
হালফিল কোভিড নিয়ে চিৎকার, তর্ক, ঝামেলার ফাঁকে এক অনেক বড় বিষয় হারিয়ে গেছে। মেইন স্ট্রিম মিডিয়া, সরকার কেউ এক লাইন ও খরচ করছেনা। অথচ অনেকেই জানেন না, এটাই এখন দেশের সরকারের সবচাইতে বড় মাথাব্যথা র কারন, যার কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছেনা। ঘণ্টা খানেক কেন মিনিট খানেক ও কেউ দিতে রাজি নয় এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে, জাতিও জানতে চায়না। সেটা হল চিন ভারত সীমান্ত সমস্যা। যা বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে যে কোনো সময়। না এটা Oppo, Vivo বয়কট বা চিনের টুনি বাল্ব না কিনে চিনের সর্বনাশ করার মতন হুজুগ নয়। অনেক অনেক জটিল বিষয়।

ঘটনার সূত্রপাত:

The Economic Times, ১২ মে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাপে যে চিনের সেনা ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে প্রচুর সংখ্যায়, তারা প্রচুর অস্ত্র সমাবেশ করেছে। ভারতীয় সেনা হতাহত ও হয়েছে, সরকার কিছু করছেনা। পরে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং স্বীকার করেন, যে ভারতীয় এলাকায় চিনের কিছু অধিবাসী ঢুকে পড়েছে, বিষয়টি ভারতীয় সেনা দেখছে। লক্ষণীয় তিনি চিনের সেনা ঢুকেছে এমন কথা এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পরে সেনাবাহিনীর বহু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার নানান মিডিয়াতে জানান যে এটা সরাসরি চিনা আগ্রাসন, এবং পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। আমি এখানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে এস পানাং যে আর্টিকেল লিখেছেন The Print পত্রিকায়, সেই সূত্র বেশি ব্যবহার করছি। উনি ওই এলাকায় এবং অরুনাচলে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং সেনাবাহিনীর চিন সংক্রান্ত বিষয়ে এক বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আপনারা সেনাবাহিনীর অন্য অবসর প্রাপ্ত অফিসারের আর্টিকেল পড়তে পারেন, নানান মিডিয়াতে প্রকাশিত। মূল বক্তব্য প্রায় এক। (খুব বেশী পত্রিকায় বিস্তারিত পাবেন না। BBC, The Print, The Wire, Scroll, Economic Times, The Mint এগুলো পড়তে পারেন।)

একটু পিছনে দেখি:

কাশ্মীরের পাক-অধিকৃত অংশ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়, কিন্তু চিন অধিকৃত আকসাই প্রদেশ নিয়ে তেমন আলোচনা হয়না। এর কারণ হয়তো ওখানে মুসলিম নেই, আর বিপক্ষে চিন, যার সাথে আমেরিকা বা NATO ও অনেক সাবধানে কথা বলে। সে যাই হোক, কাশ্মীর আর POK এর মধ্যে আছে LOC (Line Of Control), আর লাদাখ আর আকসাই প্রদেশের মধ্যে আছে LAC (Line of Actual Control). এই LOC আর LAC শুনতে অনেকটা কাছাকাছি হলেও একটা বড় তফাৎ হল LOC খুব ভালো ভাবে নির্ধারিত বা well defined, এই LOC নিয়ে ভারত পাকিস্তান এর কোনো মতবিরোধ নেই। কিন্তু LAC কিন্তু এরকম স্পষ্ট নয়। অন্তঃত ৮০ কিলোমিটার লম্বা এলাকা আছে যা নিয়ে জটিলতা আছে। ভারত বলে ওটা ভারতের অংশ আর চিন বলে তাদের। Lac এর যতদূর ভারতের বলে দুই দেশই মেনে নিয়েছে তাকে বলে Blue zone, আর যতদূর অবধি চিনের বলে দু দেশই মেনে নিয়েছে, তাকে বলা হয় রেড জোন। এই রেড জোন আর ব্লু জোনের মাঝে কিছু কিছু জায়গায় বিতর্কিত জায়গা রয়েছে, যেটাকে বলেছেন ইয়েলো জোন বা আন্তর্জাতিক পদ্ধতি মেনে বলা হয় Area of differing perceptions (ADPA). বহুদিন ধরে দুই দেশের সেনাবাহিনীর এক অলিখিত চুক্তি ছিল। ভারতীয় সেনা ব্লু জোনে থাকতো, চিনা সেনা রেড জোনে, আর ADPA তে দুই দেশের সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট সময়ে রুট মার্চ করতো। ভারতের মারচিংয়ের সময় চিন নিজের জায়গায় থাকতো আর উল্টোটাও একরকম। খুব একটা সমস্যা ও ছিলনা এতে, কারন ওই ADPA খুবই জনহীন জায়গা, অতি দুর্গম, বসবাস করা খুবই কঠিন, এবং স্ট্র্যাটেজিক ভাবেও একদমই গুরুত্বপূর্ণ নয় দুই দেশের কাছে। যে কথা সিয়াচিনের মতন দুর্গম হিমবাহ নিয়ে খাটেনা। এছাড়া ওই এলাকায় চিন ভারতের সেনা খুব বেশি মোতায়েন থাকতোনা। মাঝে মাঝে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে তর্কাতর্কি বা হাতাহাতি হলেও বড় কোনো সমস্যা কখনো হয়নি। আর লাদাখের বাসিন্দারা আকসাইয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্ক ও ভালো, তাঁরা ও কোনো ঝামেলা চায়না।

