সংস্কৃতের এক বিরল শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের অঞ্জলি

চার দশক আগের কথা।

সংস্কৃত পড়াতে আসা এক শিক্ষক মুগ্ধ করেছিলেন ছাত্রদের।
স্কটিশ চার্চ স্কুলের সেই প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ডঃ সিদ্ধেশ্বর সাঁইকে নিয়ে এক প্রাক্তন ছাত্রের শ্রদ্ধার্ঘ্যের কলম।

সাঁই-বন্দনা
——————————————————————
পার্থপ্রতিম পাঠক

সপ্তম শ্রেণী । নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পাঠ্যসূচিতে যোগ হয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন এক বিষয় – সংস্কৃত (দেবনাগরী) । ঝকঝকে নতুন দু’টি পাঠ্যবই । একটি ‘বর্ণপরিচয়’ অনুরূপ অজ্ঞাত ভাষায় মুদ্রিত এক পাঠ্যপুস্তক । সঙ্গে ‘সুক্তিরত্নাবলী’ নামক শ্লোক-সংকলিত এক আনুষঙ্গিক পাঠ্য, যার হরফটি সুপরিচিত বাংলা হলেও যুক্তাক্ষর, সন্ধিবদ্ধ পদ, অনুপ্রাস ও অনুস্বর-বিসর্গের ঘনঘটায় আমার কাছে উচ্চারণাতীত ও দুর্বোধ্য । বাহাদুরি প্রদর্শন করতে উচ্চারণের চেষ্টা করলে দেবভাষা মুহূর্তে আমার মুখে প্রেতভাষায় রূপান্তরিত হয়ে উঠতো । এহেন এক নব্যভাষা শিক্ষাদানের মহান ব্রতে নিযুক্ত হয়ে ক্লাসে এসেছিলেন এক নবীন শিক্ষক । ভাঙা চোয়াল, দেহাতি ধুতি-চাদর, পৈতে, টিকি ও বেতধারী তথাকথিত টোলপণ্ডিতের চিরাচরিত ভাবমূর্তিটি ভেঙে গিয়ে দেখলাম স্বাস্থ্যবান, গৌরবর্ণ, শার্ট-ট্রাউজার পরিহিত এক সৌম্যদর্শন রূপ । হম্বিতম্বি বিহীন চলন, ধীরস্থির বাক্যালাপ ও ছাত্রদের প্রতি সস্নেহ ‘তুমি’ সম্বোধন । প্রথম দেখাতেই মনেমনে এক সম্ভ্রম জেগেছিল তাঁর প্রতি ।

“ছেলেরা, দেখি কে দিতে পারে এই ধাঁধার উত্তর ?” বেশ অবাক লাগলো । প্রথম দিনের ক্লাসে এসেই ধাঁধার চ্যালেঞ্জ ! উদগ্রীব হয়ে উঠলাম ধাঁধা শোনার জন্য । “এমন কি জিনিস আছে, যা দান করলে বেড়ে যায় আর সঞ্চয় করলে নষ্ট হয় ?” মাথা চুলকে, গালে হাত দিয়ে, দাঁতে নখ কেটে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুর কথা ভেবে চলেছি । ক্লাসে কয়েকটা হাত উঠলো । ‘জল’ সঞ্চয় করলে বাষ্পীভূত হয়ে কিছুটা কমে বটে, কিন্তু দান করে বাড়ানোর নজির তো পি সি সরকার ছাড়া আর কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে জানি না । মাথা চুলকে একজন আবিষ্কার করল ‘চুল’ । ন্যাড়া হয়ে দান করলে আবার বাড়ে বটে, কিন্তু অযত্নে সঞ্চয় করলেও টাক যে পড়বেই, সে ব্যাপারে তো নিশ্চিত হওয়া যায় না । অপার্থিব কোনও জিনিস এর উত্তর হতে পারে কিনা, মরিয়া হয়ে যখন ভাবার চেষ্টা করছি, দরাজ গলায়, মুগ্ধ করা উচ্চারণে স্যার বলে উঠলেন :
“অপূর্ব কোহপি ভাণ্ডারস্তব ভারতী দৃশ্যতে ।
ব্যয়তাে বৃদ্ধিমায়াতি ক্ষয়মায়াতি সঞ্চয়াৎ ॥”

এত কঠিন ও প্রলম্বিত কোনও ধাঁধার উত্তর হতে পারে, স্বপ্নেও ভাবিনি । অর্থ না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছাড়া আর কোনও ভদ্রলোক যে এমন সুখশ্রাব্য সংস্কৃত শ্লোকোচ্চারণ করতে পারেন, সে বিষয়েও কোনও ধারণা ছিল না । প্রাঞ্জল বাংলায় উনি অনুবাদ করে দিলেন : “হে দেবী সরস্বতী, তোমার ভাণ্ডারে কী অপরূপ শোভা দৃশ্যমান হয় ! যে বিচিত্র ঐশ্বর্য, বিতরণের মাধ্যমে ক্রমবৃদ্ধি ও সঞ্চয়হেতু ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটে । অর্থাৎ বিদ্যা বা জ্ঞানই হলো সেই অপার্থিব ঐশ্বর্য, যা দান, বিনিময় ও চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয় এবং কূপমণ্ডুকের মতো আবদ্ধ করে রাখলে তার অবলুপ্তি ঘটে । আমার শিক্ষকদের থেকে যে অপার্থিব ঐশ্বর্য আমি পেয়েছি, তা আমি দিয়ে যাব তোমাদের এবং তোমরাও সেই পরম্পরা বজায় রেখে একে অন্যকে এবং আগামী পৃথিবীকে তা মুক্তহস্তে দান করবে ।” এই ধাঁধাটিই ছিল ‘সুক্তিরত্নাবলী’র প্রারম্ভিক শ্লোক তথা স্যারের থেকে লব্ধ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ।

