CAB নিয়ে বাংলায় কী বোঝাবে বিজেপি? কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

CAB বা NRC ইস্যুতে এক গুরুতর বার্তা জাতীয় বিজেপি ইতিমধ্যেই গোটা দেশের সব রাজ্যের বিজেপিকেই দিয়ে ফেলেছে৷ দেওয়ালের এই লিখন বাংলার বিজেপি নেতারা নিশ্চয়ই পড়তে পারছেন৷

CAB-NRC নিয়ে গত তিনদিন ধরে জ্বলছে অসম এবং ত্রিপুরা৷ এই দুই রাজ্যই বিজেপি- শাসিত৷ সংশোধনী বিল নিয়ে দুই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন প্রায় কাশ্মীরের পর্যায়ে৷ দলে দলে সেনা নেমেই চলেছে৷ তাতেও পরোয়া করছে না কেন্দ্র৷ ওই দুই রাজ্য বিজেপিকে পারলে ছিঁড়ে খাবে৷ আজ ভোট হলে ওই দুই রাজ্যে বিজেপি হাতে গোনা আসন পাবে কিনা সন্দেহ৷ অথচ দু’রাজ্যের বিজেপি দলকে এবং বিজেপির সরকারকে এভাবে পথে বসাতে প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’বার ভাবেননি৷ এর কারন, ওনাদের প্রথম এবং প্রধান জেদ, CAB এবং NRC লাগু করা৷ তাতে যদি কোথাও দলের সরকারের পতন হয়, হোক৷ রাজ্য বিজেপির কোনও কথাই আমল দিচ্ছে না কেন্দ্র৷ NRC- নিয়ে অসমের বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মার কোনও ওজর-আপত্তিই প্রথমে দিল্লি পাত্তা দেয়নি৷ NRC-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর মোদি-শাহ টের পেয়েছেন, খেলা ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে৷ 17 লক্ষ হিন্দুর নামই বাদ গিয়েছে আর সেই প্রক্রিয়াকেই টানা সমর্থন করে গিয়েছে দিল্লি৷ ধাক্কা খেয়ে চৈতন্য ফিরেছে৷ এখন সেখানে ফের নতুন করে NRC তৈরির কথা বলছে কেন্দ্র৷ ওদিকে প্রথম NRC করতে গলে গিয়েছে 1600 কোটি টাকা৷ এমন আশঙ্কা এই CAB নিয়েও করছে অসম-ত্রিপুরার মানুষ৷ আর ওই দুই রাজ্যের বিজেপি নেতারা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, দিল্লিতে তাঁদের কানাকড়িও দাম নেই৷ দল বা সরকার, কেউই তাদের পাত্তা আগেও দেয়নি, এখনও দিচ্ছে না৷ বাংলার বিজেপি নেতারা মৃদুস্বরে প্রতিবাদ করতে গেলে, তাদের হালও যে একই হবে, এটা ধরে নেওয়াই যায়৷

বঙ্গ-বিজেপির নেতারাও এবার খেয়াল করুন, দলেরই সরকার আছে, তবুও কেন্দ্রীয় সরকার বা জাতীয় বিজেপি যদি এতখানি ‘ডোন্ট কেয়ার’৷ তাহলে বাংলার “বিরোধী দল” বিজেপি দিল্লির থেকে এই ইস্যুতে কতখানি সহানুভূতি, সহযোগিতা বা আশ্বাস পাবে ? বঙ্গ- বিজেপির নেতারা কোন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আশ্বস্ত করবেন বাংলার মানুষকে? দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত বাংলার মানুষকে কী বলবে বাংলার বিজেপি? হয়তো এদের সিংহভাগ লোকসভায় ভোট দিয়েছিলেন পদ্মফুলে, কিন্তু একবুক ভয় নিয়ে একুশের ভোটেও এই আতঙ্কগ্রস্ত মানুষরা বিজেপিকে সমর্থন করবেন ? এই আশা বিজেপি এতকিছুর পরেও করছে? বিজেপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরাই কি নিশ্চিত যে তাদের ঘাড়েও এই NRC বা CAB-র খাঁড়া নেমে আসবেনা? কে দেবেন গ্যারান্টি? দিলীপ ঘোষ, বাবুল সুপ্রিয় না দেবশ্রী চৌধুরি ? পরিস্থিতি যা তাতে বিজেপি নেতাদের ‘সিকিওরিটি’ না বাড়াতে হয়৷ ফলে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খাওয়া ছাড়া বিকল্প পথ বিজেপির রাজ্য নেতাদের হাতে কোথায় ?

