কৌশল করে সেই স্বপ্ন বামেরা পূরণ করেছে।

তিন উপনির্বাচনেও বামেরা এককভাবে জেতার জায়গায় নেই। অথচ তৃণমূলের শক্তিবৃদ্ধি হোক, এমনটাও তারা চায়না। রাজ্যে গেরুয়া ভোট অনেকটাই বেড়েছে। পদ্ম-শিবির তিন শিবিরেই জয়ের আশা করছে। এই তিন কেন্দ্র জিততে পারলে, একুশের ভোটের আগেই তৃণমূলকে অন্য বার্তা দিতে পারবে, যা বিজেপির কাছে খুবই জরুরি। তৃণমূলকে তেমন বার্তা দেওয়া সিপিএমের কাছেও জরুরি। বামভোটের একটা অংশ পদ্ম-পক্ষে এলে তৃণমূল হারবে। তাতে লাভ বিজেপি এবং বাম, উভয়েরই। তিন কেন্দ্র গেরুয়া হলে, একুশের ভোটে তৃণমূলের ফিরে আসাটা বেশ ‘টাফ’ হবে বলেই রাজনৈতিক মহলের ধারনা। এমন ফল হলে ফের রাজ্যে তৃণমূল ভাঙবে। তৃণমূলের শক্তিক্ষয় হবে। এটা বিজেপি যেমন চায়, সিপিএমও তাইই চায়। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে একুশের ভোটে কংগ্রেসের ‘অপশন’ আছে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার। বামেদের আপাতত তা নেই। ফলে নিজেদেরটা নিজেদেরই ভাবতে হবে। আর সেই ভাবনা ভেবে লোকসভায় ‘ফল’ পেয়েছে বামেরা। তিন উপনির্বাচনেও ‘বামভোট রামে’ গেলে বেশি লাভ সিপিএমের। হারানো যাবে তৃণমূলকে। ভোটের পর সভা-সমাবেশে বলা যাবে, তৃণমূলকে রাজ্যবাসী আর চায়না।

বামেদের ধারনা, জোট হলেও করিমপুরে বামপ্রার্থীর পরিবর্তে তৃণমূল প্রার্থীকেই সমর্থন করবে কংগ্রেসি ভোটাররা। সেক্ষেত্রে বাকি দুই কেন্দ্রে কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে জয়ের দোরগড়ায় পাঠিয়ে বামেদের লাভ কতখানি ? জেতার পর কংগ্রেস বিধায়ক তো তৃণমূলেও চলে যেতে পারেন? বামেদের ভোটে বিধায়ক হয়ে তো অনেকেই সে কাজ করেছেন। এই দলবদলু বিধায়করা বামভোটে জিতে তৃণমূলকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু বিজেপি প্রার্থীর পক্ষে সে কাজ সম্ভব নয়। তাই বামভোট কংগ্রেসে যাওয়ার বদলে রামে গেলে, তৃণমূলকে দুর্বল করার সিপিএমের লক্ষ্যই পূরণ হচ্ছে।

বামভোট রামে পাঠিয়ে লোকসভায় অনেকটাই দুর্বল করা গিয়েছে তৃণমূলকে। একুশের ভোটের আগে, উপনির্বাচনেও তৃণমূলকে দুর্বলতর করতে একই পথে হাঁটতে তাই বামেদের কোনও ছুৎমার্গ না থাকারই কথা। করিমপুরের কংগ্রেসি ভোটার বা খড়গপুর ও কালিয়াগঞ্জের বাম-ভোটাররা জোটের শর্ত কতখানি মান্য করবেন বা মানতে দেওয়া হবে , ফল ঘোষণার আগেই তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।  28 নভেম্বর হয়তো দেখা যাবে, করিমপুরে তৃণমূল এবং খড়গপুর ও কালিয়াগঞ্জে পদ্ম-প্রার্থীরাই হৈ হৈ করে জিতেছেন।

Previous articleমহারাষ্ট্রে মহাচমক: ভোররাতে বিজেপির শপথ, দুপুরে পাল্টা হুমকি
Next articleপেঁয়াজ কিনতেই আমজনতার ‘চোখে জল’