সংসদীয় গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রবণতা রুখতেই হবে : সুখেন্দু শেখর রায়

সুখেন্দু শেখর রায়
সাংসদ, রাজ্যসভা

রাজ্যসভায় রবিবার ও সোমবার কৃষক স্বার্থ সংক্রান্ত দুটি বিলকে কেন্দ্র করে যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হল তা অভূতপূর্ব, অনৈতিক এবং পরিষদীয় রীতিনীতি তথা সংবিধান বিরোধী। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আমি ভারতীয় সংবিধানের ১০০ নং ধারার উল্লেখ করবো৷ সেখানে বলা হয়েছে, ”…. all questions at any sitting of either House or joint sitting of the Houses shall be determined by a majority of votes of the members present and voting…” অর্থাৎ সংসদের দুই কক্ষেই (রাজ্যসভা ও লোকসভা) সমস্ত প্রশ্ন উপস্থিত সদস্যদের ভোটদানের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। রাজ্যসভার পদ্ধতি ও নিয়মাবলীর ১২৫ নং বিধিতে বলা হয়েছে, “Any member may move an amendment that a bill be referred to a select committee and if, the motion is carried, the bill shall be referred to such a committee.” অর্থাৎ কোনও সাংসদ যদি কোনও বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর উদ্দেশ্যে কোনও সংশোধনী পেশ করে এবং সেই সংশোধনী যদি ভোটাভুটিতে পাশ হয়, তাহলে বিল সিলেক্ট কমিটিতেই যাবে।

বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর জন্যে রবিবার রাজ্যসভায় তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন ও অন্যান্য বিরোধী সাংসদ একাধিক সংশোধনী নির্দিষ্ট নিয়মে জমা দিয়েছিলেন৷ বিতর্কিত এই কৃষি বিল সিলেক্ট কমিটিতে যাওয়ার পর, নিয়ম অনুযায়ী কমিটি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কৃষক সংগঠন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য শুনবে এবং শোনার পর সিলেক্ট কমিটি বিল সম্পর্কে যথাযথ সুপারিশ সভার কাছে পাঠাবে। এটাই নিয়ম৷ কিন্তু রবিবার এই নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে৷ দেখা গেল, কৃষি বিল নিয়ে আলোচনা চলছে। সরকার ও বিরোধী পক্ষের সাংসদরা নিজেদের দলীয় অবস্থান অনুযায়ী বক্তব্য রাখছেন। বিরোধীরা সিলেক্ট কমিটির দাবিও তুলেছে। এমনও দেখা গিয়েছে, ওই দাবির পক্ষে গলা মেলালেন এনডিএ-শরিক অকালি দলের তিন সাংসদ ও সবসময় সরকারের পাশে থাকা বিজু জনতা দলও। বিল নিয়ে আলোচনা শেষ হওয়ার পর এতাবৎ প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী ১২৫ নং বিধি অনুসারে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাবার যে সমস্ত সংশোধনী জমা পড়েছিল তা ভোটাভুটির জন্য গ্রহণ করা বাধ্যতামূলেক ছিল।

কিন্তু তা করা হল না। কেন করা হল না তার কোনও ব্যাখ্যা না দিয়েই ডেপুটি চেয়ারম্যান সরাসরি ঘোষণা করে দেন, দুটি বিলই ধ্বনি ভোটে পাশ হল। এই ঘোষণা অভূতপূর্ব,অসাংবিধানিক, বেআইনি-ই শুধু নয়, এটি এক চরম কর্তৃত্ববাদী, পক্ষপাতমূলক পদক্ষেপ। কারণ, ( ১) সংবিধানের ১০০ নং ধারার নির্দেশ অনুসারে কোনও বিলে উপস্থিত সাংসদদের ভোট নেওয়া হলনা, যা ছিল বাধ্যতামূলক। (২) রাজ্যসভার ১২৫ নং বিধি অনুসারে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর সংশোধনীতেও ভোটাভুটি করা হলনা।

সাংবিধানিক পদে থাকার কারনে যার নিরপেক্ষ থাকার কথা, সেই ডেপুটি চেয়ারম্যান এইভাবে দেশের সংবিধান ও রাজ্যসভার নিয়মাবলীকে পদদলিত করলেন। রাজ্যসভার ৬০ বছরের ইতিহাসে এমন নজির নেই। স্বাভাবিক কারনেই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রবল বিক্ষোভ দেখালেন বিরোধী সাংসদেরা। কোথাও হয়তো মাত্রা ছাড়াল। কিন্তু every action has its equal and opposite reaction। তর্কশাস্ত্রের ভাষায় একে ‘প্রকৃতির একরূপতা’ বলে।

এরপর আজ, সোমবার সভার কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় চেয়ারম্যান অন্তত ৪০ জন সাংসদ স্বাক্ষরিত ডেপুটি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনা ‘অনাস্থা প্রস্তাব’ খারিজ করে দেন। এখানেই শেষ নয়, সরকারি প্রস্তাব অনুযায়ী তৃণমূল নেতা ডেরেক, দোলা সেন-সহ আটজন সাংসদকে চলতি অধিবেশনের বাকি দিনগুলির জন্য সাসপেন্ড করেন। সভাপতির এই দুটি রুলিংও একতরফা এবং স্বাভাবিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত নীতির পরিপন্থী। কারণ, অভিযুক্ত সাংসদদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগই দেওয়া হয়নি। তাছাড়া যারা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন, তাদের বক্তব্যও শোনা হয়নি। আসলে গতকালের বেআইনি পদ্ধতি ও সংবিধান- বিধি লঙঘনের যাবতীয় অপকর্ম থেকে নজর ঘোরানোর উদ্দেশ্যেই মাননীয় চেয়ারম্যানের আজকের এই নিদান।

যে মূল প্রশ্নটি কেউ তুলছেন না তা হল, রবিবার ভোটাভুটি করা হল না কেন? কারণ, সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট ছিল না। হুইপ জারি করা সত্ত্বেও বিজেপি ও শরিকদের বহু সাংসদ অনুপস্থিত ছিলেন। তারাও কি কৃষি বিলের বিরুদ্ধে? না হলে হুইপ থাকা সত্বেও তারা এদিন এলেন না কেন? জানি না। তবে এটুকু জানি, বিরোধী পক্ষের সম্মিলিত ভোট সরকারি দল ও সহযোগীদের তুলনায় অন্তত ৫টি বেশি ছিল।

তাহলে কী একমাত্র এই কারণেই সংবিধান ও সংসদীয় প্রথাকে পদদলিত করা হল?

আইনসভা,বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল, সিএজি, ইউপিএসসি, এ্যাটর্ণি জেনারেল ইত্যাদি বহু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষ আমাদের দেশে রয়েছে। একটাই কারনে এদের প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে জনগণের কল্যাণে সংবিধান নির্দেশিত পথে নিরপেক্ষভাবে নিজেদের পরিচালিত করেন। তাদের শপথ গ্রহণের সময়েই তো এই অঙ্গীকার করতে হয়। কখনও যদি কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা আধিকারিক সমস্ত নীতিনির্দেশকে অগ্রাহ্য করে সংখ্যাধিকতার উদগ্র শক্তির কাছে নতজানু হয়ে পড়ে, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়। কদর্য ও বীভৎস কর্তৃত্ববাদী অপশক্তি পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে।

এই প্রবণতা রুখতেই হবে।

আরও পড়ুন- দুই দলীয় সাংসদের সাসপেনশনের ঘটনার তীব্র নিন্দা তৃণমূল সাংসদদের