ক্রমাগত দু’বছর পদ, বিভক্তি, সন্ধি, প্রত্যয়, বচন, শব্দরূপ, ধাতুরূপের অনুশাসন মেনে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে এই শাস্ত্রটি অধ্যয়ন হয়তো অনেক মেধাবী সহপাঠীর কাছেও নিরস ও বিরক্তিকর মনে হয়েছিল । তথাপি মাতৃভাষার জন্মদাত্রী ভাষা এবং সাহিত্যের সুমহান ঐতিহ্যকে আরও কিছুটা জানতে আমি কিঞ্চিৎ উৎসাহবোধ করেছিলাম । ফলস্বরূপ মাধ্যমিক শিক্ষাবর্ষের প্রায় চারশো সহপাঠীর মধ্যে, একমাত্র আমিই ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে সংস্কৃতকে স্বেচ্ছায় নির্বাচন করি । শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে অনেকেই এ ব্যাপারে আমাকে একপ্রকার নিরুৎসাহিতই করেছিলেন । তাঁদের যুক্তি ছিল এটাই, বিষয়টিতে লব্ধ ফল যাই হোক, উচ্চতর শিক্ষার কথা মাথায় রেখে নির্বাচনটি বিশেষ ফলপ্রসূ নয় । তাছাড়া এ বিষয়ে একমাত্র পরীক্ষার্থী হিসেবে আমার জন্য কোনও বিশেষ ক্লাস ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করাও স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব নয় । অনন্যোপায় হয়ে শরণাপন্ন হয়েছিলাম সেই সংস্কৃত শিক্ষকের । যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে স্যার সেদিন শুনেছিলেন আমার একান্ত ইচ্ছার কথা । কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে বলেছিলেন, “এক অর্থে ওনারা কিন্তু ঠিকই বলেছেন । একমাত্র সংস্কৃত কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছাড়া বিষয়টা বৃত্তিমূলকভাবে তোমার কোনও কাজে আসবে না । তবে বাংলাভাষাকে যদি তুমি শুদ্ধভাবে জানতে চাও, মাতৃভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যদি তোমার আগ্রহ থাকে এবং আমাদের সাহিত্যসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে যদি তোমার কিছুমাত্র আসক্তি থাকে, তাহলে এটুকু বলতে পারি, এই ভাষাশিক্ষা ভবিষ্যতে তোমাকে সমৃদ্ধ করবে ।” অতকিছু উচ্চাশা সেদিন সত্যিই আমার ছিল না, কিন্তু স্যারের উৎসাহবাণী আমাকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছিল । তিনি সহকারী প্রধানশিক্ষক মহাশয়কে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন আমার বিষয়চয়ন মঞ্জুর করতে । সেদিন পরীক্ষাগ্রহণের দায়িত্বভার নিতে তিনি সম্মত না হ’লে, আমার ইচ্ছাপূরণ কোনভাবেই সম্ভব ছিল না । শুধু পরীক্ষাগ্রহণই নয়, ঐচ্ছিক বিষয় পিরিয়ডে তিনি নিয়মিতভাবে আমার সংস্কৃত ক্লাস নিতেন লাইব্রেরী রুমে বসে । মনে আছে, স্কুলের টেস্ট পরীক্ষাতেও একমাত্র আমিই উত্তর লিখেছিলাম স্বয়ং স্যারের হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে, যা সংখ্যালঘুত্বের বিবেচনায় মুদ্রণযন্ত্র নির্গত হওয়ার সুযোগ পায়নি ।

নামোচ্চারণ না করে যে মহান শিক্ষকের সম্পর্কে এ’কথাগুলো বললাম, তিনি সংস্কৃত ও বাংলা শাস্ত্রের বিদগ্ধ পণ্ডিত সর্বশ্রদ্ধেয় ডক্টর সিদ্ধেশ্বর সাঁই । তিনি আমার ভাষাশিক্ষক, তিনি আমার ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ । তিনিই আমার ‘সংসদ’ ও ‘চলন্তিকা’র জীবন্ত অভিধান । তিনিই একাধারে আমার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতি চাটুজ্জে ও সুকুমার সেন । তিনিই আমার বাংলা একাডেমী, আমার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ । শুভ জন্মদিনে সেই ব্যক্তিরূপী প্রতিষ্ঠানকে জানাই আমার শতসহস্র কোটি প্রণাম ও আজন্মের কৃতজ্ঞতা ।

Previous articleটেক্সাসে করোনা আক্রান্তের গ্রাফ এখনো উর্ধ্বমুখী
Next articleলকডাউন একটা কৌশল মাত্র! কেন বললেন রাহুল গান্ধী