আয়লা আর আমফান, মূল্যায়নের মাপকাঠি কি শুধু চেয়ার? অভিজিৎ ঘোষের কলম

অভিজিৎ ঘোষ

সাংবাদিকতা এক আশ্চর্য মায়ার খেলায় অবিরাম রূপান্তরিত হয়ে চলেছে।

যাঁরা গুরু, যাঁরা একসময়ের আদর্শ, তাঁদের কলমের বিস্ময়কর পরিবর্তন কৌতূহল বাড়াচ্ছে নেপথ্যভাষণের নেপথ্যকাহিনি সম্পর্কে।

আমরা, যারা একটু পরে আসা, আজকের ঘূর্ণিতে বিহ্বল। এই বদলের পিছনে রহস্য কীসের, মনের বদল নাকি পরিস্থিতির?

আসানসোলের ছাত্রজীবন থেকে প্রিয় কাগজ ‘আজকাল’। স্বপ্নের কলম সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তর। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকায় হয়ত ভালোলাগাটা বেড়েছিল।

গত রবিবার অশোকবাবুর কলম পড়লাম। আমফান প্রসঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ঢালাও প্রশংসা করেছেন। লিখেছেন,” মুখ্যমন্ত্রী অতন্দ্র প্রহরী।” লিখেছেন,” বাঘিনি।”

আমি এবং আমরাও মনে করি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিনরাত পরিশ্রম করে যথাসাধ্য কাজ করেছেন।

কিন্তু, খটকা লাগে, এই অশোকবাবুই 2009 সালের 7 জুন তখনকার বিপদ আয়লা নিয়ে কলমে এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই যারপরনাই আক্রমণ করেছিলেন। তখন তিনি তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর হয়ে ব্যাটিং করতে ব্যস্ত।

সেদিন অশোকবাবু লিখেছিলেন,” দুতিনদিন দেরি করিয়ে দিতে অবশ্য পেরেছেন রেলমন্ত্রী।( তখন তৃণমূলনেত্রী রেলমন্ত্রী)। এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে দুতিনদিন মানে অনেক। কিছু অসুবিধেয় ফেলা গেল সরকারকে।”

লেখার শেষ প্যারায় একেবারে ব্যক্তিগত আক্রমণের কটাক্ষ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। লিখেছেন,”কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা বলেছেন, ‘ আইলা আইলা/ সিপিএম নাইলা।’ অর্থাৎ আয়লা এসে সিপিএমকে ‘নাইলা’ করে দিয়ে গেল। এতে দুর্গত মানুষদের কী উপকার ‘হইলা’, সে অন্য কথা। কিন্তু এমন ছড়া টেবিলে তবলা বাজিয়ে বলেননি, এই তো যথেষ্ট।”

আয়লায় আক্রমণ। আমফানে বাঘিনি।
একই মানুষ রাজ্যের মসনদে বসলে মূল্যায়ন এভাবে বদলায়!
সেদিন বিরোধী নেত্রীর যুক্তি বা বক্তব্যকে ধূলিস্মাৎ করে আজ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর তাঁকেই প্রশংসার মালা।
চেয়ারের পক্ষে থাকার কী আকুতি! কী তাগিদ!
কেন? কেন? কেন?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের ধরণকে সমর্থন করলে তখনও করা যেত; চেয়ারে বসার পর গুণ আবিষ্কারের নেপথ্যকাহিনি কী?

আমরা, যারা অশোক দাশগুপ্তর কলম পড়ায় নেশাগ্রস্ত ছিলাম, এখন মনে হয়, সাংবাদিকতার মঞ্চ শুধু কাগজে ছাপা নেপথ্যভাষণ নয়; নেপথ্যে আছে অন্য কাহিনি; যা বছরের পর পর বৃত্ত আঁকড়ে থাকতে আপসে বাধ্য করে।
এখানে মুখ্যমন্ত্রী পদটা বড়, সেটাই শেষ কথা। যে রঙের যেই আসুক; আমাকে একটা যুক্তি সাজিয়ে সেখানেই টিকে থাকতে হবে।

আজকালের পাঠ্যবস্তুর নীতিগত অবস্থান বদলেছে। বদলাতেই পারে। পেশাদার বিষয়।
কিন্তু প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিকের কলম যখন এইভাবে বদলায়, তখন মনে হয় সাংবাদিকতা মূল্যহীন।

অশোকবাবুর মত স্তম্ভর কলম যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে রং বদলায়; তাহলে আমরা, তথাকথিত ছোট হাউসের সাংবাদিকরা কীসের বিশ্বাসে নীতি, আদর্শের ভিত্তিতে জেদ করব??

সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু থেকে বাঘিনি!
কোন্ চোখের ডাক্তারের ওষুধে?
বুদ্ধবাবুর জমানাতেও তো তৃণমূলনেত্রী বাঘিনিই ছিলেন। সেদিন আয়লার সময় কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেদিন সেগুলো দেখতে পাননি?

কৈশোর বা প্রথম যৌবনের তারকাদের এহেন পরিবর্তন মন থেকে মানা যায় না। তখন মনে হয় থামুন; আর নয়; এবার অবসর। মনে থেকে যাক আপোসহীন কলমের আগুনটাই।

নিচে আয়লার সময়ে আজকালে লেখা অশোকদাশগুপ্তর কলমটি হুবহু তুলে ধরলাম। এই লেখাগুলোর জন্যই পড়তাম, সংগ্রহ করে রাখতাম।
অশোকবাবু নিজে পড়লেও কি একটু বিষণ্ণ হয়ে যাবেন না?

নেপথ্যভাষণ: অশোক দাশগুপ্ত

“নাইলা”

পিএম টু ডিএম। দিল্লি টু পঞ্চায়েত। এই দাবি-পর্বের, আশা করা যাক, বিরতি আপাতত। সংবিধান কী বলে এবং বড় বিপর্যয়ের রাজে‌্যর পাশে কেন্দ্রের দঁাড়ানো কেন কার্যত বাধ‌্যতামূলক–বোঝার মতো রাজনীতিক-প্রশাসক ওখানে সরকারে আছেন। কেন্দ্রীয় পরিদর্শকরা এসে গেছেন, দুর্গত এলাকা দেখতে, বিপর্যয়ের মাত্রা বুঝতে, রাজ‌্য প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে। এটাই নিয়ম। প্রক্রিয়া। প্রথম দিনই এ কথা বলেছিলেন অসীম দাশগুপ্ত। দিল্লিতে সদর্থক সাড়া দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরম। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ‌্যায় বাংলার মানুষ হিসেবে বেশি বিচলিত এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের যথাযথ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন তো বটেই।

পিএম টু ডিএম। নেত্রী বলেছেন, কথাটা উঠেছিল রাজীব গান্ধীর সময়ে, সুতরাং এবার…। ‘কথা উঠেছিল’। কিছু হয়নি। সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেন্দ্র-রাজ‌্য সম্পর্কের পুনর্বিন‌্যাস করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে চুরমার করে দিয়ে। দূর অস্ত। এখন ঝোঁক, রাজে‌্যর হাতে আরও ক্ষমতার দিকে। কংগ্রেস-শাসিত, বিজেপি-শাসিত, বাম-শাসিত, আঞ্চলিক দল-শাসিত সব রাজ‌্যই এই দাবিতে মুখর।

আসল কথা, সংবিধানে হয় না। কেন্দ্রের অর্থ আসতে হবে রাজে‌্যর মাধ‌্যমেই। অরুণাভ ঘোষ নির্ভুল বলেছেন, কেন্দ্র টাকাটা দেবে কাকে? ডিএম? ডিএম তো রাজ‌্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে-নির্দেশে কাজ করেন। তিনি সেই টাকা রাজ‌্য সরকারের অনুমতি ছাড়া কী করে খরচ করবেন? হিসেব দেবেন কাকে? পিএম টু পঞ্চায়েত-পরিষদ? পঞ্চায়েত রাজ‌্য সরকারের মধে‌্য। জেলা সভাধিপতি বা পঞ্চায়েত প্রধানকে হিসেব দিতে হবে রাজ‌্য সরকারকেই।

