বিশ্বাস বলছে এক কথা, বিজ্ঞান বলছে অন্য। ভূতের আতঙ্কে মৃত্যু, নাকি শ্বাসরোধ? পরিবার বলছে ভূতের ভয়ে হার্টফেল করে মৃত্যু হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, মৃতের শ্বাসরোধ করা হয়েছে। আবার সেখানেও প্রশ্ন, সেক্ষেত্রে গলার দাগ যতটা গভীর হওয়ার কথা, এখানে তা কিন্তু নয়। দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ১০ বছরের নাবালিকার মৃত্যু ঘিরে এমনই সব প্রশ্ন উঠছে। ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য। তদন্তে নেমে প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

ঘটনার সূত্রপাত, নিউ আলিপুরের ই ব্লক। কলকাতা শহরে মূলত এলিট ক্লাস মানুষের বসবাস এই এলাকায়। অভিজাত এলাকায় মায়ের সঙ্গে থাকত বছর দশেকের মেয়েটি। গত শুক্রবার রাতে হঠাৎও অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পরিবারের লোকেরা বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা ওই নাবালিকাকে মৃত ঘোষণা করেন। রহস্যের জাল এখন থেকেই বিস্তার নেয়। আকস্মিক অসুস্থতা, আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেও মৃত্যু? প্রশ্ন উঠছে তদন্তকারীদের মনেও।
এরই মাঝে তদন্তে নেমে বড়সড় একটা ব্রেক থ্রু পেলো
পুলিশ। ওই বাড়িতেই নাকি এক যুবকের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ঘটনার দিনও ওই যুবক মেয়েটির বাড়িতে হাজির ছিল। এমনকী, মেয়েটিকে যে ক’জন হাসপাতালে নিয়ে গেছিল, তাদের মধ্যে ওই যুবকও ছিল। তার সঙ্গে ওই পরিবারের কী সম্পর্ক? জানা গিয়েছে, বছর তিনেক আগে ডিভোর্স হয়ে যায় নাবালিকার মা ও বাবার মধ্যে। এরপর থেকে নাবালিকা তার মায়ের কাছেই থাকতো। ওই যুবক তার মায়ের প্রেমিক বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। ঘটনার বিভিন্ন যোগসূত্র টেনে এই মৃত্যুর পিছনে বড়সড় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যেই আটক করা হয়েছে নাবালিকার মা সান্ত্বনা ভট্টাচার্য ও তাঁর প্রেমিক অভিজিৎ নাগকে।

তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ এই মৃত্যুর আরও গভীরে ঢোকার চেষ্টা করছে। রহস্যের জট খুলতে গিয়ে এরই মাঝে পুলিশের হাতে আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু। যা এই মৃতু রহস্য উদ্ঘাটনে বড় হাতিয়ার হতে পারে তদন্তকারীদের। সান্ত্বনার বাবা অর্থাৎ নাবালিকার দাদুর বয়ান অনুসারে, তাঁর নাতনি সবসময় ভয় পেত। সামান্য ঝড় উঠলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত।
অভিজিৎ মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন মুখোশ পরে সান্ত্বনার মেয়েকে ভয় দেখাত। তার এই কাণ্ডের ফলে নাবালিকার মানসিক কোনও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলি কিনা ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। এখানে মানসিক নির্যাতনের তত্ত্ব উঠে আসতে পারে। একইসঙ্গে ছাত্রীর মৃত্যুতে শারীরিক নির্যাতন হয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

পরিবারের দাবি, বেশকয়েকদিন ধরেই ভূতের ভয়ে মেয়েটি নাকি মানসিক চাপে ছিল। উঠতে-বসতে আঁতকে উঠছিল। এরপর শুক্রবার বাথরুমে গিয়ে হঠাৎই অচৈতন্য হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যায়। পরিবারের দাবি সেরকমই। কিন্তু ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলছে অন্য কথা!

তাহলে কি শ্বাসরোধ করে খুন? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়েটির গলায় শ্বাসরোধের চিন্হ থাকলেও হাত দিয়ে শ্বাসরোধ করলে যে গভীর দাগ হয়, এক্ষেত্রে তা একেবারেই নয়। স্বাভাবিক ভাবে ধন্দে পড়েছেন তদন্তকারীরা। তাহলে যে সামান্য দাগ রয়েছে গলায়, সেটা কোথা থেকে এল?

শনিবারই ময়নাতদন্ত হয় নাবালিকার। রিপোর্ট তৈরিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি তদন্তকারী চিকিৎসক। যা তদন্তের অগ্রগতিতে কিছুটা বাধা তৈরি করছে। সূত্রের খবর, ময়না তদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ আছে, ছাত্রীর ঘাড়ের পিছনে রাবার জাতীয় কিছু দিয়ে টান মারার চিহ্ন রয়েছে। আজ, সোমবার সান্ত্বনার বাড়িতে যাবেন তদন্তকারী চিকিৎসক। বাড়ির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করবেন বলে জানা গিয়েছে।

তবে তদন্তে নেমে সবচেয়ে সন্দেহজনক লেগেছে পুলিশের, যখন তারা জানতে ১০ বছরের ছোট্ট মেয়ের মৃত্যুর কথা শোনার পরেও কীভাবে একজন মা তার প্রেমিককে নিয়ে
হাসপাতাল থেকে বেপাত্তা হয়ে যায়। পোস্টমর্টেমের কথা শোনার পরই সান্ত্বনা তার প্রেমিক অভিজিৎ-এর এমন অস্বাভাবিক আচরণ তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন তুলছে। আরও একটি জায়গায় সন্দেহ দানা বাঁধে। হাসপাতালে ফোন নম্বর সঠিক দিলেও কেন বাড়ির ভুল ঠিকানা দিয়েছিলেন নাবালিকার মা?

সন্দেহ আরও একটি জায়গায়। নাবালিকার মা সান্ত্বনা ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, প্রচণ্ড পেটের যন্ত্রণা, ধুম জ্বর নিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল তার মেয়ে। এক প্রকার জোর করে বিছানা থেকে তুলে তাকে প্রথমে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।
তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন, তীব্র পেটের যন্ত্রণা নিয়ে কেউ অঘোরে ঘুমাতে পারে? জেরায় সদুত্তর দিতে পারেননি সান্ত্বনা।

এখানেই শেষ নয়, ভূত তত্ত্ব নিয়ে একটি প্রশ্নেরও সঠিক জবাব দিতে পারেননি সান্ত্বনা। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। আর তাতেই ছাত্রীর মৃত্যুতে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তদন্তে এই বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সান্ত্বনা ও তার প্রেমিক অভিজিতের মোবাইলের কল লিস্ট খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
