বেলপাহাড়ি। জায়গাটার নাম বললেই, সবচেয়ে আগে মনে হয় ভয়। কারণ, এ নাম জড়িয় মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে।মনে হয় বড় বিপজ্জনক জায়গা বুঝি!এমন জায়গাতেই শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে, বিদ্যালয়ের ভোল বদলে শিক্ষারত্ন পেলেন শিক্ষক সোমনাথ দ্বিবেদী।

জঙ্গল ঘেরা ঝাড়গ্রামের অখ্যাত এই গ্রামটিতে আদিবাসী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এখন স্বপ্ন দেখে। আর অসংখ্য ছেলেমেয়ে ও তাঁর বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখানোর নেপথ্যে রয়েছেন সোমনাথ স্যার। বেলপাহাড়ি তপশিলি জাতি উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা তো বটেই, অভিভাবকরাও মাস্টারমশাইয়ের নাম শুনলে শ্রদ্ধায় নত হন।


কলকাতায় যে মানুষটির বড় হওয়া পড়াশোনা সেই সোমনাথ স্যার এখন বেলপাহাড়ির একজন, বড় আপনজন।তিনি যখন ১৯৯৯ সালে শিক্ষক হয়ে এসেছিলেন, তখন স্কুলবাড়ি ছিল মাটির। পড়ুয়া সংখ্যাও কম। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর গ্রাম্য স্কুলের চেহারা বদলেছে। স্কুলবাড়ি এখন পাকা ঝকঝকে। বেলপাহাড়ির মতো জায়গায় স্কুলে বসেছে সিসিটিভি, ব্যবস্থা হয়েছে ইন্ডোর গেমসের,জিমের। রয়েছে স্মার্ট ক্লাসরুম। স্কুলের শুধু বিশাল খেলার মাঠই নেই, আছে সাজানো বাগানও।

আরও পড়ুন : আনলক পর্বে উইকএন্ডে চলুন গড় পঞ্চকোট


বাংলার পাশাপাশি স্কুলে সাঁওতালি ভাষায় পুরোদমে পড়াশোনা হয় বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। গ্রাম্য সরকারি স্কুল থেকে ক্রমশ যখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমছে, তখন এই স্কুলে বাড়ছে পড়ুয়ার সংখ্যা। সেটা এখন প্রায় ১৭০০। বেলপাহাড়ির গ্রামের ছেলেমেয়েরা নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস করছেন। স্কুলে মিড-ডে মিলের ঘর থেকে পানীয় জল, শৌচালয়, হোস্টেল সমস্ত কিছুই সদর্পে জানান দিচ্ছে অখ্যাত গ্রামে শিক্ষা আছে। আছে উন্নয়ন। আছে স্বপ্ন পূরণের উপায়ও।


কীভাবে করলেন এসব সোমনাথ স্যার?

জানালেন কাঁথির ছেলে তিনি। পড়াশোনা কলকাতায়। এসএসসি দিয়ে চাকরি বেলপাহাড়িতে। ১৯৯৯ সাল তখন। গ্রাম্য বেলপাহাড়িতে কী করে চাকরি করবেন বড্ড ভয় হয়েছিল। কিন্তু গ্রামটিতে আসার পর এখানকার সরল আদিবাসী মানুষগুলো যেভাবে শহুরে শিক্ষককে আপন করে নিলেন, তাতে আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। কয়েকটামাস যেতে না যেতেই বেলপাহাড়ি তপশিলি জাতি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহশিক্ষক হয়ে আসা সোমনাথ স্যার বুঝেছিলেন এ গ্রামের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। স্কুলকে ভালোবেসে, তাগিদ অনুভব করেছিলেন গ্রাম্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। প্রশাসন ও অন্যান্য শিক্ষক, গ্রামের মানুষদের সহযোগিতায় তাই বেলপাহাড়ি তপশিলি জাতি উচ্চ বিদ্যালয় এক উজ্জ্বল নাম। আর তাঁর নেপথ্যের সোমনাথ স্যার সকলের শ্রদ্ধেয়।এখন তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সহশিক্ষক হয়ে যোগ দেওয়ার পর এসএসসি দিয়ে প্রধান শিক্ষক হন তিনি। এই স্কুলকেই বেছে নেন কর্মক্ষেত্র হিসেবে।

বেলপাহাড়ি বললেই যে মাও আন্দোলন, অবরোধ, সন্ত্রাস ভেসে ওঠে!

না মাস্টারমশাই সেদিন ভয় পাননি। তাঁকে আগলেছিলেন গ্রামের মানুষ। স্ত্রীও সমর্থন জুগিয়েছিলেন। তাই মাও আন্দোলন যখন সংবাদপত্রের শিরোণাম নির্বিঘ্নেই স্কুল চালিয়েছেন তিনি।পরিকল্পনা করেছেন কীভাবে গ্রামের মানুষের, স্কুলের উন্নয়ন সম্ভব। তাই স্কুলে জল ধরো জল ভরো প্রকল্পে জলের অভাব নেই।গ্রামেও ছেলেমেয়রা স্মার্টফোন ক্লাস করছে। স্কুলের তরফে করোনার সতর্কবাণী প্রচার হয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বিলির সময়।


আর মাস্টারমশাই নিজে দায়িত্ব নিয়ে দুঃস্থ পড়ুয়াদের পড়াশোনার সরঞ্জাম পৌঁছ দিয়েছেন বিভিন্ন গ্রামে। আমফানের ত্রাণ থেকে স্কুলের বাইরের নানা সামাজিক কাজে এগিয়ে এসেছেন সোমনাথ স্যার।ঝাড়গ্রামেই পাকাপাকিভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি। বেলপাহাড়ির সঙ্গে তাঁর যে টান, তা কোনওদিনই অস্বীকার করতে পারবেন না বলে করোনা আবহে ভেবেই চলেছেন, কীভাবে স্মার্টফোন না থাকা পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছনো যায়! কীভাবে আদিবাসী মেয়েদেরও শিক্ষার আওতায় আরও বেশি করে আনা যায়।ভাবছেন প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে যদি প্রশাসনের অনুমতি স্বাপেক্ষে গরিব স্কুলপড়ুয়াদের একটু সাহায্য করা যায়। তাদের তো পড়াশোনা দেখানোর কেউ নেই।

সোমনাথ স্যারের ভালো কাজের সহযোগী তাঁর সহকর্মী, পড়ুয়া ও গ্রামের মানুষরা। কিছু কাজ করোনা পরিস্থিতিতে অর্ধেক হয়ে পড়ে রয়েছে। সেগুলো দ্রুত সারার পাশাপাশি মাস্টারমশাইয়ের ভাবনা মেয়েদের হস্টেলটা যদি বড় করে ভালো করে ব্যবস্থা করা যেত!

শিক্ষারত্ন সোমনাথ স্যার চান, কালের নিয়মে যেদিন তিনি থাকবেন না সেদিনও যেন বেলপাহাড়ি শিক্ষার আলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে।
আরও পড়ুন : আয়ুষ্মান ভারত লাগু না করায় পশ্চিমবঙ্গ-সহ চার রাজ্যকে সুপ্রিম নোটিশ