Monday, November 10, 2025

অচেনা শহরে রাস্তায় আছি জেনে রাত দুটোয় হোটেলের দরজা খুলে দিয়েছিল রনিদা

Date:

সালটা ছিল ২০১২, সেপ্টেম্বর মাস। তখন আমি একটি সংবাদ পত্রে ক্রীড়া সাংবাদিকতার কাজ করি। এডিটর বললেন, এবার শিলিগুড়ি গিয়ে ফেডারেশন কাপ কভার করতে হবে। সেবার একসঙ্গে কলকাতার ৫টি ক্লাব ভারতের সেরা এই নকআউট টুর্নামেন্টে খেলছে। তাই খুব ভালো কভারেজ চাই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর চাই। কিছু যেন বাদ না পড়ে।

প্রায় ১২দিনের সফরে। নির্দিষ্ট সময়ে আমি আর আমার চিত্র সাংবাদিক শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার নির্দিষ্ট ট্রেন ধরলাম। তখনও পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। একটা খটকা অবশ্য ছিল। পরদিন একটি রাজনৈতিক দল সারা ভারত ধর্মঘট ডেকে ছিল। কিন্তু যেহেতু সকালেই ট্রেন এনজেপি ঢুকে যাওয়ার কথা, তাই ভেবেছিলাম সেভাবে কোনও সমস্যা হবে না।

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। ট্রেন কিষানগঞ্জ ঢোকার আগে অবরোধ। আটকে গেলো ট্রেন। যথারীতি আমরাও আটকে পড়লাম ট্রেনে। ঘন্টার পর ঘন্টা। কখন আবার সবকিছু সচল হবে জানতাম না। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। আমি কলকাতার বাইরে বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন শহরে আইপিএল, ফেডারেশন কাপ, আই লীগ কভার করেছি, কিন্তু এই রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আগে হয়নি কোথাও। মাঝ পথে ট্রেন দাঁড়িয়ে। জল নেই। খাবার নেই। সে ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যায়। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। সে এক বীভৎসতা। খুব অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেদের।

অবশেষে গভীর রাতে ট্রেন ছাড়ল কিষানগঞ্জ থেকে। আমরা এনজেপি পৌঁছালাম আরও গভীর রাতে। সেখানেও বিপদ অপেক্ষা করছিল। অত রাতে শিলিগুড়ি যাওয়ার কোনও গাড়ি নেই। অগত্যা আমি আর আমার চিত্র সাংবাদিক নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিছুক্ষণ বাদে আমার চিত্র সাংবাদিকের মোবাইলে একটি ফোন। ফোনের ওদিক থেকে জিজ্ঞাসা ছিল এইরকম, “তোরা কোথায়? ঠিকঠাক আসতে পারলি?” সবকিছু শুনে আমার চিত্র সাংবাদিককে বলেছিল, “সোমনাথকে ফোনটা দে”। সেই সময়ের বর্তমান পরিস্থিতি বললাম। জানালাম আমাদের বুকিংও নেই। ভেবেছিলাম সকালে পৌঁছে হোটেল করে নেবো। আমি তখনও ফোনে কথা বলছি, আমার চিত্র সাংবাদিক ততক্ষণে অচেনা এক বাইক আরোহীকে ওই রাতে এনজেপি স্টেশন থেকে হঠাৎ আবিষ্কার করে।

আমাকে ছুটে এসে বললো। “একজন পুলিশকে পেয়েছি। উনি শিলিগুড়ি যাচ্ছেন। সবকিছু শুনে বলেছে আমাদের ছেড়ে দেবে। ফোন রাখ। চল তাড়াতাড়ি।” বড় দুটো লাগেজ নিয়ে উঠে পড়লাম বাইকে। পৌছেও গেলাম শিলিগুড়ি। বাকি রাতটা কাটাতে পারতাম স্টেশনে। কিন্তু পরদিন সকালেই ওপেনিং ম্যাচ। তাই আর ঝুঁকি নিইনি।

ততক্ষণে আমার মোবাইলে একটা মেসেজ। যেখানে লেখা ছিল, অচেনা শিলিগুড়ির একটি রাস্তার ঠিকানা। আর একটি হোটেলের নাম। বাইক থেকে নেমে ওই পুলিশকর্মী দু’জনে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কিছুটা হাঁটা রাস্তার পর পৌঁছে গেলাম ম্যাসেজে পাওয়া ওই হোটেলের ঠিকানায়।