ঝামেলার সূত্রপাত:

এই ভাবে চলতে চলতে বিষয়টা হোঁচট খায় গতবছর অগাস্ট মাসে। যখন ভারত লাদাখ, লেহকে কাশ্মীরের অংশ থেকে বাদ দিয়ে কেন্দ্র শাসিত অংশ ঘোষণা করে, এবং আকসাই প্রদেশ সহ লাদাখকে সেই অংশের বলে পার্লামেন্টে বিল পাশ করে। চিন এই দুই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায় ও হুঁশিয়ারি দেয় এর ফল ভারতকে ভুগতে হবে বলে। ভারত ও ভারতীয় মিডিয়া কাশ্মীরের জঙ্গি, মুসলিম আর পাকিস্তানকে টাইট দেওয়া গিয়েছে বলে উল্লাসিত হলেও, এই বিপদের কথা চেপে যায়। আর ভারত যুক্তি দেয় যেহেতু লাদাখ, লেহ ভারতের নিজস্ব অংশ, তাই সেই অংশ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অন্য দেশের সাথে আলোচনা করার দরকার নেই। আর চিন বলে লাদাখ যেহেতু বিতর্কিত অংশ তাই তাদের সাথে কোনো আলোচনা না করে একতরফা সিদ্ধান্ত বেআইনি। আমরা তখন চিন বয়কট করে মনে করি সমস্যা মিতে যাবে।
এরপর চিন ভারতকে দাবি জানায় যে ভারত যে ২৫৫ কিলোমিটার উন্নত মানের জাতীয় সড়ক বানাচ্ছে শায়ক আর ডারবুক এর মধ্যে তার কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কারণ তাদের ভাষায় আরেক বিতর্কিত অঞ্চল অরুণাচল প্রদেশের অন্য রাস্তা করা হবে। আর চিন যুদ্ধের পর চুক্তির অংশ ছিল অরুণাচল প্রদেশের সাথে অন্য রাজ্যের যোগাযোগ করতে গেলে চিনের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হবে। ভারত বলে, এটা স্রেফ দাদাগিরি, কারণ শায়ক আর ডারবুক হাইওয়ে আগেই নির্মিত, পুরোটাই ভারতের মধ্যে দিয়ে, সেটার জন্য চিনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে কেন? ওই রাস্তার মাঝে চিনের কাছ ঘেঁষা Doulatbag Oldii ও পুরোপুরি ভারতের। আর যে চিন চুক্তির কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো কিছুই চিন নিজেই না মেনে অজস্র রেল, রাস্তা নির্মান করেছে। বেজিং থেকে তিব্বত এর লাওস ৬ লেনের রাস্তা, এমনকী রেল লাইন ও করেছে। যা ওই চুক্তি অনুযায়ী করা যায়না। ভারতের যুক্তি এক্ষেত্রে অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত সন্দেহ নেই। তাই ভারত চিনের হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে ওই পথ নির্মাণ করে এবং এইবছর এপ্রিল মাসে তা উদ্বোধন এর দিন ঘোষণা করে।

বর্তমান অবস্থা:

