নভেল করোনা ভাইরাস, ভারতের ভবিষ্যৎ কি?

কৌশিক পাল

নভেল করোনাভাইরাস অর্থাৎ কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে দশ লাখ পেরোল, মৃতের সংখ্যাও পঞ্চাশ হাজার পেরিয়েছে৷ বিশ্বের অধিকাংশ বড় শহরই লকডাউন পালন করছে। এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। মনে হয় এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কিছু ভাল খবর সবাইকে দেওয়া দরকার।

যদিও আমি ডাক্তার, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, মহামারী বিশারদ কিংবা ভাইরলজিস্ট নই, শুধুমাত্র কিছু প্রাপ্ত তথ্য এবং সংখ্যার ভিত্তিতেই এই আলোচনার অবতারণা।

চিনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলেও বর্তমানে এর কম্পনের মূল উপকেন্দ্র ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২ এপ্রিল রাত ১০টা, গ্রীণিচ সময় অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা ১০,০৯,৭৭৬ জন, এর মধ্যে মৃত ৫২,৮৫৬ জন, সুস্থ হয়েছেন ২,১১,৯০৭ জন, ৩৭৭১২ জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। শতাংশের হিসেবে ২১ শতাংশ সংক্রমণ মুক্ত, ৫ শতাংশ মৃত, ও প্রায় ৪ শতাংশ আক্রান্তের অবস্থা সঙ্কটজনক। ২০৪ টি দেশ ও দুটি আন্তর্জাতিক জলযানে এই ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়েছে।

যদি আমরা এই সংক্রমণের একটা রাষ্ট্রগত আলাদা আলাদা তালিকা তৈরি, করি তাহলে একটা মনোযোগ দেবার মত বিষয় সামনে আসে।

তালিকায় আছে ১২টি দেশ, আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, চিন, ফ্রান্স, ইরান, ইউকে, সুইজারল্যান্ড, তুর্কি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস৷ সব দেশ মিলিয়ে মোট রোগীর সংখ্যা ৮,৪৪,৫১১ অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ (প্রায়) আক্রান্ত রয়েছে আমেরিকা, ইউরোপের ৯ টি দেশ, ও ইরান চীন মিলিয়ে। চিনে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা খুব একটা বাড়ছেনা। বাকি ১৯২ টি দেশ ও দুটি জলযান মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা এখনো অবধি ১৫ শতাংশ বা মাত্র দেড় লাখ।

চিন বাদ দিলে, বাকি ১১টি দেশের জনসংখ্যার যোগ ফল ৮৩ কোটি। এই ৮৩ কোটির মধ্যে প্রায় ৮ লাখ লোক সংক্রামিত হয়েছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ, তাই ধরে নেওয়া যায় বিশ্বের বাকি অংশে এই জায়গা গুলি থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। বাকি পৃথিবীতে অর্থাৎ লাতিন আমেরিকা, উপমহাদেশ, আফ্রিকা ইত্যাদি মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশো কোটি এবং এদের মধ্যে রয়েছেন লাখ দেড়েক রোগী।

মোট মৃত মানুষের সংখ্যা ৫২,৮৫৬ জনের ৯৩ শতাংশ ওই ১২টি দেশেই পাবেন (৪৯২০৮ জন)। বাকি ৭ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে বাকি দেশ গুলিতে অর্থাৎ ৫৫০ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট ১৯২ টি দেশে মৃত্যুর মোট সংখ্যা ৩৬৪৮ জন, বা প্রতি দেশ পিছু গড়ে ১৯ জন, বা প্রতি এক কোটি জনসংখ্যায় মৃত্যু ৬.৬৩ জন (প্রায়)। এই দেশ গুলিতে প্রতি দেশ পিছু গড় রোগী ৮৬১ জন, বা প্রতি এক কোটি জনসংখ্যায় রোগী ৩০০ জন।

কেন এই দেশ গুলিতে সংক্রমণের এবং এইজনিত মৃত্যুর সম্ভাবনা কম বলে ধরে নিচ্ছি? কারণ বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বয়সের হারের সাথে সংক্রমণের ভয়াবহতার হার এর একটি সংযোগ রয়েছে। ‘মেডিয়ান এজ’ নামে একটি ইন্ডিকেটর রয়েছে যেটি দেশের মোট জনসংখ্যাকে বয়েস অনুপাতে ২টি সমান বিভাজন করে অর্থাৎ এর একদিকে থাকে তরুণেরা ও অপর দিকে থাকে বেশি বয়স্কজনেরা। ওপরে বলা ১২টি দেশের মেডিয়ান এজ ইন্ডিকেটরের দিকে একবার দেখা যাক-