দু-তিন দিন দেরি করিয়ে দিতে অবশ‌্য পেরেছেন রেলমন্ত্রী। এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে দু-তিন দিন মানে অনেক। কিছু অসুবিধেয় ফেলা গেল বাজে সরকারকে। আর একটা জিনিসও দেখার মতো। রাজে‌্য এই দুর্গতি, তখন যে-কোনও ছুতোনাতায় অশান্তি ‘উৎপাদন’। বিরতি নেই। স্থানীয় পঞ্চায়েত তৃণমূলের, মুখ‌্যমন্ত্রী িনজে গেলেন, সিপিএমের ৮১ বছর বয়সী বিধায়ককে আক্রান্ত হতে হল কেন? অপরাধ, তিনি ঠিক ওই জায়গাটায় যাননি। গোপল গায়েনের বাড়িও ভেঙেছে, সেখানেই কোনওরকমে আশ্রয় নিয়েছে কয়েকটি দুর্গত পরিবার। বিধায়ক সক্রিয় এলাকা জুড়ে। কিন্তু, তঁার গায়ে কাদা মাখিয়ে প্রশ্ন, আনন্দ-কাগজের হেডিং–কেমন লাগছে?
মুখ‌্যমন্ত্রী কেন আইলা-বিধ্বস্ত দুই জেলায় তিন দফায় গেলেন, খবরের কাগজ, চ‌্যানেল ক্রুদ্ধ। তাতে নাকি ত্রাণের ব‌্যাঘাত। রাজ‌্যপাল গেলে ব‌্যাঘাত হয় না। কেন্দ্রের রাষ্ট্রমন্ত্রীরা গেলে হয় না। মুখ‌্যমন্ত্রী গেলে হয়! বুদ্ধদেব গিয়েছেন, সরাসরি দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ক্ষোভকে বলেছেন স্বাভাবিক, স্থানীয় প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন। ছাপা প্রচার, কান্তি গঙ্গোপাধ‌্যায় না কি মুখ‌্যমন্ত্রীর দক্ষিণ ২৪ পরগনা সফরে বিরক্ত! ত্রাণে ব‌্যাঘাত। কান্তিবাবু বিবৃতি দিলেন, এমন কথা বলতে যাবেন কেন, তিনিই মুখ‌্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন যাওয়ার জন‌্য। মুখ‌্যমন্ত্রী গেলে প্রশাসন আরও সক্রিয় ও নির্ভুল হবে, স্বাভাবিক।

দুই ২৪ পরগনায় দুর্গত এলাকায় অধিকাংশেই পঞ্চায়েতে বিরোধীরা। তঁারা কী করছেন? কী করছেন না? কোনও কথা নেই। ধরো মুখ‌্যমন্ত্রীকে, মারো বামফ্রন্টকে। রাজে‌্যর বিপর্যয়ে এমন আনন্দ শুধু এই বাংলাতেই হতে পারে।

এক দুর্গত মানুষ না কি মুখ‌্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে বলেছেন, ‘আপনি অপদার্থ মুখ‌্যমন্ত্রী, আপনার গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়া উচিত।’ পত্রান্তরে পল্লবিত প্রতিবেদন। এমনও পড়া গেল, তুই-তোকারি হচ্ছিল। বুদ্ধদেব বলছেন, ‘অনেক কথা শুনেছি, বলেছি। এমন কোনও কথা তো শুনিনি।’ কোনও যথার্থ দুর্গত অমন গোছানো কুভাষায় রাজনৈতিক আক্রমণ করার জায়গায় থাকতে পারেন? গ্রামবাংলায় সাধারণ মানুষকে অপমান। ওঁরা ওই ভাষায় কথা বলেন না, ওই রুচি নিয়ে চলেন না। সেখানে নামিয়ে আনার চেষ্টা অবিরাম, কিন্তু কাজটা সহজ নয়। রাজ‌্যটা আনন্দে নোংরা হয়ে যায়নি।

যদি মুখ‌্যমন্ত্রী না যেতেন? অন‌্য প্রচার হত। কেন গেলেন না? দুর্গত এলাকায় না গিয়ে মুখ‌্যমন্ত্রী রাইটার্সে ঠান্ডা ঘরে মিটিং করছেন। মানুষের সামনে গিয়ে দঁাড়ানোর সাহস নেই। সুতারাং, বোধহয় ওই কথাই দঁাড়াত–আপনি অপদার্থ মুখ‌্যমন্তরী, আপনার গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়া উচিত।

কী যে করেন মুখ‌্যমন্ত্রী! কী আবার করবেন, যা করলেন তা-ই করবেন। আনন্দবাবুদের এবং অন‌্যদের নোংরা আক্রমণ উপেক্ষা করবেন। সমালোচনায় তথ‌্য ভিত্তি থাকলে, ব‌্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই কঠিন সময়ে নেতৃত্বের কাছে মানুষের যা প্রত‌্যাশা ও দাবি, তা পূরণ করবেন।

কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা বন্দ‌্যোপাধ‌্যায় বলেছেন, ‘আইলা আইলা/সিপিএম নাইলা’। অর্থাৎ, আইলা এসে সিপিএমকে ‘নাইলা’ করে দিয়ে গেল। তাতে দুর্গত মানুষদের কী উপকার ‘হইলা’, সে অন‌্য কথা। এমন ছড়া টেবিলে তবলা বাজিয়ে বলেননি, এই তো যথেষ্ট।

আজকাল, ৭ জুন, ২০০৯

Previous articleমসজিদ বন্ধ থাক, এমনই চাইছেন রাজ্যের মুসলিম ধর্মগুরু ও একাধিক সংগঠন
Next articleঅনেক সময় পেয়েছেন পরীক্ষকরা, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাধ্যমিকের খাতা জমা দেওয়ার নির্দেশ