Sunday, December 28, 2025

শুভ্রজিৎ, অশোক, লক্ষ্মী, দেবদত্তার মৃত্যুর পরেও নেই হেলদোল! অভিজিৎ ঘোষের কলম

Date:

Share post:

এই লেখার শুরুতেই আমি বলে রাখি, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বদনাম করতে আমি বসিনি। কোভিড চিকিৎসার দফারফা হয়েছে এ রাজ্যে, এমন কথা বলারও আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। বরঞ্চ, আমি খোলা মনে, কোনওরকম রাখঢাক না করে মুক্তকণ্ঠে বলতে চাই… রাজ্যে যারা কোভিড চিকিৎসা করছেন, সেইসব ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আমি স্যালুট জানাচ্ছি। কথায় কথায় পেশেন্ট পার্টি যাদের গায়ে হাত তোলেন, ডাক্তার, নার্সরা মেরে ফেলেছে বলে ভাঙচুর, মারধর, রক্তারক্তি ব্যাপার ঘটে, তারাই আজ বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীই হিসাব দিয়েছেন, শুধু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে ৩০জন ডাক্তার আর ৪৩জন নার্সিং স্টাফ কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। বেসরকারি হাসপাতালের কথা ধরলে সংখ্যাটা আরও বেশি। তবু তাঁরা ব্যাটল ফিল্ড ছেড়ে পালাননি। জেদ বাড়ছে, অভিজ্ঞতা বাড়ছে, সাহস বাড়ছে। ফলে লড়াইয়ের জাঁতাকলে কোভিডের যে মারমুখী চিত্রটা ছিল, সে নিজেই এখন নিজের উইকেট বাঁচাতে ব্যস্ত।

তবু রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে একটার পর একটা চিত্র রোজই কোথাও না কোথাও দেখতে হচ্ছে। আমজনতার পক্ষে যা সত্যি বেদনাদায়ক। যে চিত্রটা নিশ্চিতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে যায় না, মানানসই নয়। প্রশ্ন তাহলে, মুখ্যমন্ত্রী কী করছেন?উত্তরে বলি, মুখ্যমন্ত্রী সাত কাজে ব্যস্ত। কোন হাসপাতাল কাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, কে হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ক্রেডিট নিচ্ছেন, আর মানুষকে ডোবাচ্ছেন, সেটা মুখ্যমন্ত্রীর দেখার বিষয়ও নয়, জানা সম্ভবও নয়। তাহলে? প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যের একজন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী তো আছেন। আর তিনি নিজেই ডাক্তার। কিন্তু তিনি কোথায়? গোটা কোভিড পিরিয়ডে তাঁকে দেখাই গেল না। না, ভুল কথা, তাঁকে ভার্চুয়াল দেখা গিয়েছে। ভারি সুন্দর কথা.. ভার্চুয়াল, আছি কিন্তু নেই বা নেই কিন্তু আছি। চন্দ্রিমা অনেকটা তাই। বিরোধী দলের নেতারা তোপ দাগলে চন্দ্রিমা আছেন। ফোনে আছেন, হোয়াটস অ্যাপে আছেন, প্রয়োজনে দীর্ঘ বক্তৃতাতেও আছেন। কিন্তু তাঁকে দূরবীন দিয়ে দেখেও পাওয়া গেল না..শুভ্রজিৎ অশোক, লক্ষ্মী কিংবা দেবদত্তার মতো বহু পরিবারের পাশে। একটার পর একটা মানুষ মারা যাচ্ছেন, পরিবার শেষ দেখাও দেখতে পারছেন না, সেই পরিস্থিতির মাঝে একদিনও আপনাকে দেখা গেল না। আপনারা নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক, যিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেন। এই আপনাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নমুনা!

মাননীয় চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কয়েকটা ছোট্ট প্রশ্ন..

১. মিডিয়ার দৌলতে খবর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আপনার ড্রয়িংরুমে পৌঁছে যায়। আপনি দেখেছেন শুভ্রজিতের বাবা-মায়ের আর্তি? শুভ্রজিতের বাবা-মা যখন দেখছেন, তাঁদের ছেলের দেহ বের হচ্ছে মর্গ থেকে (তাও মামলা করে), দৃশ্যটা ভাবুন, পারলে ‘এখন বিশ্ববাংলা সংবাদ’-এ ফের দেখুন। আদৌ চোখে দেখা যায়! আপনি পারবেন? ওই সময়ে আপনি পাশে দাঁড়িয়ে একটু হাতটা ধরলে ওরা চোখের জল ফেলে একটু শান্ত হতে পারতেন, একটু আশ্রয় পেতেন, ভরসা পেতেন। কিন্তু আপনি তখন কোথায় চন্দ্রিমা?

২. মেডিক্যালে আশোকের নিথর দেহটা স্ট্রেচার করে নামানোর পর ওর বাবার আর্তি শুনেছেন? আমার ছেলের করোনা হয়নি, টাইফয়েড হয়েছিল… এ কোথায় নিয়ে এলাম আমার বাবাকে!! অপেক্ষা করতে করতেই মৃত্যু। ঠিক সেই সময় দেবদূতের মতো (!) হাজির বউবাজার থানার পুলিশ। তারা বডি নেবে। ভীত সন্ত্রস্ত বাবা, ছেলেকে হারানোর পর তার দেহটা হারাতে চাননি। তাই দ্রুত দেহটা নিয়ে গিয়ে, প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে দৌড় সোজা বাড়ির পথে। ভাবুন অবস্থা… ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। একবার হাসপাতালে গিয়ে জানতে চাইলেন না কেন ছেলেটিকে ভর্তি করা গেল না? কেন চিকিৎসা দেওয়া গেল না! হাসপাতালের বাইরে স্ট্রেচারেই পড়ে কেন মৃত্যু হল? মায়ের মন বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে, সেটাও জাগল না?

