একেই বলে সাচ্চা কমিউনিস্ট। আর খাঁটি কমিউনিস্ট-এর কন্যা তো কমিউনিস্ট বাবার মতোই খাঁটি হবে। করোনা মোকাবিলায় চলছে লকডাউন। এই কঠিন সময়ে অসহায়-সম্বলহীন হতদরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। নিজেদের সাধ্যমত সকলেই চেষ্টা করছেন দিন আনি দিন খাই আধপেটা-অভুক্ত মানুষদের মুখে অন্ন তুলে দিতে। তিনিও ব্যাতিক্রমী নন। কখনও গরিব মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। আবার গরমে রক্তের আকালের সময়, দায়িত্ব নিয়ে করছেন ভ্রাম্যমান রক্তদান শিবির। জীবনের একটাই লক্ষ্য, মানুষের মঙ্গলে নিজেকে নিয়োজিত করা। যিনি নিজের ছোট্ট মেয়ের জন্মদিনের খরচের সমস্তটা তুলে দিলেন মানুষের কল্যাণে। লকডাউনের কঠিন সময়ে মেয়ের জন্মদিনে নিমন্ত্রিত ছিল ৫০০ জন হতদরিদ্র। তাঁদের ভরপেট খাওয়ালেন। আসলে তিনি একজন সাচ্চা কমিনিস্ট। তিনি যাদবপুরের সিপিএম নেতা সুদীপ সেনগুপ্ত।

আর যেমন কমিউনিস্ট বাবা। তেমন কমিউনিস্ট তাঁর ১৩ বছরের কন্যা তিতি। ছোট্ট মেয়ে,তাই আবদার ছিল জন্মদিন পালন করতেই হবে। এবং রোজ রোজ তাঁর চোখের সামনে যে দাদা-দিদি-কাকুরা এই ক’দিন ধরে যাদের জন্য খাবার বানাচ্ছে, তাদেরকেই এবার জন্মদিনে খাওয়াতে হবে। ব্যাস, মেয়ের এমন আবদার যেন আগে থেকেই তাঁরা জানতেন। এক কথায় সব ব্যবস্থা করে ফেললেন সুদীপবাবু এবং তাঁর সহধর্মিনী সুনীতা সেনগুপ্ত।

মেয়ে তিতির জন্মদিন প্রসঙ্গে একটু আবেগপ্রবণ হয়েই সুদীপবাবু বলছিলেন, “আজ থেকে মাস দুই আগেও তিতি হেসেই উড়িয়ে দিত সব!

ক’দিন ধরে মেয়ের বড্ড মন খারাপ! ওর জন্মদিন! কাকতালীয় ভাবে ওর ক্ষেত্রেই সত্যি হলো ঘটনাটা!!

নতুন জামা নেই,
স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আনন্দ করা নেই,
বিকাল বিকাল ছোড়দিভাই, তুন্নু, মুন্নু, পিপি, পিয়া, মামাই, মানি,বড়দিভাইরা কেউই আসতে পারবে না!
কেক হবে না মনের মতো!!
আর ‘গিফট’ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই!
ধুস!!

জন্মদিনটা আর দু’মাস আগে আসলো না কেন!!!
আমাদেরও মন ভালো নেই।
এভাবে ২০ এপ্রিল আসেনি আগে!

দেখতে দেখতেই বড়ো হয়ে যাচ্ছে মেয়ে!
আমার কাজের চাপ,
সুনীতার অফিস,
মা-বাবাই-কে এক ডাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা,
তা সত্বেও কোনও অনুযোগ নেই,
নিজের মতো করেই গুছিয়ে নিয়েছে ওর দৈনন্দিন রুটিন।

কিন্তু বছরের কিছু বিশেষ দিনে
পাশে পেতে চায় পুরো পরিবারকে!
আমাদের কাছেও এই দিনটি
ফ্যামিলি গেট টুগেদারের জন্য নির্দিষ্ট!

এই বছর তা আর হবে না!
বাড়িতে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু সে তো চারজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে!
সকলে মিলে আনন্দ ভাগ করার মজাটাই পাওয়া যাবে না যে!!”

এরপরই একমাত্ৰ মেয়ের জন্মদিনে এমন মানবিক আয়োজনের বাকি রহস্যটা সামনে আনলেন কমিউনিস্ট সুদীপ। বললেন, সুনীতার পরামর্শেই
তিতির জীবনের সবচেয়ে বড়ো বার্থ-ডে পার্টি!!”

বাপ-বেটি নয়, এ তো পুরো কমিউনিস্ট ফ্যামিলি। ফলে গোটা পরিবারই রন্ধ্রে রন্ধ্রে “বাই দ্য পিপল”, “ফর দ্য পিপল”, “অফ দ্য পিপল”। তাহলে দেশের এমন দুর্দিনে মেয়ের জন্মদিনটাই বা বাদ যায় কেন। অসহায় মানুষের পাশে, মানুষের সাথে দাঁড়ানোর এমন সুযোগ কোনও খাঁটি কমিউনিস্ট পরিবার কি হাতছাড়া করতে চায়? না, হাতছাড়া করেননি সুদীপ-সুনীতা এবং তাঁদের আদরের কন্যা তিতি।
লকডাউন পর্বে যাদবপুরের বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র-যুবদের তিনটি রান্না ঘরেই (কমিউনিটি কিচেন) আজ সোমবার ডিমের ঝোল আর ভাত হওয়ার সিদ্ধান্ত আগে থেকেই ছিল।
৫০০ জনের রান্না। ভাগ করে খাবেন হয়ত আরও অনেকজন।
তাই সামর্থ্য অনুযায়ী এই টুকুর দায়িত্ব নিতে তৈরি তিতির মা সুনীতা। তিনি পারবেন বলাতেই আয়োজকরাও একবাক্যে রাজি!
সেভাবেই বাড়িতে পার্টি হবে না,
কিন্তু রাস্তায় ৫০০ জন মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া হলো! আজ সেটা শুধু খাবার নয়, বলা ভালো তিতির জন্মদিনের ভোজ।
এদিকে আজ তিতির জন্মদিন বলে সবাই মিলে মিষ্টি খাওয়া খেলো। গত ১৮ দিন ধরে তিতির যে দাদা-দিদি-কাকুরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছিল ওই অসহায় মানুষগুলির মুখে একটু অন্ন তুলে দিতে, আজ তারাও তো বাড়তি উদ্দমে কাজ করলো।
এরই মাঝে অর্ণব-রঙ্গনরা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কেক এনেছে। এটা তিতির বাড়তি পাওনা।
ভিডিও কলেই দাদাদের কাছ থেকে বার্থডে উইশ আর শুভেচ্ছা বিনিময়!
লকডাউনের এই সময়, এই ভাবে জন্মদিন পালনের সুযোগ পেয়ে, আজ তিতির দিনটাও ভালোই কাটছে।
এই আয়োজনেই তিতির মন খারাপ কেটেছে। প্রতিবারই জন্মদিনে বাড়ির সকলের সঙ্গে খুব মজায় কাটায় সে।
এবারের জন্মদিনটা দারুন কাটলো তার। তিতির চোখমুখ বলে দিচ্ছিল, এমন সুখের জন্মমদিন আগের বারোটা বসন্তকেও টেক্কা দিয়েছে। একসঙ্গে এমন অচেনা-অজানা মানুষের আশীর্বাদ আগে পায়নি তিতি।