
রাজ্যসভার পঞ্চম আসনের প্রার্থী নিয়ে সিপিএমের টালবাহানার প্রভাব পড়তে পারে পুরভোটে বাম-কং জোটে৷ শুধু প্রভাব পড়াই নয়, সঙ্কটে পড়তে পারে এই জোটের অস্তিত্বও৷ সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়ার পরিবর্তে বঙ্গ-কংগ্রেসকে একক শক্তিতে ভোটে যেতে বলতে পারে হাই-কম্যাণ্ড৷

রাজ্যসভা ভোটে বাংলার পঞ্চম আসনের যে ছবি আপাতত স্পষ্ট, তাতে দিল্লি-সিপিএম এবারও ইয়েচুরির নামে সিল-মোহর সম্ভবত দিচ্ছে না৷ ওদিকে কংগ্রেস হাই-কম্যাণ্ড সলতে পাকাচ্ছে ২০১৮-র মতো এবারও তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে সংসদে পাঠানোর৷ তেমন কাণ্ড ঘটলে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বামেদের হাত ধরে পুরভোটের মঞ্চে কংগ্রেস দাঁড়ালে, তা হবে নিতান্তই এক ‘স্ট্যাণ্ড-আপ কমেডি’৷
পঞ্চম আসনের প্রার্থী হিসেবে আলিমুদ্দিনের তরফে অনেক আগেই সীতারাম ইয়েচুরির নাম প্রস্তাব আকারে পলিটব্যুরোয় পাঠানো হয়েছে৷ মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলেও দিল্লি থেকে এখনও চূড়ান্তভাবে কিছুই জানানো হয়নি বঙ্গ-সিপিএমকে৷ ফলে ওই পঞ্চম আসনে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে বামেরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলতে পারছে না৷

কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সীতারাম ইয়েচুরিকে রাজ্যসভায় পাঠাতে দিল্লি-সিপিএমের যদি সমস্যা থাকে, তাহলে তো বাম ও কংগ্রেসের জোট অটুট রাখতে দু’পক্ষের সমর্থনপুষ্ট কোনও ‘নিরপেক্ষ’ প্রার্থী খুঁজে বার করা অথবা কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করা নিয়েও কোনও আলোচনা এতদিনে দরকার ছিলো৷ তেমন কিছুও তো হয়নি৷ তাহলে এই জোটের ভবিষ্যত কী ?

সিপিএমের ঠিক এই ধরনের ‘পরিকল্পিত’ সিদ্ধান্তহীনতায় ২০১৮-র মতো এবারও শেষমূহুর্ত পর্যন্ত ঝুলেই থাকতে হচ্ছে কংগ্রেসকে৷ সেবার তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ঘোষনা করেছিলেন, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি রাজ্যসভায় প্রার্থী হলে কংগ্রেস সমর্থন করবে৷ সেবার একেবারে শেষমুহুর্তে দিল্লি-সিপিএম জানায়, দলের নিজস্ব কিছু বিধিতে আটকে যাচ্ছে ইয়েচুরির প্রার্থী হওয়া৷ তড়িঘড়ি আসরে নামতে হয় সোনিয়া গান্ধীকে৷ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন তিনি এবং কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভিকে তৃণমূলের সমর্থনে রাজ্যসভায় পাঠান৷ এবারও কংগ্রেসের তরফে ঢের আগেই সিপিএমকে জানানো হয়, ইয়েচুরি প্রার্থী হলে এবারও কংগ্রেস সমর্থনে তৈরি৷ তবে শুধুমাত্র ইয়েচুরিকেই সমর্থন করবে, ওই দলের অন্য প্রার্থীকে নয়৷ আর দিল্লির সিপিএম সেই একই প্রার্থীর নাম নিয়ে, সেই ২০১৮-র কায়দাতে একইভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে কংগ্রেসকে৷ পরিস্থিতি এখন এমনই, যেন সিপিএম সমর্থন চাইছেনা, অথচ কংগ্রেস জোর করে সিপিএমকে সমর্থন করতে মরিয়া৷

