Friday, December 26, 2025

হঠাৎ পড়ে পাওয়া এক অন্যরকম গল্প

Date:

Share post:

সকাল ৯.০৮ এর ডাউন নৈহাটি লোকাল। তিন নম্বর কামরার প্রথম দরজা।

আপ ট্রেনটা নৈহাটি স্টেশনে ঢোকামাত্রই হুড়মুড় করে উঠে, অন্তত গোটা পনেরো সিটে রুমাল ব্যাগ চিরুণি লাইটার ফেলে জায়গা রাখা, শুধু নিজের নয় গোটা পরিবারের জন্য। পরিবারই বটে। ভিন্ন পেশার, ভিন্ন আয়ের, ভিন্ন চেহারার, ভিন্ন লিঙ্গের, ভিন্ন ধর্মের যেন গোটা একটা ভারতবর্ষ। তারপর সবাই একসাথে যাওয়া শিয়ালদহ অবধি। সেখান থেকে যে যার নিজ নিজ অফিসের পথে। এ হয়ে গেছে গত দশ বছরের রোজকার সকালের রুটিন। শনিবারে সংখ্যাটা কিছু কম হলেও অন্য পাঁচটা দিন উপস্থিতি মোটামুটি একইরকম থাকে, গড়ে চল্লিশ জন।

ঠিক কবে থেকে এই পরিবারের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি মনে করতে পারিনা। কারণ এই বন্ধন বলে কয়ে একদিনে হয়নি। সকাল দশটা পনেরোর মধ্যে অফিসে পৌঁছানোর তাগিদে এই ট্রেনটা ধরা অবধারিত ছিল। একই কমপার্টমেন্টে রোজ যেতে যেতে ঘোষদা, বোসদা মিত্তিরদা তনুদি জবাদি বলে ডাকতে ডাকতে কবে যে একটা পরিবার হয়ে গেছি খেয়ালই ছিল না। সরোজ ঘোষ ব্যাঙ্ক কর্মী, রথীন সেন ফেয়ারলির রেলের কেরাণি, সুব্রত দত্ত ব্যাঙ্কসাল কোর্টের উকিল থেকে বাবলা, ঘচাই, সন্টু শিয়ালদার হকার, কত পেশার নানান বয়সের মিলনস্থল এই ন’টা আটের ডাউন নৈহাটি লোকালের তিন নম্বর কামরা। সবাই যেন কত কাছের দিনের ওইটকু সময়ের জন্য। চেনা থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে একটা নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠা। না জানিয়ে কেউ কিছুদিন না আসলে, তার খোঁজ নেওয়া। কেউ বিপদে পড়লে তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া, একসাথে পিকনিকে যাওয়া এর ওর বাড়ির বিয়ে পৈতেতে নিমন্ত্রণে অতিথি হয়ে যাওয়া। একটা অটুট পারিবারিক বন্ধন।

আমাদের এই নিত্যযাত্রী সমিতিতে একটি বৃদ্ধ দম্পতিও ছিলেন। এই গল্পের মূখ্য চরিত্র তারাই। জোর্তিময় দত্ত ও অনীতা দত্ত। ওনারা উঠতেন শ্যামনগর থেকে। ষাটোর্দ্ধ দত্তদা পোস্টাল বিভাগে কাজ করতেন, রিটায়ারমেন্টের পরে স্ট্র্যান্ড রোডের কোন একটা প্রাইভেট ফার্মে খাতা দেখেন। অনীতাদি কাজ করেন রেলে, পোস্টিং ফেয়ারলিতে। দত্তদা সুবক্তা, মিষ্টভাষী। নীচু গলায় মজার মজার কথা বলেন, খুব শান্ত প্রকৃতির। বরঞ্চ দিদি একদম উল্টো। বেশ হইচই করেন, মিষ্টি মিষ্টি করে এর ওর পিছনে লাগেন, মাঝে মাঝে ভাল ভাল গান শোনান। দিদির খুব ভাল গানের গলা।কিন্তু একটাই ব্যাপার যা সবাইকে খুব ভাবায়, তা হল, এই দম্পতিকে ট্রেনের এই সময়টুকে ছাড়া আর কোনও সময় পাওয়া যায় না। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কোনও বাড়ির নিমন্ত্রণ হোক বা পিকনিকে যান না। কোনও না কোনও একটা অজুহাতে ওরা নিজেদের সরিয়ে নেন। পরিবর্তে দত্তদা ফাইন দেন, সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে। তাতেই যেন সাত খুন মাফ।

