জুনিয়র ডাক্তারদের মনে ভয় ঢোকানোর কোচিং সেন্টার বন্ধ হোক

জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে অবসাদ কমাতে হলে আগে এই কোচিং সেন্টারগুলো কে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা হোক। একটা ছেলে বা মেয়ে জন্ম থেকে কোচিং সেন্টারের জন্য বলি প্রদত্ত হয়ে উঠছে। জয়েন্ট ঢোকার আগে কোচিং। ঢুকে পাঁচ বছর পড়া। তারপর আবার কোচিং।

যেটা বলতে বসেছি সেটা হলো ডাক্তারী ছাত্রদের সীমাহীন ইঁদুর দৌড়ে মানসিক চাপ এবং অবসাদ। অবসাদ এবং তার লড়াই নিয়ে আমার বলার এক্তিয়ার কতটা আমি জানি না কিন্তু আমি যেটা বলবো সেটা হলো কারা কি ভাবে একটা স্বাভাবিক সুস্থ ছেলে বা মেয়ে কে একটাআ কোনঠাসা জায়গাতে নিয়ে যাচ্ছে।

একটা ছেলে এমবিবিএস এ আসার পর পর ই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করে। সেখানে প্রতিযোগিতা থাকে। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা সুস্থ প্রতিযোগিতা। যে ছেলে বা মেয়ে ভালো পড়ছে বা ক্লাস করছে ভালো নাম্বার পাচ্ছে তারা একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকছে। কিন্তু যে ছেলে টা রাত ওবধি একটু পড়ার বহির্ভূত বিষয় নিয়ে পড়ছে, মোটামুটি একটা নাম্বার পেয়ে পাশ করছে সেও কিন্তু পুরো সিস্টেমে মধ্যেই থাকছে।
সমস্যা হলো কেউ বা কারা একটা ফার্স্ট ইয়ার এমবিবিএস র ছেলেকে বোঝাতে শুরু করছে এমবিবিএস করে কিন্তু কিছু হবে না। অথচ সে তখন এমবিবিএস টাই করে ওঠেনি। তার আগে থেকেই কাগজ লিফলেট বা অন্য কিছু র মাধ্যমে ফিসফিস করে একটাই মন্ত্র কানে গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না। ফলে যে অনার্স পায় সে আরো চাপ নিচ্ছে। পড়া বাড়ছে না। দেখা গেলো শুধু পড়ার আনন্দে পড়াশুনো করে ভালো রেজাল্ট যা করেছিলো সেও বালতি বালতি টেনশন খাচ্ছে কারণ শয়তানের বাণী কানে ঢুকে গেছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না।

জীবনে উত্থান পতন হলেও আমি আমার ডিগ্রি বা কোর্স নিয়ে ভাবিত ছিলাম না। কেন জানি না এমবিবিএস র পরে কোচিং না নিয়ে গান বাজনা কেন করেছিলাম সেই চর্বিত চর্বন বা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি র কথা বলতে বসিনি। তবে মনে আছে একটি বিখ্যাত কোচিং সেন্টারের মার্কেটিং ম্যানেজার যাকে এন আর এস থেকে নর্থ বেঙ্গল সব জায়গা তে দেখা যেতো, সে আমার ঘরে ঢুকে যখন বললো এমবিবিএস করে কিছু হবে না আমি পাশ ফিরে শুলাম। সে বললো এর কিছু হবে না। আমার খুব বেশী কিছু হওয়ার কথা ছিলো না কিন্তু সেই কোচিং ইন্সটিটিউট উঠে গেছে এবং এখন সেই লোকটি অন্য কোম্পানী তে সেলস ম্যান। তার ভালো হোক এটা কাম্য আমার।

এরপর যতবার কোচিং সেন্টার গুলো র প্রোমোশনাল ক্লাসে গেছি একটাই জিনিস দেখেছি একটা ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া ছেলেমেয়ের মধ্যে। একটা অদ্ভুত ইনসিকিওরিটি তৈরী করা। সত্যি বলতে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মা ছেলে ডাক্তার হয়েছে এতেই অনেকটা খুশি থাকে। মাঝে মাঝে গাঁইগুই করে বিয়ে আর এমডি র জন্য। কিন্তু এই যে ভয়ানক চাপ সেই কাজ টা ব্যবসায়ী সংস্থা গুলো এখন দ্বিতীয় বর্ষ থেকে শুরু করছে। ফলে সাধারণ ক্লাস ফেলে ছেলে মেয়ে গুলো ইনডাকশন প্রি ইনডাকশন ক্লাস করছে। ওয়ার্ডে যাচ্ছে না। রোগী দেখছে না। সারাদিন কানের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না। এদিকে পুরোনো শিক্ষক রা শুধু এটা এমসিকিউ জেনারেশন বলে নটা পাঁচ টা টাইম পূরণ করছে ভাট বকে। ছিলো আমাদের সময় ( মনে মনে ভাবি হা যখন নকশাল আন্দোলনের নামে পরীক্ষা না দিয়েই ডাক্তার হয়েছে কত লোক) যখন হাতে কলমে শেখা হতো। এরা আবার ছাত্র নাকি। তাই এদের পড়িয়ে লাভ নেই। কি সুন্দর যুক্তি। আহা।

