
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাজ্যের বেঁধে দেওয়া বাজেট বক্তৃতার সুরে সংযোজন বা বিয়োজন ঘটিয়ে

শুক্রবার বিধানসভায় সম্ভবত প্রথা ভাঙার পথেই হাঁটবেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়৷ বক্তৃতার খসড়া বদলে রাজ্যপাল কী অথবা কী কী বলবেন তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ধন্দে রাজ্য সরকার। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা কোনও সরকারের কিছু কাজকর্মের সমালোচনা যদি কোনও রাজ্যপাল’ই করেন, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই রাজ্য প্রশাসনের কাছে অবশ্যই অস্বস্তিকর হয়৷


তবে এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে এই প্রথম কোনও সরকার পড়তে চলেছে, এমন নয়৷ এ রাজ্যে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের আমলে তৎকালীন রাজ্যপাল ধর্মবীরের জন্য মন্ত্রিসভা যে ভাষণ লিখেছিলো, সেখানে একটি লাইন ছিলো, “সরকার ভেঙে আমি ভুল করেছি”। সে সময়ে অজয় মুখোপাধ্যায়- জ্যোতি বসুর সরকার ভেঙে প্রফুল্ল ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ করিয়েছিলেন ধর্মবীর। সেই সরকার অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি৷ কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় সেই খোঁচা-টি ছিলো৷ ধর্মবীর কিন্তু তাঁর বক্তৃতায় ওই লাইনটি পড়েননি। কিন্তু বিধানসভায় রেকর্ডে সরকারের লেখা ভাষণটিই নথিভুক্ত আছে, ওই বাক্যটি সহ৷ ওটাই রাজ্যপালের লিখিত ভাষণ হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে আছে।

কিছুদিন আগে কেরল বিধানসভায় এমনই ভিন্নমত দেখা গিয়েছিলো৷ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নিজের অন্যমত উল্লেখ করেই সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণ পাঠ করেছিলেন কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান। তবে,বেনজির হলেও রাজ্যপালের ভাষণে শুধুই ভিন্নমতের ‘ইঙ্গিত’ থাকায় শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক সঙ্কট এড়ানো যায় ওই রাজ্যে৷
রাজ্যপালের লিখিত ভাষণে CAA বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা সংক্রান্ত অংশ রাজনৈতিক কারনেই রেখেছিলো কেরলের বাম সরকার৷



অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তাঁর ভাষণের CAA সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে যাওয়ার আগে কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান স্পষ্টভাবেই বিধানসভায় বলে দেন, ‘‘এই বিষয়ে আমার আপত্তি ছিল। এই বিষয়টি রাজ্য সরকারের নীতি সংক্রান্ত বক্তব্যের অংশ হতে পারে বলে মনে করি না। কিন্তু মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আমাকে এটা পড়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি সহমত নই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ মেনেই আমি এই অনুচ্ছেদ পড়ছি।’’ ওই রাজ্যের পরিষদীয় দফতর অবশ্য রাজ্যপালের মৌখিক ওই মন্তব্য সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিয়েছে, কিন্তু রাজ্যপাল সাংবিধানিক রীতির পুরোপুরি অন্যথা না করেও নিজের আপত্তি প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়ছিলেন৷

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় শুক্রবার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় রাজ্য মন্ত্রিসভার তৈরি ভাষণে কোনও সংযোজন বা বিয়োজন ছাড়াও রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করতে পারেন কেরলের রাজ্যপালের মতো মাঝামাঝি একটা পথ বেছে নিয়ে! যদিও বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় পরে বলতে পারেন, ‘‘রাজ্যপাল ধনকড় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যা বলেছেন, সেটা কার্যবিবরণীতে রাখার কথা নয়। রাজ্যপালের লিখিত বক্তৃতাই কার্যবিবরণীতে থাকবে। সে বাদ যাক, তাহলেও কিন্তু বিধানসভায় দাঁড়িয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সরকার-বিরোধিতার উদ্দেশ্য পূরণ হবে৷

বৃহস্পতিবার শ্রীনিকেতন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল বলেছেন, “রাজ্য সরকারের যেমন রাজ্যপালের বক্তৃতা তৈরি করে দেওয়ার অধিকার আছে, রাজ্যপালেরও তেমনই নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার সাংবিধানিক অধিকারও রয়েছে।” বুধবার ধনখড় প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘‘মন্ত্রিসভার তৈরি করে দেওয়া ভাষণ খতিয়ে দেখে আমার যদি আরও কিছু বলার থাকে, তা আমি বিধিসম্মত ভাবে যুক্ত করব।’’
ধনকড়ের গলায় এ সর সুর চ্যালেঞ্জিং লাগলেও মন্ত্রিসভার তৈরি করে দেওয়া বক্তৃতার বাইরে রাজ্যপাল কতখানি যেতে পারবেন, তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে৷ সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে,”মন্ত্রিসভার অনুমোদিত বক্তৃতার বাইরে যাওয়ার এক্তিয়ার রাজ্যপালের নেই। রাজ্যপালের বক্তৃতা হল সরকারের বক্তব্য। সেখানে রাজ্যপাল নিজস্ব মতামত যুক্ত করতে পারেন না”।

একটি বিষয় অনেকেরই সম্ভবত জানা নেই, (জানা নেই বলেই বোধহয় সরকার পক্ষের একাধিক ‘স্তম্ভ’ রাজ্যপালকে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ বা ‘এক্তিয়ার’ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেই চলেছেন) সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় সেই ১৯৮৯ সালে রাজস্থানের রাজস্থানের ঝুনঝুনু লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ তার আগে তিনি দীর্ঘদিন বিধায়ক ছিলেন৷ এবং সব থেকে বড় কথা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর মন্ত্রিসভায় এই জগদীপ ধনকড় সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন৷ ফলে, সংবিধান বা সংসদীয় গণতন্ত্র অনেকের থেকে ভালোই সম্ভবত তিনি জানেন৷ তিনি জানেন রাজ্যপালের সাংবিধানিক গণ্ডি ঠিক কতখানি৷

তাই, রাজ্য প্যাঁচে পড়তে পারে এমন কিছু অন্তত বিধানসভার অন্দরে দাঁড়িয়ে বলবেন না রাজ্যপাল। তবে তাঁর কথায় রাজ্যকে বিঁধে যে একাধিক টিপ্পনি থাকবেই, তা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায়৷
