টেপ-রেকর্ডার হাতে মুক্তিযোদ্ধা, বিরল সাংবাদিক উপেন তরফদার প্রয়াত

বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তাঁর নামই শোনেননি, চেনা তো দূরের কথা৷

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের তিনিও ছিলেন একজন সৈনিক৷ তাঁর হাত ধরেই এপার বাংলার মানুষ, বিশেষত বাঙালিরা ওতপ্রোতভাবে একাত্ম হয়েছিলেন ওপারের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে৷ একটা টেপ রেকর্ডার হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন ছুটেছেন এপারের সীমান্ত এলাকায়, ওপারের বিধ্বস্ত জনপদে৷ তুলে এনেছেন ঘটনা৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেই সব কথাই প্রতি রাতে প্রচারিত হতো আকাশবাণী-তে, অনুষ্ঠানের নাম ছিলো ‘সংবাদ বিচিত্রা’৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা, প্রখ্যাত মানুষদের সাক্ষাৎকার শ্রোতাদের কাছে নিয়মিত তুলে ধরেছেন। যা প্রেরণা দিতো মুক্তিযোদ্ধাদেরও।


সেদিন যারা ওই ‘সংবাদ বিচিত্রা’ শুনেছেন, তাঁরা আজও জানেন এবং মানেন, কী অসম্ভব প্রভাব ছিলো আকাশবাণীর ওই অনুষ্ঠানের৷ একটি টেপ-রেকর্ডার হাতে নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন তিনি৷ সংবাদ-সৈনিক৷ তাঁর নাম উপেন তরফদার৷

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এপার বাংলার যে তিন “সংবাদ-সৈনিক” ওই যুদ্ধকে বাঙালির হেঁশেলকেও কাঁদিয়েছিলেন, তাঁদের দু’জন, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রনবেশ সেন আগেই প্রয়াত হয়েছেন৷ আর মঙ্গলবার প্রখ্যাত বেতার সাংবাদিক এবং আকাশবাণী কলকাতার ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানের কিংবদন্তী প্রযোজক উপেন তরফদারের জীবনাবসান হলো৷

এদিন রাত ৮টা নাগাদ SSKM হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্র বর্তমান। তাঁর মৃত্যুর খবরে আকাশবাণী, দূরদর্শন-সহ রাজ্যের সংবাদমহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে৷ তিন-চার দশক আগে যখন টেলিভিশন বলে কিছু ছিলোনা, তখন
রেডিও-ই ছিল বাংলার ঘরে-ঘরে খবর আর বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম, তখন আকাশবাণী- কলকাতার যে নামগুলির সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে গিয়েছিলো, প্রয়াত উপেন তরফদার তাঁদেরই একজন।

আকাশবাণীতে টানা চার দশকের চাকরিজীবনে উপেন তরফদারের নানা কর্মকাণ্ড আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। রেডিও-সাংবাদিকতাকে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বস্তরে৷ ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানটি বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তাঁরই মেধা, পরিশ্রম এবং আন্তরিকতায়। তাঁর ২৪ ঘন্টার সঙ্গী একটি ঝোলা ব্যাগে সবসময় থাকতো একটি টেপ রেকর্ডার।
এই উপেন তরফদার-ই ৪০ বছর আগে খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের ফিচার পেজ বা ফিচার-অনুষ্ঠানের মান বেঁধে দিয়েছিলেন৷ শব্দচিত্র বলতে যা বোঝায়, তার যথার্থ দৃষ্টান্ত ছিলো ওই ‘সংবাদ বিচিত্রা’৷ সেই সব দিনে
আকাশবাণীর সংবাদে মানবিক খবর বেছে বেছে তুলে আনাও ছিলো তাঁর আম্তরিকতা এবং পেশাদারিত্বের নিদর্শন।

উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ার বাসিন্দা উপেন তরফদারের জন্ম হয়েছিলো ওপার বাংলায়৷
এখনকার বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের নালিগ্রামে। ১৯৫৪ সালে আকাশবাণীতে চাকরি শুরু করেন৷ সে বছরই আকাশবাণীর ‘স্থানীয় সংবাদ’ বুলেটিনের সূচনা। সেই থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত কলকাতার আকাশবাণীর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। কলকাতা দূরদর্শনে কিছুকাল কাটিয়ে ১৯৯৪ সালে তিনি অবসর নেন।

মুক্তিযুদ্ধের অনন্য “সংবাদ-সৈনিক” হিসেবে উপেন তরফদারকে বিশেষ সম্মান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

Previous articleগঙ্গাসাগরের মাহাত্ম্য, মকরসংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে সাগরসঙ্গমে ফুটফুটে ৩৫ সন্তানের জন্ম
Next articleকুকাজে সুবিধের জন্য অরিন্দমের দলবদল: বিস্ফোরক স্ত্রী