এই পরিস্থিতিতে বঙ্গ-সিপিএম এবং প্রদেশ কংগ্রেস,দুই শিবিরেই অন্য এক আশঙ্কা গোকুলে বাড়ছে৷ দিল্লি-সিপিএমের এই গড়িমসি এবার কিছুতেই সহ্য করা হবে না বলে ইতিমধ্যেই কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ড তথা সোনিয়া গান্ধী জানিয়ে দিয়েছেন৷ কংগ্রেস-সুপ্রিমো সোনিয়া গান্ধী দলের অন্যতম নেতা আহমেদ প্যাটেলকে বলেছেন, পরিস্থিতি অনুসারে এবারও দলের কোনও প্রার্থীর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে তৃণমূলের সমর্থন চাইবার জন্য তৈরি থাকুন৷ তৈরি আছেন আহমেদ প্যাটেলও৷

এইখানেই ‘আতঙ্কিত’ রাজ্যের কং ও বাম নেতারা৷ দিল্লি- সিপিএমের পরিকল্পিত খেয়ালখুশিতে এবারও যদি ইয়েচুরির নামে সবুজ সংকেত না মেলে, তাহলে সোনিয়া গান্ধী এবারও কথা বলবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং এবারও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন চাইবেন৷ তখনই ভয়ঙ্কর সমস্যা তৈরি হবে, অস্তিত্বের সংকটে পড়বে পুরভোটে বাম-কং জোট৷
পুরভোটের একদম মুখে দাঁড়িয়ে সিপিএমের কথা না রাখার কারনে রাজ্যসভার নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসকে সমর্থন করবে তৃণমূল, কংগ্রেসের প্রার্থীকে রাজ্যসভায় পাঠাবে তৃণমূল, আর পুরভোটে সেই বঙ্গ-কংগ্রেস আর সিপিএম একযোগে তৃণমূলকে হারাতে মাঠে নামবে, এটা হয়না৷ তৃণমূল এটা মানবে কেন? আর তবুও তেমন হলে এই জোটের ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছুই থাকবে না৷ কংগ্রেসের ভোটাররা সিপিএমের বারংবার একই নাটকের কারনে কেন তাদের ভোট দেবেন ? সাধারন মানুষ কোন কংগ্রেসকে বিশ্বাস করবেন? একটা কংগ্রেস তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে রাজ্যসভায় নিজেদের সাংসদ বাড়াচ্ছে, আর একটা কংগ্রেস, সিপিএমের হাত ধরে তৃণমূলকে হারাতে নেমেছে৷ কোন কংগ্রেস সমর্থনযোগ্য? বাংলায় কংগ্রেস কোন নীতিতে চালিত হচ্ছে, এ প্রশ্ন বড়ভাবে সামনে আসবে ৷

ইয়েচুরি-ইস্যুতে দু’পক্ষের বিশ্বাসে ফাটল ধরলে পুরভোট এবং বিধানসভা ভোটে গোটা জোট-প্রক্রিয়াই বানচাল হতে পারে বলে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের আশঙ্কা।
যে জোটের জোরে এ রাজ্য থেকে রাজ্যসভার পঞ্চম আসনটি পেতে চাইছে বাম ও কংগ্রেস, সেই জোটের শর্ত যদি এবারও সিপিএম না মানে,
তাহলে কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ড বঙ্গ-কংগ্রেসকে ‘একলা চলো রে’ নির্দেশ দিতে পারে৷ আবার তৃণমূলও ঠিক এই একই শর্তে কংগ্রেসকে সমর্থনের কথা বলতে পারে৷

ফলে, রাজ্যসভার পঞ্চম আসনের প্রার্থী নিয়ে সিপিএমের ভূমিকায় নিশ্চিতভাবেই সঙ্কটে বাংলার কং-বাম জোট৷ দিল্লির সিপিএম কংগ্রেসকে কার্যত বাধ্য করছে তৃণমূলের সমর্থন নিতে৷ আর বঙ্গ-সিপিএম সেই কংগ্রেসকে সঙ্গী করেই পুরসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে হারাতে জোট করছে ! এই হাস্যকর স্ক্রিপ্ট নিয়ে বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে ফের অবতীর্ণ হয়েছে সিপিএম৷

জোড়াতালির এই রাজনীতি আঁকড়ে ধরে থাকলে পুরভোট অথবা বিধানসভার ভোটের পর বঙ্গ- সিপিএমের হাল যে বাম-শরিক বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস অথবা আরসিপিআইয়ের থেকেও করুন হবে, আলিমুদ্দিন কি তা বুঝতে পারছে ?
