স্পষ্টই হয়নি কেন সেদিন বিজেপিতে গিয়েছিলেন শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ

চাণক্য চৌধুরি : লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর ২৬ মে ২০১৪ তারিখে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদি৷ সেই সময়ে বঙ্গ-বিজেপির সভাপতি রাহুল সিনহা৷

তার মাস চারেক পর, ওই ২০১৪ সালেরই ২৫ সেপ্টেম্বর বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের স্ত্রী, শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ৷ সেদিন নগরপালের সহধর্মিণীকে দলে টেনে বেশ উজ্জীবিতই হয়েছিলো বিজেপি৷ বিজেপি সেদিন বলেছিলো, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের অন্দরমহলেও ঢুকে পড়েছে বিজেপি৷ এই সবে শুরু৷ আরও চমক আছে৷ ২৫ সেপ্টেম্বর ছিলো বৃহস্পতিবার৷ কলকাতায় দলের রাজ্য সদর দফতরে গিয়ে বিজেপির পতাকা হাতে তুলে নেন রহস্যজনকভাবে সদ্য মৃত শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ।

শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ ছিলেন যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিতা৷ বায়োলজিতে এমএসসি, অ্যান্টিবায়োটিক্স-এ পোস্ট-ডক্টরাল৷ কলকাতার জোড়াবাগান এলাকার এক নামী স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রায় ৯ বছর৷ শর্মিষ্ঠাদেবীকে দলে টানার আগে রাজ্যের বেশ কিছু প্রাক্তন আইএএস এবং আইপিএস-কে দলে নেয় বিজেপি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভোটেও প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্তার স্ত্রীকে দলে টেনে আনার ঘটনা নিশ্চিতভাবেই সেদিন বড় চমক ছিলো৷ বিজেপিতে যোগ দিয়েই রাজ্যে নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনার উল্লেখ করে শর্মিষ্ঠাদেবী সেদিন বলেছিলেন, “চারধারে যা সব কাণ্ড হচ্ছে, তাতে বিজেপি-তেই যোগ দেওয়া উচিত বলে মনে হয়েছে।” বলেছিলেন, নিজের মেয়ে-সহ সমস্ত মহিলার নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম বাঁচানোর লড়াইয়ের জন্য বিজেপি’ই উপযুক্ত জায়গা৷” শর্মিষ্ঠার এই কথার পর বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, “এই ঘটনায় প্রশাসনের বিড়ম্বনাই বাড়লো”৷

বিজেপি’র এক সভায় তৎকালীন বঙ্গ-বিজেপি সভাপতি রাহুল সিনহার সঙ্গে,২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সেই সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমাল চলছিলো৷ অভিযোগ উঠেছিলো, ছাত্রীর শ্লীলতাহানির৷ শর্মিষ্ঠাদেবী সেদিন যাদবপুর-কাণ্ড নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্লীলতাহানির ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “সব নারীর যা মত, আমারও তা-ই মত। আমারও মেয়ে আছে। তার ৭ বছর বয়স। আমার দেরিতে সন্তান হয়েছে। আগে জন্মালে তার এখন ১৮ বছর বয়স হতো। আমার মেয়ের সঙ্গে এমন হলে কী হতো?” যাদবপুর-কাণ্ড নিয়ে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের বক্তব্যকে উড়িয়ে বলেছিলেন, “যাদবপুর-কাণ্ড নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার যা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সাজানো৷ এক জন মা এবং নারী হিসাবে আমার কাছে বিজেপির বক্তব্যই সত্য মনে হয়েছে। আলাদা করে কিছু বলছি না। তবে কলকাতার পুলিশ কমিশনার দ্রুত মানুষের আস্থা হারাচ্ছেন”৷
শর্মিষ্ঠাদেবীর মন্তব্যকে হাতিয়ার করে প্রত্যাশিত ভাবেই সরকারকে সেদিন বিঁধেছিলে তৎকালীন রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিনহা। তাঁর বক্তব্য ছিলো, “প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতায় অসন্তুষ্ট হয়ে পুলিশ কমিশনারের ঘরের লোকের মতোই রাজ্যের অন্য মহিলারাও নিরাপত্তার স্বার্থে বিজেপি-তে আসতে চাইছেন।” শর্মিষ্ঠাদেবীর যোগদান বিজেপি-কে বাড়তি অক্সিজেন দিল বলেও সেদিন মন্তব্য করেছিলেন রাহুলবাবু।

