অশরীরী নয়, নিউ আলিপুরে নাবালিকার রহস্য মৃত্যুতে মায়ের প্রেমিকই “ছদ্মবেশী ভূত”?

দক্ষিণ কলকাতার ১০ বছরের স্কুল ছাত্রীর রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনায় সর্ষের মধ্যেই কি লুকিয়ে আছে ভূত? তদন্তে নেমে দিশা পেতে শুরু করেছে পুলিশ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের মধ্যেই রয়েছে রহস্য উন্মোচন যাবতীয় রসদ। নাবালিকার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই উঠে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ, নাবালিকার যৌনাঙ্গে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। ফরেন্সিকে গলায় ও ঘাড়ে হালকা হাতের ছাপও পাওয়া গিয়েছে। তদন্তকারীরা কার্যত নিশ্চিত এটা স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নয়। যৌন নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছে ওই নাবালিকাকে।

শুরুর দিন থেকে এই খুনের পিছনে পুলিশের সন্দেহ ছিল নাবালিকার ডিভোর্সি মায়ের প্রেমিকের দিকে। ওই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। কিন্তু প্রয়োজন ছিল, আরও কিছু পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণের। ধীরে ধীরে পুলিশের হাতে সেই প্রমাণ আসতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু পেয়েছেন তদন্তকারীরা। নাবালিকাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় এক ব্যক্তি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। এই মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে ওই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান পুলিশের হাত মজবুত করেছে। জনৈক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ওই বাড়ির নিচের তলায় একটি অফিস ভাড়া দেওয়া ছিল। সেই অফিসেই কাজ করতেন তিনি। এমনকি, ওই ব্যক্তিই ঘটনার দিন মেয়েটিকে কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন।

আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য তিনি জানান পুলিশকে। ওই ব্যক্তি হঠাৎ বাড়ির লোকের চিতৎকার শুনে উপরে ছুটে গিয়ে দেখেন, ঘরের মধ্যে স্কুল ছাত্রী অচৈতন্য অবস্থায় খাটে পড়ে রয়েছে, তার চোখ ওল্টানো ছিল। তবে তখনও নাবালিকার শরীরে প্রাণ ছিল কিনা, সেটা পুলিশকে তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

পুলিশ এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করছে নাবালিকার মা ও তার প্রেমিক সাহাপুরের যুবককে। গভীর চক্রান্তের গন্ধ পেতে শুরু করেছেন তদন্তকারীরা। মেয়েটির মা ও তার প্রেমিকের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। চেক করা হচ্ছে কল লিস্ট। নাবালিকার বাড়িতে প্রতিদিনই যে ওই যুবকের যাতায়াত ছিল, সেটা নিশ্চিত করা গিয়েছে। এমনকী, যেদিন ছাত্রীর মৃত্যু হয় অর্থাৎ গত রবিবারও ওই যুবক তখন ওই বাড়িতেই ছিল। ইতিমধ্যেই তার মা’কে আটক করে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। সূত্রের খবর, প্রথমদিন নাবালিকার মায়ের বয়ানে চরম অসঙ্গতি। ফলে পুলিশের সন্দেহ আরও পোক্ত হতে শুরু করেছে। পুলিশ পরিবারের লোকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, মায়ের প্রেমিক নাবালিকাকে মুখোশ পড়ে ভূতের ভয় দেখাতো।

*নাবালিকার এই মৃত্যু রহস্যের শুরুটা ঠিক কেমন ছিল?*

বিশ্বাস বলছে এক কথা, বিজ্ঞান বলছে অন্য। ভূতের আতঙ্কে মৃত্যু, নাকি শ্বাসরোধ? পরিবার বলছে ভূতের ভয়ে হার্টফেল করে মৃত্যু হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, মৃতের শ্বাসরোধ করা হয়েছে। আবার সেখানেও প্রশ্ন, সেক্ষেত্রে গলার দাগ যতটা গভীর হওয়ার কথা, এখানে তা কিন্তু নয়। দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ১০ বছরের নাবালিকার মৃত্যু ঘিরে এমনই সব প্রশ্ন উঠেছিল। তখন থেকেই ঘনীভূত হয় রহস্য। তদন্তে নেমে প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা চালাতে থাকে পুলিশ।

ঘটনার সূত্রপাত, নিউ আলিপুরের ই ব্লক। কলকাতা শহরে মূলত এলিট ক্লাস মানুষের বসবাস এই এলাকায়। অভিজাত এলাকায় মায়ের সঙ্গে থাকত বছর দশেকের মেয়েটি। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পরিবারের লোকেরা বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা ওই নাবালিকাকে মৃত ঘোষণা করেন। রহস্যের জাল এখন থেকেই বিস্তার নেয়। আকস্মিক অসুস্থতা, আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেও মৃত্যু? প্রশ্ন উঠতে থাকে তদন্তকারীদের মনেও।

