দিল্লির কোপ-আতঙ্কে গোষ্ঠীবাজি ‘ভুলতে’ চাইছে বঙ্গ-বিজেপি

তিন উপনির্বাচনের ময়না-তদন্ত সেরে ফেলেছে দিল্লি- বিজেপি। তদন্ত রিপোর্টে যা উঠে এসেছে, তা রাজ্য বিজেপির একাধিক নেতার ঘুমের বারোটা বাজানোর পক্ষে যথেষ্ট। রাজ্য নেতৃত্ব, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা সাধারন নেতা-কর্মী, এই তিন উপনির্বাচনে  ভরাডুবির দায় থেকে কাউকেই রেহাই দিচ্ছেন না দিল্লি বিজেপি। আর সে কারনেই বঙ্গ-বিজেপিকে কড়া বার্তা দিতে 7 ডিসেম্বর সম্ভবত নিজেই আসছেন অমিত শাহ।

সূত্রের খবর, তিন উপনির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় বিজেপি নিশ্চিত হয়েছে, তৃণমূলের কৌশলে বিজেপির হিন্দুভোটেও এবার টান পড়েছে। কোন কারনে এবং কাদের আত্মতুষ্টির কারনে এমন হলো, রাজ্য শাখার কাছে তা জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি।

এ রাজ্যের তিন উপনির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই অস্বস্তিকর চিত্রই খুঁজে পেয়েছে দিল্লি-বিজেপি। মূলত মোদি-শাহের অক্লান্ত পরিশ্রমে গোটা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও হিন্দুভোটের একটা বড় অংশ লোকসভা ভোটে পদ্ম-শিবিরে সামিল হয়েছিলো। যা স্পষ্টতই দেখা গিয়েছে ভোটের ফলে। কিন্তু মাত্র মাস ছ’য়েকের মধ্যেই মোদি-শাহের পরিশ্রমে রাজ্য নেতারা যেভাবে ঠাণ্ডা জল ঢেলেছেন, তা মানতে নারাজ দিল্লি। এই ভোটে রাজ্য নেতৃত্বের পালফরম্যান্সে কেন্দ্রীয় বিজেপি যথেষ্টই ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত।

ওদিকে, দিল্লির ‘কোপ’ থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি রাজ্য দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতারা অন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। একাধিক শিবিরে বিভক্ত বঙ্গ-বিজেপি ‘বিভেদ’ ভুলে এখন এক হচ্ছেন। এবং একইসুরে সব ‘বিবদমান’ পক্ষ নীরবে প্রচার করছেন, এই ফলাফলের একমাত্র কারণ NRC-আতঙ্ক। NRC নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির কেন্দ্রীয় বিজেপির একবগ্গা বিবৃতি এ রাজ্যের বিজেপি ভোটব্যাঙ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অসমে NRC-র প্রভাব পড়েছে 19 লক্ষ হিন্দুর ওপর, যাদের সিংহভাগ অসমের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন বিজেপিকেই। তারাই আজ দেশছাড়া হওয়ার আতঙ্কে কুঁকড়ে আছেন। ফলে, এই পরাজয়ের দায় পরোক্ষে কেন্দ্রীয় বিজেপিরও।

রাজ্য নেতৃত্বকে দিল্লির নেতাদের ভর্ৎসনা, ‘তৃণমূলের একতরফা প্রচারের মোকাবিলা করতে দল ব্যর্থ হওয়ার জন্যই গেরুয়া ছাতার তলা থেকে সরে গিয়েছে হিন্দুভোটও। সরে যাওয়া ভোটের সিংহভাগ গত লোকসভা ভোটে পদ্ম-প্রতীকেই গিয়েছিলো। নির্বাচনের কৌশল হিসাবে তৃণমূল NRC-র অশুভ প্রতিক্রিয়া নিয়ে জবরদস্ত প্রচার মোকাবিলা করতে চরম ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য নেতারা। দলের প্রচার ছিলো ছন্নছাড়া। এ সব কারনেই তিন আসনে বিজেপির এই পতন বলে মনে করছেন শীর্ষ গেরুয়া-নেতৃত্ব।