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৮.৬ বছর
ইতালি ৪৫.৪ বছর
স্পেন ৪৪.৯ বছর
জার্মানি ৪৭.৪ বছর
চিন ৩৮.৪ বছর
ফ্রান্স ৪১.২ বছর
ইরান ৩১.৩ বছর
ইউকে ৪০.৫ বছর
সুইজারল্যান্ড ৪২.২ বছর
তুর্কি ৩১.৫ বছর
নেদারল্যান্ডস ৪৩.৩ বছর
বেলজিয়াম ৩১ বছর।

এই তালিকার সাথে দেশগত সংক্রমণের হার ও মৃতের তালিকা পাশাপাশি রাখলে বোঝা যাবে। যেমন ইরান, তুর্কি, ও বেলজিয়ামে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় সংক্রমণের সংখ্যা যেখানে যথাক্রমে ৬০০, ২০০, ও ৮৫৮ জন। সেখানেই ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ডে সেই একই সংক্রমণের হার প্রতি দশলক্ষে যথাক্রমে ১৯০৬, ২৩৯৭, ও ২১৭৫ জন। অর্থাৎ প্রায় তিন থেকে দশগুণ বেশি। প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় মৃতের হার তুর্কিতে মাত্র ৪ জন এবং ইতালিতে ২৩০ ও স্পেনে ২২১ জন। আনন্দের কথা ভারতের মেডিয়ান এজ মাত্র ২৮.৪ বছর।

ইউরোপেও নতুন সংক্রমণের হারের অনুপাতে মৃত্যুর হার আশাদায়ক ভাবে কমেছে। ১৬ মার্চ ক্লোজড কেস বেসিস-এ (যে সমস্ত রোগীর ফলাফল এসেছে অর্থাৎ সুস্থতা কিংবা মৃত্যু) ফ্রান্সে মৃত্যুর হার ছিল ৯২ শতাংশ, ১ এপ্রিল হয়েছে ২৭ শতাংশ। একই পরিস্থিতিতে স্পেনে ৬ মার্চ মৃত্যুর হার ছিল ৫৭ শতাংশ, ১ এপ্রিল কমে হয়েছে ২৯.৩ শতাংশ। ইতালিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হার ছিল ৮৭.৫ শতাংশ যা ১ এপ্রিল হয়েছে ৪৩.৮৫ শতাংশ। রোগের সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে তার মৃত্যুর হার কমতে থাকা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এবং যেহেতু ২০৩ টি দেশে আমরা এই বিশ্বমারির প্রকোপ চিহ্নিত করে ফেলেছি, এবং অধিকাংশ দেশেই জনসংযোগ কমানোর জন্য ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে আমরা খুব তাড়াতাড়ি একটি সম্পৃক্ততার মধ্যে প্রবেশ করব বলে আশা করছি।

বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডক্টর এন শিবদাসান স্ক্রোল ডট ইন ম্যাগাজিনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এক) ভারতের জনসংখ্যার কিয়দংশই (৬.৩ শতাংশ) প্রবীণ বয়স্ক আর দুই) ভারতের আবহাওয়া, পরিবেশ, এখানকার লোকের জিন বৈশিষ্ট্য এই ভাইরাস ছড়ানোর অনুকূল নয়। এবং শুধুমাত্র কিছু গাণিতিক সিমুলেশন ব্যবহার করে ভারতে কোটি কোটি লোকের মধ্যে রোগ ছড়ানোর ধারণার এখনও কোন বাস্তব ভিত্তি নেই৷ এনারা আসলে ভয়ের দোকান খুলে বসেছেন।

দেখুন, এই প্রজন্মের ইতিহাসে এইরকম পৃথিবীব্যাপী সংক্রমণের স্মৃতি নেই। তাই সবাইকে অনুরোধ এটুকুই, যে পাশের লোকটিকে মনোবল দিন, নিজেরও মনোবল বাড়ান। আমি বারংবার দায়িত্ব নিয়ে বলছি এত ভেঙে পড়বেন না, সুদিন আসছে। সিনেমা দেখুন, গল্প করুন, আগামীর মানুষদের এই অভিজ্ঞতার গল্প বলার জন্য প্রস্তুত হন। আপনার প্রতিবেশীটির ঘরে হাঁড়ি চাপল কিনা খোঁজ নিন, না চাপলে পারলে সাহায্য করুন। সরকারি উপদেশ অতি অবশ্যই মেনে চলুন। রোগের কোনরকম উপসর্গ দেখাদিলে সোজা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন।

পৃথিবীতে চিরদিন কিছুই নয়, কেউই নয়।
জীবন একটাই৷

তথ্য কৃতজ্ঞতা – ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো এবং স্ক্রোল ডট ইন।

Previous articleEXCLUSIVE : করোনার ভ্যাকসিন তৈরি? কী বলছেন ডাঃ কুণাল সরকার?
Next articleএকনজরে করোনা বিশ্ব-মহামারীর পরিসংখ্যান