নিউ ইয়র্কে এতো করোনা সংক্রমণ-মৃত্যু, দায়ী কে?

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক

নিউ ইয়র্ক শহরের পাঁচটা বরো। যেমন আমাদের কলকাতায় ধরুন লোকসভা আসনগুলো। একটা মোটামুটি তুলনা করলাম।
এছাড়া, নিউ ইয়র্ক রাজ্যে আরো কয়েকটা শহর আছে — যেমন বাফেলো (যার পাশেই নায়াগ্রা ফলস), রচেস্টার, বিংহ্যামটন, সিরাকিউজ, নিউ ইয়র্ক রাজ্যের রাজধানী অলব্যানি ইত্যাদি। আমরা অলব্যানিতে সাত বছর ছিলাম। ছোট্ট শহর, বছরে ছমাস শীত আর বরফ। বাফেলোতে আরও বেশি।
ওসব জায়গায় জনবিরলতার কারণে সংক্রমণ অনেক কম। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট নেই তেমন। আন্তর্জাতিক আনাগোনা নেই। অনেকগুলো প্লাস পয়েন্ট।
নিউ ইয়র্কে দুটো বিশাল বিমানবন্দর। তার মধ্যে জেএফকে বা জন এফ কেনেডি বিশালতম। সেখানে আমি যখন ৬ মার্চ কলকাতা থেকে এসে পৌঁছেছিলাম। কোনো টেস্টিং বা স্ক্রিনিং আমি দেখিনি। ট্রাম্প ক্রমাগত মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিল। মিডিয়াগুলোও তাকেই রাজার মতো দিবারাত্র দেখাচ্ছিল। করোনাভাইরাস ও তার করাল গ্রাস সেই সময়েই এই শহরে থাবা বসিয়েছে।
নিউ ইয়র্ক শহর মেগা সিটি। ওই পাঁচটা বরোর মধ্যে বৃহত্তম হল ব্রুকলিন, যেখানে আমাদের বাড়ি। এছাড়া আছে ব্রংক্স, কুইন্স, ম্যানহাটান আর স্ট্যাটেন আইল্যান্ড।