হোটেলের নিরাপত্তারক্ষীদের পরিচয় দেওয়ার পর তাঁর ঢোকার অনুমতি দিলেন। রাত ২টো। শিলিগুড়িতে সেই হোটেলের একটি রুমের দরজায় টোকা মারতেই তা খুলে গেল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করেই বসেছিল সে।

দরজার ওপারে রুমের মধ্যে ছিল কলকাতার বিশিষ্ট চিত্র সাংবাদিক রনজয় রায়। আমাদের রনিদা। রনিদা একদিন আগেই শিলিগুড়ি চলে এসেছিল। সারাদিন আমরা কিছু খাইনি রনিদা জানতো। আসলে এনজেপি স্টেশনে ফোনের ওপারে ছিল রনিদাই। তাই জানতে পেরেছিল রাতেই শিলিগুড়ি ঢুকছি আমরা। কায়দা করে নিজের ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিয়েছিল। জানতো, আমরা এত রাতে অন্য কোথাও নয়, তার কাছেই যাবো আমরা। তাই আসার আগেই হোটেল ম্যানেজারকে ওই রাতে ম্যানেজ করে খাবারও আনিয়ে রেখেছিল। আজ রনিদা নেই। অচেনা শহরে রাস্তায় একা আছি জেনে আর কেউ রাত দুটোয় হোটেলের দরজা খুলবে না। ভাবতেই পারছি না। আসলে ভাবতে চাইছি না।

তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। গঙ্গার বুক দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। পাল্টে গিয়েছে ময়দান। পাল্টে গিয়েছে ময়দানের ফুটবল। শুধু নিজেকে একদম পাল্টায়নি। রনিদা। সেই সকালে নিয়ম করে প্র্যাকটিস কভার কিংবা বিকেলে প্রি-ম্যাচ প্রেস কনফারেন্স। সবার আগে রনিদা।

স্মৃতিগুলো জোনাকির মতো। জ্বলে আর নেভে। সম্প্রতি, খুব একটা দেখা বা কথা হতো না। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ থাকতো নিয়মিত। করোনার দাপাদাপির শুরুতে রনিদা আরও অনেকের মতোই ফেসবুক পোস্ট করে লিখেছিল, “Stay at Home…”। কিন্তু সকলকে ঘরে থাকতে বলে নিজেই চলে গেলো। চলে গেলো নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটির কাছে। রেখে গেলো তার সৃষ্টি।

ভালো থেকে রনিদা। ভালো থেকে পিঙ্কিদি। যেখানেই থেকো দু’জনে। খুব খুব ভালো থেকো…।

Related articles

সিনেমা দেখে খুনের ছক! স্ত্রীকে পুড়িয়ে নদীতে ছাই ফেলে থানায় অভিযোগ স্বামীর

সিনেমা দেখেই পরিকল্পনা! ‘দৃশ্যম’ দেখে অপরাধের ছক কষেছিলেন পুনের (Pune) বাসিন্দা সমীর যাদব। ৩৮ বছরের স্ত্রী অঞ্জলি যাদব...

১ ডিসেম্বর থেকে নয়া হারে আবগারি শুল্ক কার্যকর! রাজ্যে কত হচ্ছে সুরার দাম

শীতের শুরুতে মৌতাতের পরিকল্পনা করলে, সেই আনন্দে কিছুটা ধাক্কা। কারণ পশ্চিমবঙ্গে (West Bengal) বাড়ছে সব ধরনের মদের  দাম...

অচলায়তন ভেঙে মুক্ত চিন্তাভাবনার অঙ্গন হবে বাংলা: রাখি-রিয়াকে শুভেচ্ছা তরুণদের আইকন অভিষেকের

তিনি যুব সমাজের আইকন। তৃণমূলের (TMC) সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Abhishek Banerjee) ঘিরে সব সময়ই তরুণ প্রজন্মের জনজোয়ার। আর...

পাঁচবারের কাউন্সিলর, তবু নাম উড়ে গেল ভোটার তালিকা থেকে! চাঞ্চল্য খড়দহে

শেষবার এসআইআর হয়েছিল ২০০২ সালে। সেই তালিকায় তাঁর নাম যে ছিল, তার প্রমাণ, সেবার তিনি কাউন্সিলর (councilor) নির্বাচিত...
Exit mobile version