এরই মাঝে তদন্তে নেমে বড়সড় একটা ক্লু পায় পুলিশ। ওই বাড়িতেই এক যুবকের নিয়মিত যাতায়াতের খবর উঠে আসে। ঘটনার দিনও ওই যুবক মেয়েটির বাড়িতে হাজির ছিল। এমনকী, মেয়েটিকে যে ক’জন হাসপাতালে নিয়ে গেছিল, তাদের মধ্যে ওই যুবকও ছিল। তার সঙ্গে ওই পরিবারের কী সম্পর্ক? তখনই জানা গিয়েছে, বছর তিনেক আগে ডিভোর্স হয়ে যায় নাবালিকার মা ও বাবার মধ্যে। এরপর থেকে নাবালিকা তার মায়ের কাছেই থাকতো। ওই যুবক তার মায়ের প্রেমিকই সকলে জানে। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যরাও। ঘটনার বিভিন্ন যোগসূত্র টেনে এই মৃত্যুর পিছনে বড়সড় রহস্যের গন্ধ তখন থেকেই পেতে শুরু করেন তদন্তকারীরা। আটক করা হয় নাবালিকার মা সান্ত্বনা ভট্টাচার্য ও তাঁর প্রেমিক অভিজিৎ নাগকে।

তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ এই মৃত্যুর আরও গভীরে ঢোকার চেষ্টা করে। রহস্যের জট খুলতে গিয়ে এরই মাঝে পুলিশের হাতে আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু। যা এই মৃতু রহস্য উদ্ঘাটনে বড় হাতিয়ার তদন্তকারীদের। সান্ত্বনার বাবা অর্থাৎ নাবালিকার দাদুর বয়ান অনুসারে, তাঁর নাতনি সবসময় ভয় পেত। সামান্য ঝড় উঠলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত।
অভিজিৎ মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন মুখোশ পরে সান্ত্বনার মেয়েকে ভয় দেখাত। তার এই কাণ্ডের ফলে নাবালিকার মানসিক কোনও বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল কিনা সেটা ভাবায় তদন্তকারীদের। মানসিক নির্যাতনের তত্ত্ব উঠে আসে। একইসঙ্গে ছাত্রীর মৃত্যুতে শারীরিক নির্যাতন হয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে শুরু করে পুলিশ। আর চূড়ান্ত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসতেই দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায়।

শুরুতে পরিবারের দাবি ছিল, বেশকয়েকদিন ধরেই ভূতের ভয়ে মেয়েটি নাকি মানসিক চাপে ছিল। উঠতে-বসতে আঁতকে উঠছিল। এরপর ঘটনার দিন বাথরুমে গিয়ে হঠাৎই অচৈতন্য হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যায়। পরিবারের দাবি সেরকমই। কিন্তু ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলছে অন্য কথা!

তাহলে কি শ্বাসরোধ করে খুন? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়েটির গলায় শ্বাসরোধের চিন্হ থাকলেও হাত দিয়ে শ্বাসরোধ করলে যে গভীর দাগ হয়, এক্ষেত্রে তা একেবারেই নয়। স্বাভাবিক ভাবে ধন্দে পড়েছেন তদন্তকারীরা। তাহলে যে সামান্য দাগ রয়েছে গলায়, সেটা কোথা থেকে এল?

তবে তদন্তে নেমে সবচেয়ে সন্দেহজনক লেগেছে পুলিশের, যখন তারা জানতে ১০ বছরের ছোট্ট মেয়ের মৃত্যুর কথা শোনার পরেও কীভাবে একজন মা তার প্রেমিককে নিয়ে
হাসপাতাল থেকে বেপাত্তা হয়ে যায়। পোস্টমর্টেমের কথা শোনার পরই সান্ত্বনা তার প্রেমিক অভিজিৎ-এর এমন অস্বাভাবিক আচরণ তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন তোলে। আরও একটি জায়গায় সন্দেহ দানা বাঁধে। হাসপাতালে ফোন নম্বর সঠিক দিলেও কেন বাড়ির ভুল ঠিকানা দিয়েছিলেন নাবালিকার মা?

সন্দেহ আরও একটি জায়গায় দানা বাঁধে। নাবালিকার মা সান্ত্বনা ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, প্রচণ্ড পেটের যন্ত্রণা, ধুম জ্বর নিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল তার মেয়ে। এক প্রকার জোর করে বিছানা থেকে তুলে তাকে প্রথমে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন, তীব্র পেটের যন্ত্রণা নিয়ে কেউ অঘোরে ঘুমাতে পারে? জেরায় সদুত্তর দিতে পারেননি সান্ত্বনা।

এখানেই শেষ নয়, ভূত তত্ত্ব নিয়ে একটি প্রশ্নেরও সঠিক জবাব দিতে পারেননি সান্ত্বনা। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। আর তাতেই ছাত্রীর মৃত্যুতে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।

Previous articleঅতিমারির কারণে বন্ধ হলো ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর টানেল তৈরির কাজ
Next articleচির বিদায়: বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে শেষকৃত্য শুভ্রজিতের