৩. কিংবা বাগবাজারের লক্ষ্মী সাউ? ভালো হয়ে গেছে বলে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল। আবার সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে রিকশাভ্যানে করে দুই মেয়ে মাকে নিয়ে এল। বাইরে পড়ে থেকে মৃত্যু হল, কিন্তু বেড পাওয়া গেল না। কেন? মাননীয় মন্ত্রী কেন? রাজ্যের কোনও বিরোধী নেতা লকডাউন আইন ভেঙেছেন বলে তার বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা এফআইআর, মিছিল কোনও কিছু তো বাদ থাকে না। আর এই ক্ষেত্রে একটু ফোন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বারবার এমন ঘটনা কেন ঘটছে?

৪. কিংবা চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়। কোভিড হাসপাতালে বেড পেলেন না। হতভাগ্যের শ্রমজীবী হাসপাতালে মৃত্যু। যিনি ছিলেন কোভিডে ফ্রন্ট ওয়ারিয়র! হতভাগ্যের পুরো পরিবার কোভিডে আক্রান্ত। একবার খোঁজ নেওয়া গেল না দেবদত্তার পরিবারের! পরিবারটাই তছনছ হয়ে গিয়েছে। তারপরেও মোবাইলে হাত পড়ল না!

অবাক হয়ে জানতে ইচ্ছে করে… ১.এই যে ঘটনাগুলো এটা তো ডাক্তার নার্সদের দায় নয়, হাসপাতাল কর্তাদের ব্যর্থতা, ম্যানেজমেন্টদের ব্যর্থতা। তারা ঠাণ্ডা ঘরে না বসে একটু হাসপাতালের বাইরে এসে দাঁড়ান না। একটু কথা বলুন না মানুষের সঙ্গে, এই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির মধ্যে। তাঁরা ভর্তি করতে না পারলে একটু অন্য হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিন না। এই নির্দেশ আপৎকালীন পরিস্থিতিতে দিতে পারেন না? হাসপাতালের বাইরে একটু ক্যাম্প করে বসুন না কর্তারা। তাহলে তো টের পাবেন দুনিয়াটা কোন চালে চলছে।

৫. কেন হাসপাতালের বাইরে ডিসপ্লে বোর্ড থাকবে না! কেন হাসপাতালের টাউটদের কাছ থেকে বেড ভিক্ষা পেতে হবে? স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে কি এটা পড়া না?

৬. একদিনের জন্য নিদেনপক্ষে কলকাতার হাসপাতালগুলোয় ভিজিট করেছেন? একবারও সরেজমিনে দেখে এসেছেন কোন চালে চলছে কোভিড হাসপাতাল?

৭. তাহলে মাননীয় মন্ত্রী, জেলা হাসপাতালগুলোর কথা একবার ভাবুন। সেখানে তো আপনার যাওয়ার প্রশ্নই নেই, তাই না?

৮. হাসপাতাল এলাকার কাউন্সিলর, বিধায়করা কোথায় গেলেন? ভর্তির জন্য তাঁরা ফোন করতে পারেন, রেকমেন্ড করতে পারেন, আর হাসপাতালের বিবেকহীন পদক্ষেপ রুখতে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না কেন! ভোটের সময় একই বুথে সব দল বুথ করে শক্তি প্রদর্শন করতে পারে, এই অসময়ে তাঁরা কোথায়?

৯. বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে কোভিড প্যাকেজ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করছে। মাননীয় মন্ত্রী এগুলো আপনার চোখে পড়ে না?

মাননীয় চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, উদাহরণের তালিকা লম্বা, অভিযোগের তালিকাও বেশ বড়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের হৃদয়হীনতা। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির কথা বললাম। কারণ, রাজনীতিবিদদের স্মৃতিশক্তি আজকাল বড্ড দুর্বল মনে হয়। দশটা বছরও হয়নি, বাম আমলের শেষবেলায় ঠিক এসব রোগই দেখা যেত। আর আপনারাই তখন গলা ফাটাতেন। আর এখন বলছেন, বড্ড বেশি মিডিয়া নেগেটিভ প্রচার করছে। প্রয়োজনে মহামারী আইন প্রয়োগ করা হবে। মাননীয় মন্ত্রী, আইন প্রয়োগ করুন, মানুষের মন পরিবর্তন করতে পারবেন তো!

spot_img

Related articles

‘ভূমিকম্পের আগে’, উৎপল সিনহার কলম 

বাইরে আমি হিরো হলেও ঘরে কুনো ব্যাঙ... কুনো ব্যাঙকে নিয়ে যারা মজা-মস্করা করেন তাঁদের এবার একটু সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা...

বিষ্ণুপুরের জিতের অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা, অভিনেতা মঞ্চ ছাড়তেই ভাঙচুর শুরু

৩৮তম বিষ্ণুপুর মেলায় (Bishnupur Mela) সুপারস্টার অভিনেতা জিতের (Jeet) অনুষ্ঠান ঘিরে বিশৃঙ্খলা। টলিউড তারকাকে দেখতে ভিড় এতটাই বেড়ে...

উইক এন্ডে রোজগার দ্বিগুণ, অন্ধ্রপ্রদেশে কুমোররাও খুঁজে পেয়েছেন নতুন পথ

এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। যে তথ্য প্রযুক্তি একসময় গ্রামের যুবকদের গ্রাম ছাড়া করেছিল, ভুলিয়ে দিয়েছিল পূর্বপুরুষের...

খালেদার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি, অতি সংকটজনক পরিস্থিতি বলছেন চিকিৎসকরা

অতি সংকটজনক বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া Former Prime Minister of Bangladesh and BNP Chairperson...