খড়্গপুর এবং কালিয়াগঞ্জে জয় নিশ্চিত ধরে নিয়েই বঙ্গ-বিজেপির এবার পাখির চোখ ছিলো করিমপুর। করিমপুরে ভেলকি দেখাতে পারলে তিনটি আসনেই পদ্ম ফুটবে। জোর ধাক্কা খাবে তৃণমূল। এই ফরমূলা সামনে রেখেই এই তিন উপনির্বাচনে গিয়েছিলো বিজেপি। ভোটের ফল ব্যুমেরাং হয়ে বিজেপির ঘরেই ফিরেছে। তার পরই দলের অন্দরে জোরদার প্রশ্ন, তাহলে কি হিন্দু ভোটও সরে গিয়েছে বিজেপির পাশ থেকে? এমন ধারা বহাল থাকলে একুশের ভোটের ফল তো হবে শোচনীয়। ফলাফল খতিয়ে দেখে বিজেপির শীর্ষনেতাদের ব্যাখ্যা, ‘সিপিএমের সঙ্গে জোট করলেও কংগ্রেস ভোট করেছে তৃণমূলের পক্ষে। সে কারনেই করিমপুরে এভাবে পতন হয়েছে বামপ্রার্থীর।

বিজেপির অফিসিয়াল গোষ্ঠীর বিরোধী শিবিরের ব্যাখ্যা আবার অন্য। হিন্দু ভোট নিয়ে বিজেপির শীর্ষস্তরের ‘ওভার-কনফিডেন্স’-ই দলকে এভাবে পথে বসিয়েছে। রাজ্য নেতারা নিশ্চিত ছিলেন, লোকসভার ফল দেখার পর হিন্দু ভোটাররা দলে দলে এসে পদ্ম-প্রতীককেই সমর্থন করবেন।

এদিকে সঙ্ঘ-পরিবারের অন্যতম শীর্ষ এক কার্যকর্তার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই নেতার বক্তব্য, রাজ্য বিজেপির বড় বড় নেতাদের কেন জানিনা ধারনা হয়েছিলো, শুধু উগ্র হিন্দুত্বকে ক্যাপিটাল করলেই মুনাফা আসবে। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর বিজেপি নেতারা সাংগঠনিক কাজে এক ফোঁটাও নজর দেননি। কাগজে বিবৃতি, টিভিতে মুখ দেখানো আর ঘরে বসে তৃণমূলের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। দলের নিচুতলার কর্মীরা মঞ্চ সাজিয়ে দিয়েছেন, নেতারা গিয়ে ভাষন দিয়ে এসেছেন। এ সবই আত্মতুষ্টির কারনে। মোদিজির হাওয়ায় 18 আসন পেয়ে রাজ্য নেতাদের ধারনা হয়েছিলো, এই ফল তাদের জন্যই হয়েছে। জমি তৈরি হয়ে গিয়েছে। এবার ফসল উঠবে ঘরে। নেতাদের এই অপরিনত বাস্তববোধের কারনেই বিজেপি এ রাজ্যে লজ্জাজনক জায়গা ছুঁয়েছে। আরএসএস নেতৃত্বের ক্ষোভ, সঙ্ঘ- সংগঠনকে বিজেপি এবার পাত্তা দেয়নি অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিতে। সঙ্ঘকে কোনও কাজেই লাগানো হয়নি। করেনি।

ওদিকে করিমপুরের বিজেপি কর্মীদের অভিযোগ, দলীয় প্রার্থী বড় নেতা, তাই জেলা কমিটিকে আমল না দিয়ে, নিজেই ভোটের ‘স্ট্র্যাটেজি’ ঠিক করেছিলেন। সঙ্গী ছিলেন মুকুল রায়। নিজেদের স্টাইলে এরা ভোট করেছেন। এরা দু’জনই দলে নবাগত। বিজেপি কীভাবে সঙ্ঘ পরিবারের সাহায্য নিয়ে ভোটকৌশল তৈরি করে, সেসব জানেনই না এই দুই নব্য নেতা। যাদের দিয়ে এবারের ভোট করানো হয়েছে তাদের অধিকাংশই সদ্য তৃণমূল ছেড়েছেন। এরা এখনও তৃণমূলের সঙ্গেই ওঠাবসা করেন। তৃণমূলের প্রভাব এরা এখনও কাটাতে পারেনি। এরাই হয়তো গোপনে তৃণমূলকে সাহায্য করেছে।

Previous articleদাম স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ বেচবে না মানিকতলা মার্কেটের বিক্রেতারা
Next articleঅভিষেকের ডাক : লেটস ফুটবল