বিজেপি নেতারাও মেনে নিয়েছেন NRC-র প্রভাব পড়েছিলো সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ৷ বিজেপির রাজ্য সভাপতি এবং এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর গড়েই তৃনমূল কার্যত তাঁদের উৎখাত করে ছেড়েছে৷ মে মাসের হতাশা 6 মাসেই কাটিয়ে উপনির্বাচনে বিজেপিকে প্রায় মাঠের বাইরেই করে দিয়েছে তৃণমূল৷ বিজেপির হেভিওয়েটরা নিজেদের নির্বাচনী কেন্দ্রেই অপ্রাসঙ্গিক হয়েছেন৷ এক NRC-র কোপেই মাত্র 6 মাস হাওয়া ধরে রাখতে নিদারুন ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি৷ এমনিতেই দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নেতার অভাব, দলের সেই সব নেতাদের ছেলেমানুষি বিবৃতি, সংগঠন করার উপযুক্ত লোকজনকে পিছনের বেঞ্চে পাঠানো, দল ক্রমশই ব্যক্তিনির্ভর বা সাংসদ-কেন্দ্রিক হয়ে পড়া, পাড়ার পাঁচটা লোকও চেনেনা, এমন চরিত্র খুঁজে এনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো ইত্যাদি কারন তো ছিলোই, বঙ্গ-বিজেপিকে এবার আরও বড় বিপাকে ফেলে দিলেন মোদি-শাহ৷ বঙ্গের তিন উপনির্বাচনে NRC বিষয়টি ঠিক না ভুল, তা একআনাও বোঝাতে পারেননি বাংলার গেরুয়া নেতারা৷ প্রচারে নাগরিকপঞ্জির কথা এনে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করেছে তৃণমূল৷

আসন্ন পুরসভা- বিধানসভা ভোটে সেই NRC তো আছেই,
এবার সঙ্গী হলো CAB বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল৷ এই CAB কার্যত আশীর্ব্বাদ হয়ে এসেছে তৃণমূলের কাছে৷ বিল এবার আইন হবে৷ এই আইনের কার্যকারিতা বা প্রয়োগের ঢালাও ভালোমন্দ বোঝার আগেই বঙ্গের নির্বাচন পার হয়ে যাবে৷ NRC বা CAB নিয়ে রাজ্য বিজেপির নেতারা নিজেরা ভালোভাবে না বুঝে স্রেফ দিল্লিকে তুষ্ট রাখতে এতদিন ধরে এমনই হুমকি দিয়েছেন যে বাংলার মানুষ ভীত হয়ে পড়েছে৷ পাঁচজনের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাচ্ছে, ঠিক হোক বা ভুল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে NRC বা CAB নিয়ে একটা ধারনা হয়েছে, আমার ঘাড়েও এই কোপ নেমে আসতে পারে৷ এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তির উপায় কি, সে ধারনাও স্বচ্ছ নয়৷ একটা ভয়ের আবহ তৈরি করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, সেকাজে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা৷ ওদিকে, বাংলার মানুষ দেখছে এবং শুনছে, তৃণমূল এই NRC বা CAB-র কট্টর বিরোধী৷ সাধারন মানুষ এই বিরোধিতাটাই চাইছে৷ ভোটপ্রচারেও তৃণমূল নিশ্চিতভাবেই এই NRC বা CABকে নিজেদের মতো করেই তুলে ধরবে৷ অথচ তার মোকাবিলায় বঙ্গ-বিজেপিতে গ্রহণযোগ্য মুখই নেই৷ প্রচারে মোদি-শাহ এসে যাই বলুন, সাধারন মানুষ তো আর বিপাকে পড়লে সেখানে পৌঁছাতে পারবেন না৷ ওদিকে বঙ্গ-বিজেপির নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতাই তৈরি হয়নি৷ নির্ভর করার মতো মুখ কোথায়? ফলে, এসব নেতাদের শত আশ্বাসেও চিঁড়ে ভেজার আশা ক্ষীণ৷ মাত্র তিন আসনে NRC-র ধাক্কা যে নেতারা সামলাতে পারেননি, সেই নেতারা 294 আসনে NRC এবং CAB-র জোড়া-ধাক্কা সামলে দেবেন, এতখানি আশা করা বেশ বাড়াবাড়ি৷
ফলে, আজ এই পরিস্থিতিতে অবশ্যই বলা যায়, বাংলা নিয়ে দিল্লি আদৌ চিন্তিত নয়৷ সরকার হলে ভালো, না হলে হলো না, ক্ষতি নেই৷ এবং এটাও বলা উচিত, লোকসভা ভোটের পর কিছুটা বেদম হওয়া পড়া তৃণমূলকে বাড়তি অক্সিজেন দিতে দিল্লির বিজেপিই NRC ও CAB নামক দু’টি ‘পাশুপতাস্ত্র’ তুলে দিয়েছেন মোদি-শাহ৷ ওনারা তো জানেনই এই অস্ত্র ব্যবহার হবে বিজেপির বিরুদ্ধেই ৷
তৃণমূলের পালে বাতাস লাগার যে ছবি ইদানিং স্পষ্ট হচ্ছে, তার ব্যবহারিক বাতাবরণটা তো মোদিজি-শাহজি-ই করে দিলেন বা দিচ্ছেন৷

বিধানসভা ভোটে দিল্লির বিজেপি এ রাজ্যে ঠিক কী চাইছে, আগে বঙ্গ- বিজেপি বরং তার উত্তর খুঁজে বার করুক৷

Previous articleবন্ধুত্বের উদযাপনে ফিরে দেখা শৈশব
Next articleঅসমে CAB-র প্রতিবাদ আন্দোলনে পুলিশের গুলি, মৃত 3, পরিস্থিতি বেসামাল