আজ অনীতাদির অফিস জীবনের শেষদিন। ওনার রিটায়ারমেন্ট। আগামিকাল থেকে উনি আর আসবেন না। সবার মন খুব খারাপ। একজন নিকট আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথার মত বুকে বিঁধছে তার কাল থেকে না আসার বাস্তব খবরটা। আমাদের এই পরিবারের কেউ অবসর নিলে তাঁকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়। দিদির ক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। চাঁদা তুলে দিদির পছন্দের বটুয়া ব্যাগ, ফুল, মিষ্টি আনা হয়েছে। শ্যামনগরে ওনারা ট্রেনে উঠতেই প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো ভুটাই আর জগা সিট ছেড়ে বসতে দিল। শুরু হল সভার কাজ।

সবার আগে মিষ্টিমুখ। তারপর একে একে প্রত্যেককে বলতে হল দিদির সম্বন্ধে। আমিও বললাম। দিদি সেরকম কিছু বলতে পারলেন না। তার গলা ভারি হয়ে এল। সবশেষে বলার ভার পড়ল শ্রীমান জোর্তিময় দত্ত দার।

আমার স্নেহের বন্ধুরা, খুব ভাল লাগছে তোমাদের আয়োজনে ডাকা এই অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে। আজ অনীতার সন্মানে যে অনুষ্ঠান তোমরা করছ, তা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। আজ সত্যিই খুব মন খারাপের দিন, কাল থেকে ও আর এইভাবে সবার সাথে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হইহই করতে করতে অফিসে যাবে না। কাল থেকে কেউ আর জগা-ভুটাই-মনার পিছনে লাগবেনা, গান শোনাবে না। সবাই মিস করবে অনীতাকে।

সবাই মাথা নীচু করে দত্ত’দার কথা একমনে শুনছে। ওনার গলার আওয়াজের মাদকতায় সবাই বুঁদ হয়ে আছে। ওকে কাল থেকে আমিও খুব মিস করব।

চমকে সবাই এ ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, “মানে..?”
উনি সে কথার উত্তর না দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে চললেন..শুধু অনীতাকে নয়, তোমাদের সবাইকে খুব মিস করব। কাল থেকে আমিও আর আসব না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা তোমাদের এই প্রথমবার জানচ্ছি, অনীতা আমার স্ত্রী নয়, প্রেমিকাও নয়। বন্ধু বলতে যা বোঝায়, তাও হয়ত নয়। কারণ একে অপরের বিপদে আপদে, ভালোয় মন্দয় আমরা একে অপরের পাশে যদি না থাকতে পারি, তাহলে তাকে কি আর বন্ধু বলা যায়.? সবার মনে তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, সম্পর্কটা আসলে কি? উত্তর হবে কিছুই না। একদম নিত্য সহযাত্রী। ঠিক তোমাদের সাথে যেমন দেখা হয় রোজ সকালের এই এক ঘন্টা, ওর সাথেও তাই হয়। কোনওদিন কথা হয়, কোনওদিন হয় না। তোমরা পাশাপাশি বসতে দিলে কোনদিন গায়ে গায়ে একটু ছোঁয়া লাগে। তার বেশি কিছু নয়। বছর পনেরো আগে তোমাদের মত এইরকম একটি গ্রুপে যাতায়াত করতে করতে আমাদের প্রথম দেখা হয়। তখন ওর পঁয়তাল্লিশ আর আমি পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বেশ কিছুদিন পর থেকেই বুঝতে পারি, ওর সাথে দেখা করার এক তীব্র আকুতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। গত পনেরো বছর আমরা একসাথে যাতায়াত করেছি। তবে ওই শিয়ালদহ স্টেশন অবধি। আমি পাঁচ বছর আগে অবসর নিয়েছি চাকরি থেকে, দিনটা ছিল শনিবার। তোমরা ঘটা করে ফেয়ারওয়েল দিয়েছিলে। কিন্তু পরের সোমবারেই আবার এই ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তোমরা জিজ্ঞেস করাতে, প্রাইভেট ফার্মের চাকরির, মিথ্যে গল্প বলেছি। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে কি করা যায় ভেবেছি। তারপর কিছু না পেয়ে ফিরতি ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরেছি। আর এই রুটিন কাজ করে গেছি গত পাঁচ বছর। তোমাদের মত আমিও জানি অনীতা বিবাহিতা, স্বামী আর দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। ব্যাস আর কিছু অতিরিক্ত কখনোই জানতে চাইনি। জানতে চাইনি সে সুখী কিনা। সে আমাকে ভালবাসে কিনা। তাকে স্পর্শ করা দূর, কোনওদিন হাতটাও ছুঁয়ে দেখিনি, তা কতটা ঠান্ডা বা কতটা গরম। কোনও চাহিদা নেই, কোনও যৌনতা নেই, কোন লালসা নেই, শুধু একটু চোখের দেখা। অনীতা প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিলেও পরে আমার এই পাগলামো মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য ওর বরাদ্দ ছিল এই অফিস যাওয়ার সময়টুকু।
দুটো মন কারো ক্ষতি চায়নি। চেয়েছিল বাঁধা সময়ের একটু সঙ্গ। আর তার জন্য শীত-গ্রীষ্ম-বরষা সব বাধাকে উপেক্ষা করে ট্রেন ধরতে আসা। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস যে করেনি, তা নয়। করেছে। মিথ্যে বলেছি। বলেছি সকালের দু’ঘন্টার কাজ।

