গৃহশিক্ষকদের প্রতি এই অন্যায়টা করবেন না

অচিন্ত্য মন্ডল

প্রতীকী ছবি

গৃহশিক্ষকের মাইনে বন্ধ করে দিয়েছেন ছাত্র/ ছাত্রীর পরিবার। বিগত কয়েকদিনে আমার একাধিক ফেসবুক বন্ধুর পোস্টে এবং বেশ কিছু চাকরির পড়াশোনা সংক্রান্ত গ্রূপে এই ধরণের পোস্ট দেখতে পাচ্ছি। প্রায় সবকটি ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙ্গুল বিত্তবান বাবামায়েদের দিকে, যাঁরা বাড়িতে আর্থিক নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রয়েছেন এবং যাঁরা ডিজিটাল পেমেন্ট বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল। (প্রসঙ্গত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহশিক্ষকের সাথে ‘দরদাম’-এও চূড়ান্ত কার্পণ্য এই বিত্তবান শ্রেণীর মধ্যে লক্ষণীয় বলেই শোনা যায়।)

যা বুঝলাম, করোনা পরিস্থিতিতে মাইনে না দেওয়ার কারণ হিসেবে কেউ বলছেন, ‘তুমি তো এ মাসে পড়াওনি, মাইনে কী করে দিই বলো!’, অথবা, ‘তুমি কি এসে মাইনেটা নিয়ে যেতে পারবে? (লকডাউন সত্ত্বেও)’, অথবা, ‘তুমি তো এ মাসটা হোয়াটসএপেই শুধু কয়েকটা নোট পাঠালে আর টুকটাক ফোনে বোঝালে। ওতে কি আর পড়া তেমন এগিয়েছে? তাহলে এমাসে অর্ধেক ফিজ নাও।’, অথবা কোনো সরকারী চাকুরীজীবি বলছেন ‘এই বাজারে বুঝছ তো একটু টানাটানি। এই ৩ মাস বরং পড়ানো বন্ধ থাক। পরে একটু ম্যানেজ করে দিও।’

আপনাদের উদ্দেশ্যে বলি, যে গৃহশিক্ষকরা সরকারি স্কুলে পড়ান না বা যাঁদের মোটেই তেমন পসার নেই, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই আপনার এবং আপনার মতো আরও ২-১ টি বাড়ি থেকে মাসের শুরুতে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়ার পরে) দেওয়া ওই ক’টা টাকার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। কাউকে ওটা দিয়ে বাবার ওষুধ কিনতে হয়, কাউকে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়, কাউকে নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফিজ দিতে হয়, কাউকে মায়ের হাতে তুলে দিতে হয় সংসারখরচ চালানোর জন্য। প্রায় প্রত্যেকেই নিজের কলেজ, পড়াশোনা চালিয়ে, চাকরির পরীক্ষার জন্য দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে বিকেলের বাদবাকি সময়টুকু নিজেকে না দিয়ে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিয়ে, বন্ধুকে/ বান্ধবীকে সময় না দিয়ে, নিজের শখ-আহ্লাদকে প্রশ্রয় না দিয়ে সাইকেল ঠেঙিয়ে শুকনো মুখে আপনার বাড়ি ছুটে যান, বা আপনার গাড়ির আওয়াজের অপেক্ষায় বাড়িতে বসে থাকেন, শখে নয়; তাঁরা আপনার দেওয়া ওই ক’টা টাকার জন্যই পরিশ্রমটুকু করেন।(যদিও অনেকের বিশ্বাস, পড়ানোটা কোনো পরিশ্রম নয়; তাই তাঁরা গৃহশিক্ষক মাইনে চাইলে উঞ্ছবৃত্তি মনে করেন। অনেকেই আছেন যাঁরা মনে করেন গৃহশিক্ষককে দিয়ে বাড়ির কাজ, ঘরমোছা, রঙ করা ইত্যাদি করাচ্ছেন। এক পরিচিত মা বলছিলেন তিনি তাঁর ছেলের ফিজিক্সের গৃহশিক্ষককে ‘ছাড়িয়ে’ দিয়েছেন। আমি কারণ জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই তাঁর ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলে বলে উঠল, শয়তানের গাছ ছিল স্যারটা, তাই।)

এই লকডাউনের সময়ে এই শ্রেণী সবথেকে উপেক্ষিত। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত হলেও মানসিকতায় তো মধ্যবিত্ত। না পারছেন সইতে, না পারছেন মুখ ফুটে বলতে। না পাচ্ছেন পয়সা, না পাচ্ছেন রেশনের চাল, না পাচ্ছেন ত্রাণের ডাল। বিশ্বাস করুন, খুব কষ্টে আছে এই ছেলেমেয়েগুলো। খুব কষ্টে আছেন সেই মানুষগুলো যাঁরা গৃহশিক্ষকতার ভরসাতেই সংসার প্রতিপালন করেন।

দয়া করে এঁদের ভাতে মারবেন না। ছেলেমেয়েকে যে বিখ্যাত গৃহশিক্ষকদের ব্যাচে পড়ান, তাঁদের মাইনে যেমন সময়ে ব্যাংকে পৌঁছে দিচ্ছেন তেলা মাথায় তেল দেওয়ার জন্য, একইভাবে যে ‘বেকার’ ছেলেটি/ মেয়েটি আপনার সন্তানের একটি বা একাধিক সাবজেক্টের দায়িত্ব নিয়েছে এবং ওই বিখ্যাত গৃহশিক্ষকদের থেকে অনেক বেশি শ্রম ও যত্ন দিয়ে পড়াচ্ছে, তাকেও এই সময়ে সামান্য ক’টা টাকা ব্যাংকে পৌঁছে দিন। ঐক’টা টাকা বাঁচিয়ে আপনি আরো বড়লোক হতে পারবেন না। আর কিছু না হোক, আপনার সন্তান আপনার এই আচরণগুলো দেখে কী শিখছে, কী মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছে, সেদিকে একটু নজর দিন। সব ‘বেকার’ হীনমন্যতায় হকের পাওনাটা চাইতে পারে না। তার সুযোগটা নেবেন না দয়া করে, যাঁদের সামর্থ্য আছে। করজোড়ে, নতমস্তকে অনুরোধ রইল।

যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, কাউকে যেন গৃহশিক্ষকতা করতে না হয়

[এত বড়ো লেখা যাঁরা পড়লেন, ধন্যবাদ। আমার একবিন্দুও আর্থিক লাভ হবেনা এতে। আমার মাইনে কেউ আটকে দিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে পড়ে এ লেখা লিখছিনা আমি। যদি কয়েকজন বাবামায়ের কাছেও এই বার্তা পৌঁছায়, একজন বাবা/ মাও মানসিকতা পরিবর্তন করে নিজের সন্তানের গৃহশিক্ষককে তাঁর পাওনাটা দেন, আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। কারণ, ওই দিনগুলো আমি পেরিয়ে এসেছি।]