বোনের স্মৃতিতে তৈরি হাসপাতাল কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের জন্য দিয়ে দিলেন ট্যাক্সি চালক সইদুল

পেশায় ট্যাক্সি চালক মহম্মদ সইদুল লস্কর। বোনের স্মৃতিতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক বিরাট হাসপাতাল। যেখানে বিনা পয়সায় গ্রামের গরিব মানুষের চিকিৎসা হয়। এখন সইদুলের সেই হাসপাতাল আরও মহৎ কাজে ব্যবহৃত হবে। করোনা আক্রান্তদের জন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাসপাতাল এবার কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হতে চলেছে। যেখানে ৪০ থেকে ৫০ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত মানুষের চিকিৎসা হওয়ার মতো ব্যবস্থা করা হবে।

রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় বিডিও মহম্মদ মোশারফ হোসেন এসে গোটা হাসপাতাল ঘুরে দেখে গিয়েছেন। বিডিও জানিয়েছেন, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হওয়ার জন্য একেবারে আদর্শ এই হাসপাতাল। দূষণমুক্ত এমন পরিবেশে রোগী তো এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য দফতরের কাছে তিনি রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই সইদুলের হাসপাতাল কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হতে চলেছে।

করোনা মোকাবিলায় লড়াইয়ে সামিল হতে পেরে তাঁর খুব ভালো লাগছে বলেও জানালেন ট্যাক্সি চালক সইদুল। এই সঙ্কটে মানুষের কাজে আসতে পারে খুশি সইদুলের সহধর্মিনীও। নিজেদের হাসপাতালের মধ্যেই একটা ছোট্ট ঘরে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে থাকেন সইদুল। আপাতত বিডিও-এর পক্ষ থেকে সইদুলের অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বর্ষবরণের রাত। গোটা বিশ্বের মতো নতুন বছরকে বরণ করতে মেতে উঠেছিল তিলোত্তমা কলকাতা। আলো ঝলমল সেই উৎসবমুখর রাতের অন্যদিকে ছিল এক অন্ধকার অধ্যায়। এক দাদার মুমূর্ষ বোনকে বাঁচিয়ে তোলার লড়াই। ট্যাক্সির স্টিয়ারিং ধরে অসুস্থ বোনকে পিছনের সিটে শুইয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়। শেষরক্ষা হয়নি। নতুন বছরের ভোরের সূর্য ওঠার আগেই অসহায় দাদা সইদুলের চোখের সামনে অকালে চিরঘুমে চলে যেতে হয়েছিল একমাত্র বোন মারুফকে।

ট্যাক্সি চালক সইদুলের চোখের জলে শুরু হয়েছিল নতুন বছর। আর ঝাপসা চোখে সেদিন বোনহারা ট্যাক্সি চালক দাদার সংকল্প ছিল, আর কোনও বোনকে যেন এভাবে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে না হয়। সেই সংকল্প থেকেই জন্ম হয়েছিল জেদের। একটি হাসপাতাল তৈরির জেদ। যেখানে নিখরচায় চিকিৎসা হবে গরিব মানুষের। যেখানে কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। কিন্তু একজন ট্যাক্সি চালকের কাছে এ তো এক দুঃসাহসিক স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। তৈরি হয়েছে হাসপাতাল। শুরু হয়েছে চিকিৎসা।

হ্যাঁ, গল্প মনে হলেও সত্যি। বোনহারা সাইদুল ট্যাক্সি চালাতে চালাতেই বানিয়ে ফেলেছেন আস্ত একটা হাসপাতাল। মারুফা মেমোরিয়াল হাসপাতাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বারুইপুর থানার অন্তর্গত সীতাকুন্ডুর পুঁড়ি গ্রামে সুসজ্জিত তিনতলা এক হাসপাতাল। সবুজে ঘেরা গ্রামের মাঝে স্বপ্নের হাসপাতাল।

কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো? সাইদুল ২০০৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা শহরের বুকে তাঁর ট্যাক্সিতে ওঠা প্রতিটি যাত্রীকে যাত্রাপথে জীবনের কাহিনি শোনাতেন। সাহায্য চাইতেন। কেউ হাসতেন। কেউ পাগল বলতেন। আবার অনেকে সাহায্যও করতেন। আর সেই যাত্রীদের সেই দান কিংবা অনুদান ১০, ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২, ৩, ৫ হাজার টাকাও হয়েছে। আর এভাবেই বিন্দু বিন্দু জলকনায় গড়ে উঠেছে মারুফা মেমোরিয়াল হাসপাতাল।

হাসপাতাল তৈরির জন্য আরও অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে সইদুলকে। নিজের সঞ্চিত অর্থ, স্ত্রীর গয়না, সামান্য কিছু জমি ও নিজের ট্যাক্সি বিক্রি করেও অর্থ সংগ্রহ করেছেন সইদুল।

অবশেষে তাঁর স্বপ্নের হাসপাতাল মানবজাতির এমন সেবায় লাগবে, সেটা ভেবেই ভালো লাগছে তাঁর। আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রাণ তহবিলে দিয়েছেন ৫০১১ টাকা। এবার হাসপাতালও তুলে দিলেন ট্যাক্সি চালক সইদুল।

প্রসঙ্গত, বারুইপুরের বিডিও মহম্মদ মোশারফ হোসেন এদিনই তাঁকে ফোন করে হাসপাতাল দেখতে আসার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। ঠিক তার ঘন্টাখানেক আগেই এখন বিশ্ববাংলা সংবাদের ফেসবুক লাইভে এসে সইদুল রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করেন, তাঁর এই হাসপাতালকে করোনা আক্রান্তদের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার যদি করা হয়, তাহলে মানুষের সেবায় তিনি তা ছেড়ে দিতে চান। আর সেই সংবাদ সম্প্রচার হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন প্রতিনিধিকে নিয়ে স্বয়ং সইদুলের হাসপাতালে চলে আসেন বিডিও।

Previous articleলকডাউনে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মানসিকভাবে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গির পরামর্শ কামাল স্যারের
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