দার্জিলিং কাঁদছে, ডুয়ার্স বিষণ্ণ শুনতে পাচ্ছ নবান্ন, কিশোর সাহার কলম

কিশোর সাহা

ধারদেনা করে হোম স্টে তৈরি করেছিলেন ওঁদের অনেকেই। কেউ ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছেন। কারও ধার এলাকার সুদের কারবারির কাছে। কেউ কেউ পর্যটকদের ঘোরাফেরা করানোর জন্য বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে বড় গাড়িও কিনেছেন। কিন্তু, করোনা ও লকডাউনের জাঁতাকলে কেউ কাঁদছেন। কেউ বিষাদে ডুবে রয়েছেন।

দার্জিলিং থেকে ডুয়ার্স—এমনই বিষাদের ছবি। রোজই কোনও না কোনও পরিবহন ব্যবসায়ীর মাথায় হাত পড়ছে। কারণ, বেসরকারি সংস্থা ঋণের টাকার কিস্তি না পেয়ে লোকলস্কর পাঠিয়ে গাড়ি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও ঋণের টাকা দিতে না পেরে হোম স্টের আসবাব বিক্রি করতে হচ্ছে। কেউ আবার আগের কয়েক বছরের লাভ থেকে জমানো টাকায় কেনা জমি বিক্রি করে ধার শোধ করেছেন।

এখানেই শেষ নয়। পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও রয়েছে। উত্তরবঙ্গের পর্যটন ব্যবসার এক প্রথম সারির উপদেষ্টা আক্ষেপের সুরে জানান, গত এপ্রিল থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি অবধি পাহাড় ও ডুয়ার্স মিলিয়ে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই পর্যটন উপদেষ্টা জানান, যে পরিস্থিতি চলছে তাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন ক্ষেত্র না খুললে অনেক ঘরসংসারই ভেসে যেতে পারে।

কিন্তু, কীভাবে খুলতে পারে পর্যটন ক্ষেত্র! কয়েকজন ট্যুর অপারেটর জানান, যেভাবে সরকারি পর্যটন ক্ষেত্র খুলে দেওয়া হয়েছে, সেভাবেই বেসরকারি ক্ষেত্র খোলার কথা ভাবতে হবে। প্রয়োজনে ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, গাইড, হোটেল, রিসর্ট, হোম স্টে-এর মালিকদের নিয়ে স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। তার পরে পর্যায়ক্রমে পর্যটন ক্ষেত্র চালু করার কথা ভাবা হোক।

ঘটনা হল, লকডাউনের কারণে দার্জিলিঙের পর্যটন মহলের বহু কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ডুয়ার্সেও বিপুল অঙ্কের টাকার ক্ষতি হয়েছে। বড় হোটেল, রিসর্টের মালিকরা কোনওমতে চালাতে পারলেও মাঝারি ও ছোটখাট হোম স্টের কর্ণধাররা চরম বিপাকে পড়েছেন। দার্জিলিঙের জলঢাকা, তাকদা-সহ কয়েকটি এলাকার একাধিক হোম স্টে মালিক ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কয়েকজন জানান, এভাবে যদি পুজোটাও কাটে তা হলে ঋণের দায়ে অনেক কিছুই বিক্রি করে প্রায় পথে বসতে হতে পারে।

ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি, জলদাপাড়া, মাদারিহাট-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় হোম স্টে, মাঝারি ও ছোট মাপের হোটেল, রিসর্ট, হোম স্টের ব্যবসায়ীরা গাঢ় বিষাদে ডুবে রয়েছেন। কীভাবে বিনিয়োগ করা টাকা উঠে আসবে সেটা ভেবে অনেকে রাতে ঘুমোতে পারছেন না। এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি গত জানুয়ারিতে ৩টি গাড়ি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কিনে ট্যুর অপারেটরদের কাজে দিয়েছিলেন। এখন কিস্তির টাকা দিতে না পারায় দুটি গাড়ি ঋণদানকারী সংস্থা নিয়ে গিয়েছে। আরেকটি গাড়ি নিয়ে রোগী পৌঁছনোর কাজ করে কোনমতে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

পাহাড় থেকে ডুয়ার্স পর্যটন ব্যবসার হাল কতটা ভয়াবহ তা নেতা-মন্ত্রীদের কাছেও জানিয়েছেন ট্যুর অপারেটররা। একজন ট্যুর অপারেটর তথা তাঁদের সংগঠনের কর্তা জানান, এভাবে বছরটা চললে আগামী বছরে তাঁদের অনেককেই হয়তো বিপিএল কার্ডের খোঁজ করতে হবে। উত্তরবঙ্গের পর্যটন প্রসারে যাঁর ভূমিকা প্রায় সকলেই মানেন সেই রাজ বসু জানান, রোজই পাহাড় থেকে ডুয়ার্সে নানা খারাপ খবর পাচ্ছেন তাঁরা। তিনি জানান, সব কিছুই নানা সময়ে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের স্থানীয় প্রতিনিধি তথা সংসাদদের জানানো হয়েছে। কিন্তু, বিজেপির সাংসদদের পক্ষ থেকে চিঠিচাপাটি লেখা ছাড়া কেন্দ্র থেকে কোনও অনুদান আনার ব্যবস্থাই হয়নি বলে জানান তাঁরা।

এই অবস্থায় ভরসা বলতে সেই নবান্ন। কিন্তু, লক্ষাধিক ট্যুর অপারেটর, গাইড, ট্রাভেল এজেন্ট, গাড়ির চালক, খালাসি, কুলি, ছোটখাট দোকানদার, দু-চার কামরার হোম স্টের মালিকদের সাহায্য করতে নবান্ন কীভাবে, কবে উদ্যোগী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Previous articleরবি ঠাকুর নিজে গাছের তলায় বসে পড়তেন-পড়াতেন, সেখানে পাঁচিল কেন? প্রশ্ন ফিরহাদের
Next articleসেপটিক ট্যাংকে বিষাক্ত গ্যাস! মৃত্যু দুই কর্মীর