কিন্তু সেই অক্সিজেন বেশিদিন কার্যকর হয়নি৷ বঙ্গ-বিজেপি সেভাবে সামনেও আনেনি শর্মিষ্ঠাদেবীকে৷ রাজনীতির মঞ্চে মাত্র কিছুদিন দেখা গিয়েছিলো তাঁকে৷ বিজেপি তাঁকে স্বীকৃতিও দেয়নি সেভাবে, প্রার্থী করা তো দূরের কথা৷ শর্মিষ্ঠাদেবী কিন্তু সক্রিয়ভাবে বিজেপি দল করতে আগ্রহী ছিলেন৷ সেই সময়ে যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘তাঁর স্বামী রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলা। তিনি বিজেপি-তে যোগ দেওয়ায় পরিবারে সমস্যা হবে না?’ সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট উত্তরে বলেছিলেন, “প্রত্যেক মানুষের পৃথক মত পোষণ করার ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। একই বাড়িতে বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম নানা দল করতেই পারেন!” তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব পালন করতে সুরজিৎবাবুর তো অসুবিধা হবে, এর জবাবে শর্মিষ্ঠাদেবী বলেছিলেনন, “সেটা ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।”
সুরজিৎবাবু অবশ্য শর্মিষ্ঠাদেবীর বিজেপিতে যোগদান নিয়ে মুখই খোলেননি৷ একটি শব্দও খরচ করেননি৷

দলের হাতে গোনা কয়েকটি কর্মসূচিতে তখনকার বিজেপি রাজ্য কমিটি সামিল করেছিলো শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থকে৷ পুরভোটের আগে
দলের বিশিষ্ট জনেদের সঙ্গে এক বৈঠকে তাঁকে ডাকা হয়েছিলো
পি সি সরকার, প্রাক্তন ফুটবলার ষষ্ঠী দুলে, শিল্পপতি শিশির বাজোরিয়া, অভিনেতা নিমু ভৌমিক, জর্জ বেকার, জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, আর কে হান্ডা, আর কে মহান্তি প্রমুখদের সঙ্গে৷

আর একবার, ওই ২০১৪ সালেরই অক্টোবর মাসে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো পাড়ুই এলাকা৷ প্রতিদিন বোমা,গুলির খবর শিরোনামে৷ সেই সময়ে পাড়ুইয়ের মাখড়া গ্রাম পরিদর্শন করতে আসে বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল। সেই দলে ছিলেন মুক্তার আব্বাস নকভি, কীর্তি আজাদ, উদিত রাজ, রাহুল সিনহারা৷ ছিলেন শিশির বাজোরিয়া, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ, মহম্মদ আরশাদ আলম ও প্রভাকর তিওয়ারিও৷ যদিও সেদিন কাউকেই মাখড়া গ্রামে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ ৷ বিজেপির প্রতিনিধি দল চৌমণ্ডলপুরে পৌঁছতেই তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ। সেদিন পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির পর গ্রেফতারও করা হয়েছিলো বিজেপির নেতাদের৷

এরপর থেকে বিজেপিতে শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ আর সেভাবে দেখা যায়নি৷ নানা কারন থাকতে পারে৷ তখনই রাজ্য বিজেপির কমিটিরও পরিবর্তন হয়ে যায়৷ সভাপতির পদ থেকে সরে যান রাহুল সিনহা৷ নতুন কমিটি হয়তো শর্মিষ্ঠাদেবীকে পছন্দ করেনি৷ অথবা হয়তো শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থই রাজনীতিতে আস্থা হারান নানা কারনে অথবা চাপে৷

তবে ইদানিং শোনা যাচ্ছিলো বিধাননগরে বিজেপির কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছিলেন শর্মিষ্ঠাদেবী৷ পুরসভার ভোটে প্রার্থী হবেন তিনি, এমনও শোনা যাচ্ছিলো৷ এখন তো সেই অধ্যায়ও শেষ হয়ে গেলো৷

বিজেপিতে ঠিক কোন কারনে সেদিন যোগ দিয়েছিলেন শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ , আমৃৃত্যু সেটা স্পষ্টই হলো না৷ অথবা কোনও পরিস্থিতির চাপে তিনিই বোঝাতে পারেননি বা চাননি৷

এমন লোকজনের সংখ্যা অবশ্য কম নেই বঙ্গ- বিজেপিতে৷

Previous articleসামাজিক বিধি মানাতে তৈরি ‘প্রকাণ্ড জুতো’, ‘জায়ান্ট হ্যাট’
Next articleকলকাতায় ফের বৃষ্টি