বোধহয় আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী শহর। আর বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সবচেয়ে গরিব শহর। নির্ভর করছে আপনি কোথায় থাকেন এই শহরে এবং আপনার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা ঠিক কী রকম তার উপর।
চার্লস ডিকেন্স সেই কতকাল আগে “এ টেল অফ টু সিটিজ” লিখেছিলেন — ধনী ও দরিদ্রের আকাশপাতাল তফাৎ বোঝাতে। আজকের আমেরিকা এবং বিশেষ করে আজকের নিউ ইয়র্কে থাকলে ডিকেন্স সাহেব হয়তো “এ টেল অফ মেনি সিটিজ” লিখে ফেলতেন। এই সব রকমের সিটিজ উইদিন দ্য সিটি — অর্থাৎ এক শহরের মধ্যে অনেক শহর — আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি গত কুড়ি বছর এই নিউ ইয়র্কে বাস করে। পিরামিডটা এই রকম।
সবচেয়ে ধনী যাঁরা, তাঁরা ওয়াল স্ট্রিটের বিশালতম কর্পোরেট জগতের বাসিন্দা — ম্যানহাটানের কিছু নির্বাচিত অংশের আকাশছোঁয়া বাড়ির বাহাত্তর তলা বা ঊনপঞ্চাশ তলায় বিশাল প্রাসাদের মতো তাঁদের এপার্টমেন্ট। বিজনেস টাইকুন, ফিল্ম স্টার, সেলিব্রিটি বেসবল বা ফুটবল প্লেয়ার, রক স্টার, ব্রডওয়ে শোর মালিক, বিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক, লেখিকা, ফ্যাশন ডিজাইনার, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার (গোল্ডম্যান স্যাক্স, প্রভৃতি), ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বাকিরা ওয়াল স্ট্রিটে প্রতিদিন কয়েকশো কোটি ডলার লেনদেন করে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে নিউ জার্সির প্রাসাদে ফিরে যান।
(আমাদের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন — খুব একটা তফাৎ নেই।)
পিরামিডের দ্বিতীয় থাকে হয়তো উপরোক্ত উচ্চতম শ্রেণীর ব্যক্তিদের সহকারীরা বা
জুনিয়ররা। তারপর আছে রেস্টুরেন্ট চেন, গ্রোসারি স্টোর চেন, জাঙ্ক ফুড চেন ইত্যাদির ম্যানেজার গোছের লোকজন। ডাক্তার, আইনজীবী — অবশ্য তার মধ্যেও স্তরভেদ আছে। প্রথম সারির ব্যক্তিরা যা রোজগার করেন, এঁরা হয়তো তার একশো ভাগের এক ভাগ করেন।
পিরামিডের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম — এভাবে কল্পনা করুন। এদের প্রত্যেক সারির লোক আগের সারির তুলনায় মোটামুটি একশো ভাগের এক ভাগ রোজগার করেন। এবারে এদেরকে ম্যানহাটান থেকে ব্রুকলিন, নিউ জার্সি কিংবা লং আইল্যান্ড পাঠিয়ে দিন বড় বড় বাড়িতে থাকার জন্যে।
আমাদের এই ব্রুকলিন বরোতেই আবার হয়তো পাঁচ কি দশটা শ্রেণীবিভাগ আছে। এর মধ্যে আমরা হয়তো মাঝামাঝি জায়গাতে। আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি আছে এবং আমরা উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু আমরা ব্রুকলিনের পশ এলাকায় থাকি না। সেখানে থাকে বড় বড় ডাক্তার, আইনজীবী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, মাঝারি মাপের বিজনেসম্যান, ব্রুকলিন কলেজের ডিন বা হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট। ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এতো কিছু কেন বলছি এই আলোচনায়? কারণ, আসল কথাটা বলতে গেলে এই ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাসের ব্যাকগ্রাউন্ডটা দিতেই হবে। এবারে আসল কথা। এই ব্রুকলিন বা কুইন্স বা স্ট্যাটেন আইল্যান্ড এলাকার এমন কিছু কিছু জায়গা আছে, যেখানে মানুষ
দারিদ্র্যসীমার নীচে। অর্থাৎ না খেতে পাওয়া, প্রায় না খেতে পাওয়া, ভগ্নস্বাস্থ্য, ক্লাস এইট বা টুয়েলভ পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দেওয়া, ভাঙাচোরা নোংরা অস্বাস্থ্যকর ফ্ল্যাটে থাকা, ম্যাকডোনাল্ড, কে এফ সি, কোক পেপসি খাওয়া, গরমকালে রাস্তার ধারে বা পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা, শীতকালে সাবওয়ে ট্রেনে বা হোমলেস শেল্টারের রাত কাটানো অসংখ্য মানুষ।
ওই বিলাসবহুল ফিফ্থ এভেন্যুয়ের বা পার্ক এভেন্যুয়ের ম্যানহাটান? ওই বরোতেই, ওই ফিফ্থ বা পার্ক এভিনিউ ধরে উত্তর দিকে আর এক কি দেড় মাইল হেঁটে গেলেই শুরু হয়ে যাবে অতি দরিদ্র পল্লি। আরো দারিদ্র্য দেখতে চান? আরো একটু উত্তরে ব্রংক্স বরোতে চলে যান। ওই পিরামিডের একেবারে নিচের তলার হতভাগ্য মানুষদের দেখতে পাবেন সেখানে। নিউ ইয়র্ক শহরের পঁচাশি লক্ষ মানুষের মধ্যে অন্তত পঁচিশ লক্ষ পিরামিডের এই মাটিতে ছুঁয়ে থাকা তলদেশে। যেখানে ওবেসিটি, যেখানে ড্রাগ, যেখানে ক্রাইম, যেখানে টিন
প্রেগনেন্সি, যেখানে ডিপ্রেশন, হতাশা, যুগযুগ ধরে বঞ্চনা। যেখানে শিশুদের হাঁপানি, মায়েদের হাই প্রেসার, বাবাদের ডায়াবেটিস।
যেখানে প্রায় নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলতে আমেরিকার পুলিশের চোখের পাতা ফেলতে হয় না। যেখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন হয়তো অনেক বছর ধরে জেলে আছে — তার মধ্যে অনেকেই সামান্য অপরাধে। আজকে এই করোনাভাইরাস তাদের আক্রান্ত করেছে সবচেয়ে বেশি। অস্বাস্থ্য, কুস্বাস্থ্য, অশিক্ষা, বিজ্ঞানচেতনার অভাব, চিকিৎসার অভাব, আর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় শূন্য — এই সব মিলে কোভিড-১৯ ওই পিরামিডের তলায় চিরকাল পড়ে থাকা মানুষের শরীরে বাসা বেঁধেছে অতি দ্রুত। রাষ্ট্রের ও শাসকের সম্পূর্ণ, নিরঙ্কুশ অবজ্ঞা, অবহেলা ও বঞ্চনা।
এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সংখ্যা হয়তো বেশি। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ হতদরিদ্র মানুষও অনেক আছে। অনেক। তার পরে আছে গরিবের গরিব মেক্সিকো, হণ্ডুরাস, সালভাডোর, বা হাইতি,
ডোমিনিকান রিপাবলিক থেকে আসা বাদামি গাত্রবর্ণের মানুষগুলো।
আরও আছে। গরিবের গরিব চিনা ইমিগ্রেন্ট। আফ্রিকান ইমিগ্রেন্ট। আর আছে গরিব বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি ইমিগ্রেন্টদের দল। যাঁরা আমেরিকার এই নতুন বহুমাত্রিক পিরামিডের নীচের তলার অন্ধকারে বাস করা নতুন ক্রীতদাস। তাঁদের অনেকে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন।
শুধু নিউ ইয়র্ক আর নিউ জার্সিতেই বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় একশো জন আজ
করোনাভাইরাসের করাল গ্রাসে মৃত। সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে।

Previous articleকরোনা পরিস্থিতি: আর্থিক বৃদ্ধির ধাক্কার আশঙ্কা প্রকাশ আইএমএফের
Next article৭.৪% আর্থিক বৃদ্ধি! আরবিআই গভর্নর স্বপ্ন দেখছেন, বললেন অর্থনীতিবিদরা