দত্তদা কিছুক্ষণ থেমে দম নিলেন। তারপর ধরা গলায় আবার শুরু করলেন, কাল থেকে এই ব্যস্ততা আর থাকবে না। থাকবে না সকালে উঠেই ট্রেন ধরার তাড়া। তোমাদের সাথে কাটাতে পারা মূল্যবান মূহুর্ত। সব কিছু থেকে ছুটি। আমি যেন এই প্রথম অবসর নিলাম। কাল থেকে তোমাদের সাথে আর দেখা হবে না। সবাই ভাল থেকো সুস্থ থেকো। অনীতার বাকি জীবন ভাল কাটুক এই কামনা করি। যেখানেই থাকো যেভাবেই থাকো হেসে খেলে কাটিও। তোমরা সবাই ভাল থেকো।

আমি আমার তরফ থেকে একটা ছোট্ট উপহার অনীতাকে দিতে চাই। অনীতাদি উঠে দাঁড়িয়ে দত্তদার হাত থেকে পাওয়া উপহারের মোড়ক খুলে ফেলতেই, বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট পকেট ডায়েরি। পাতা উলটে দেখা গেল, দত্তদার অনীতাদির সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত কি রঙের শাড়িতে কেমন লাগছিল, লেখা আছে। ডায়েরি টা শেষ হয়েছে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে…
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা……..

অনীতাদি সবার জন্যই রিটার্ন গিফট নিয়ে এসেছিলেন। কারোর জন্য পেন, কারোর জন্য গ্যাস লাইটার। দত্তদার হাতেও একটা ছোট্ট গিফট প্যাক তুলে দিলেন। খুলে বার হল, একটা ডিজিটাল ঘড়ি। এলার্ম দেওয়া। সময় ৯.০৮। এলার্মে সেট করা গান ভেসে উঠল…
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে ম’ম।
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমায়
নিশীথিনী সম।…

সারা কমপার্টমেনট বাকরুদ্ধ। পাশের লোকের নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। কারো আর কথা বলার ক্ষমতা নেই।

ট্রেন খুব ধীরে ধীরে শিয়ালদহ স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্ম ছুঁল। ঘড়িতে দশটা বেজে দু মিনিট।

spot_img

Related articles

রাতের অন্ধকারে সরল আসবাব! ১০ সার্কুলার রোডের বাংলো ছাড়ছে লালু-পরিবার

এবার ক্ষমতায় এসেই লালু প্রসাদ যাদবের (Lalu Prasad Yadav) পরিবারকে ১০ সার্কুলার রোডের বাংলো থেকে তোড়জোড় শুরু করেছিলেন...

ফের টরেন্টোতে খুন ভারতীয় ছাত্র! বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই গুলি

হিমাংশি খুরানার মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই ফের টরেন্টোতে (Toronto) খুন আরেক ভারতীয় যুবক। নিহত পড়ুয়ার নাম শিবাংঙ্ক...

বৈভবের মুকুটে নতুন পালক, রাষ্ট্রপতির থেকে পেলেন সর্বোচ্চ সম্মান

তরুণ ক্রিকেটার বৈভব সূর্যবংশীর (vaibhav Suryavanshi)মুকুটে এবার জুড়ল নতুন পালক, নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু টিনএজার ক্রিকেটার...

ফের মমতার দেখানো পথে ডবল ইঞ্জিন সরকার! ‘মা ক্যান্টিনে‘র আদলে দিল্লিতে ‘অটল ক্যান্টিন’

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) একের পর এক জনমুখী প্রকল্প নকল করে প্রচারের আলোয় থাকতে চাইছে বিজেপি...