সার্বিকভাবে সমস্ত এমবিবিএস ছাত্রছাত্রী এবং জুনিয়র ডাক্তারদের জায়গাতে দাঁড়িয়ে কেউ ভাবছে না কথাটা। আমরা স্টেট ফ্যাকাল্টি সার্বিকভাবে তাদের সর্বভারতীয় পরীক্ষাতে যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য তৈরী করতে পারছি না। এখনো পড়ানোর ধরন নব্বই র দশকে পড়ে আছে(আমার এমনি শত্রু অনেক। সম্পৃক্তি র লেভেলে আছে সংখ্যা টা) বেশীরভাগ শিক্ষকের। টিচার ট্রেনিং দিতে আসা লোকটাই ইংরেজী বলতে চারবার তোতলাতে থাকে। সেখানে এসি হলে আই প্যাড থেকে নোটপ্যাড খুলে চোস্ত ইংরেজি তে সুন্দরভাবে আলু ভর্তা কেই mashed potato with low salt butter, and freshly picked green chilly from garden বলে যখন কেউ পড়াচ্ছে সবাই সেদিকে পতঙ্গের মতো ঝুঁকে যাচ্ছে। আসল উদ্দেশ্য ডাক্তার হওয়া। যার জন্য সবথেকে বড় শিক্ষক একটা রোগী সেটা ছেলেমেয়ে রা ভুলে যাচ্ছে। ইন্টার্ণশিপের টাকায় গোয়া ট্রিপ স্কুবা ডাইভিং না করে কোচিং সেন্টারে র খাতায় জমা করে সারাদিনে সাত ঘন্টা ক্লাস করছে। একটা বিষয় কখনো কোনোদিন দু থেকে তিনদিনে এরকম ভয়ানক ক্লাস করে শেখা যায় না। উল্টে কি হচ্ছে আমি কত কম জানি এই অনুভূতি নিয়ে সবাই ঘরে ফিরে আসছে। কানের কাছে একটাই কথা বাজছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না। এক বছর কোচিং করে যখন কিছু হলো না তখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে চেম্বারে রোগী দেখবে বা আইসিইউ করবে সেই জোরটা ও থাকছে না।

ফলে সার্বিকভাবে ফাইনাল ইয়ার থেকে জুনিয়র ডাক্তার এবং এমডি না পাওয়া ছেলেমেয়ের মধ্যে যে হতাশা তার নব্বই শতাংশ কারন হলো পিজি পাওয়ার ইঁদুর দৌড়। পরীক্ষা তে প্রশ্ন ও করা হয় প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনের জ্ঞানের বাইরে গিয়ে সমান্তরাল বিশ্ব থেকে। এবং এর পুরোটাই কোচিং সেন্টার ফান্ডেড। যাতে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে কোচিং সেন্টারের কাছে যেতেই হয়। ইদানিং আবার সেভাবে কোন ভালো এম সি কিউ বই ওবধি নেই বাজারে। কি ভয়ানক। পরীক্ষার প্রশ্ন সাধারণ ছেলে রা জানবে না অথচ কোচিং সেন্টার জানে।

সার্বিকভাবে প্রতিটা জুনিয়র ডাক্তারের জীবন থেকে স্বাভাবিক ছন্দ টা হারাচ্ছে এই পিজি র ইঁদুর দৌড়ে। যারা মানসিকভাবে সুস্থ তারা লড়াই টা জিতে যাচ্ছে। যারা একটু দুর্বল তারা অবসাদে ভুগছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। অথচ এই ইঁদুর দৌড়ে না থাকলে সে দিব্যি নিজের মতো থাকতো। কে বলেছে এমবিবিএস করলে কিছু হবে না? এমডি করতে হবে। দু চার বছর পরে করলে কিচ্ছু হবে না। এটা বলার মতো নেই। আর এই ভয়ানক ইঁদুর দৌড়ে সেটা বললে অপ্রিয় ও হতে পারার সম্ভাবনা থাকে।

অবসাদ এবং তার প্রতিকার, আত্মহত্যা কি ভাবে আটকানো যায় সেগুলো বিশেষজ্ঞ র পরামর্শ ই একমাত্র নেওয়া উচিত। এটা আমার নিজের ভাবনা টুকু শুধু লেখা।

বস্তুত এই প্রহেলিকার মধ্যে গোটা জুনিয়র ডাক্তার রা যে আজ ঘুরছে তার জন্য আমাদের ই দায়।

Previous articleরোজভ্যালি কর্ত্রী শুভ্রার বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিশ
Next articleজুতো সেলাই শিখে এখন কী কান্ড করছেন ফুটবলার!