চিনের দাদাগিরি ভারত না মানায় চিন গতবছর নভেম্বর মাস থেকেই লাদেখে সেনা সমাবেশ বাড়াতে থাকে, অতি উন্নত অস্ত্র মজুত করে। ভারত ও সেনাবৃদ্ধি করে। Tension বাড়তে থাকে, দুই সেনার মধ্যে গোলাগুলি ও হয়, যা পাকিস্তান সীমান্তে স্বাভাবিক হলেও চিন সীমান্তে হতনা। এরপর ET-এর খবরে জানা যায় চিনের সেনা ৩ জায়গায় প্রবেশ করেছে
1. Pangong lake-এর কথা সবাই জানে। অপূর্ব সুন্দর এই লেক, অনেকেই বেড়াতে গিয়েছেন, এছাড়া 3 Idiots সিনেমায় এই লেক সবাই দেখেছেন। এই লেকের পশ্চিম দিক চিনের দখলে, পূর্ব দিক ভারতের। যদিও দুই দেশই বলে পুরো লাদাখ তাদের অংশ। যাই হোক ওই লেক প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আর ৫ কিলোমিটার চওড়া। ওই লেকের ৬০% রেড জোনে, মানে চিনের, আর ৩৫% ব্লু জোন আর ৫% মতন ADPA. এই ADPA এর অর্ধেকের বেশী অংশ চিন দখল করে নিয়েছে, স্ট্র্যাটেজিক ভাষায় Finger 4 অবধি দখল করে Finger 3 এর কাছে চলে এসেছে। সেখানে তারা ৫০০০ এর বেশী mountain fighter শ্রেণীর শক্তিশালী ও হিংস্র সেনা মোতায়েন করেছে, যাদের নৃশংসতা সারা বিশ্ব জানে, এবং প্রচুর উন্নত অস্ত্র মজুত করেছে।
2. চিনা সেনা Galwan valley পুরো দখল করে নিয়েছে। প্রসঙ্গত এই Galwan valley সম্পূর্ণ অবিতর্কিত ব্লু জোন, যা নিয়ে চিনের ও কোনো দ্বিমত ছিলনা। এই Galwan এলাকা অনেক উঁচু এবং strategic ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে চীন অন্তত ৩০,০০০ সেনা মোতায়েন করেছে এবং heavy artiliary নিয়ে এসেছে। এই জায়গা অনেক উঁচু হওয়ায় তাদের অবস্থান অনেক সুবিধার, আর তাদের যা অস্ত্র আছে তা দিয়ে ওই নব নির্মিত সড়ক ধংস করা যায়, তাই ওই পথে কেউ যেতে রাজি হবেনা, ভারতীয় সেনা ওই পথে গেলেও বিপদ। এছাড়া তারা লাদাখ থেকে বিস্তীর্ণ অংশের স্যাটেলাইট সিগনাল ব্লক করে দিয়েছে।
3. চিন এছাড়া লাদাখের Kongka valley র hot spring দখল করে নিয়েছিল। পরে ভারতীয় সেনার সাথে আলোচনা করে তারা এই এলাকা থেকে সরে যায়, ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজী হয়। এইটাই ভক্তরা প্রচার করে যে ভারতের ভয়ে চিন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে। বাস্তবে এই hot spring এক অতি ছোট এবং জনবসতিহীন, এলাকা। এটা ব্লু জোন হলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নয়। ভারত এই অংশটা নিয়ে আদৌ চিন্তিত ছিলনা। ভারতের মূল মাথাব্যথা Galwan valley নিয়ে, ওখান থেকে চিনকে সরানো না গেলে ভয়াবহ বিপদ। অথচ ওই এলাকাতে চিনকে আক্রমণ করলে প্রচুর ভারতীয় সেনার প্রাণ তো যাবেই, এছাড়া চিন অরুণাচল, সিকিম এমনকি নেপাল দিয়ে ভারতকে আক্রমন করতে পারে। নেপালের সাথে বর্তমান তিক্ততা এর অংশ হতে পারে। আগে নেপাল ভারতের ভালো বন্ধু হওয়ায় চিন ওই পথ ধরার সাহস পেতনা।

চিন নিজেই Kongka valley থেকে সরে যাওয়াটা সারা বিশ্বে জানিয়েছে, তারা স্বীকার করেছে যে তারা ভুল করেছিল, ভুল ছিল সেনার, তাঁরা বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে সরে গেছে। তারা শান্তি চায়, তারা আশা করে বেশ কিছু জায়গা থেকে ভারত ও সেনা সরিয়ে নিক, জাতীয় সড়ক নির্মাণ বন্ধ করুক, লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুক। না হলে অশান্তির দায় ভারতের। ভারত নিজের জয়ের প্রচার করেনি, চিন নিজের পরাজয় এবং ক্ষমা চাওয়ার কথা সারা বিশ্বে প্রচার করে। কিন্তু Galwan নিয়ে তারা ভারতকে কড়া হুমকি দিয়েছে, ওই জায়গায় ভারত ফৌজ পাঠালে চরম মূল্য দিতে হবে।

পরিস্থিতি সত্যি সত্যি অগ্নিগর্ভ। ভারত সরকার সুন্দর ঠান্ডা মাথায় কাজ করছে, বিরোধীদলগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে নিয়মিত। আর বুদ্ধিমানের মতোই জনগনকে কোভিডে আটকে রেখেছে, এই বড় বিষয় নিয়ে যাতে তারা মাথা না গলায়। এটা কোভিড এর মতন সমস্যা নয়, এটা ক্যান্সার।
এ নিয়ে লেখাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল, কিন্তু এর থেকে কমে বোঝানো সম্ভব নয়। দিন কয়েক পরে এ বিষয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবো। প্রার্থনা করুন যেন এ সমস্যা মেটে, সর্বতভাবে ভারতের পাশেই আছি, চিনের দাদাগিরি কোনোমতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।