বিহার হাতছাড়া হলে দায় অজয় বিস্তের, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

◾উত্তর প্রদেশে এক দলিত-কন্যার গণধর্ষণ ও মৃত্যু৷ এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত দলিত সম্প্রদায়৷ উত্তর প্রদেশ ছাড়িয়ে সেই ক্ষোভের আগুন ভোটের মুখে পৌঁছে গিয়েছে বিহারেও৷

◾ ‘বিহার-কি-পুত্র’ সুশান্ত রাজপুতের খুনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি খারিজ করেছে AIIMS কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক সুধীর গুপ্তের নেতৃত্বে একটি দল অভিনেতার পোস্টমর্টেম এবং ভিসেরা রিপোর্ট আরও একবার পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ হিসাবে আত্মহত্যাকেই চিহ্নিত করেছেন।

◾ বিহারের গয়ায় ধর্ষিত হয়ে দলিত কিশোরীর আত্মহত্যা৷ ভোটের মুখে বিহারে এক দলিত-কন্যার এই পরিনতিতে চাপে পড়েছে নীতীশ কুমার সরকার।

এই সব ঘটনা ভোটের মুখে কপালের ভাঁজ চওড়া করছে বিজেপি- নীতীশ কুমার জোটের৷ আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে বিহারের ২৪৩ আসনে হবে তিন দফার ভোট। পরবর্তী দু’দফার ভোট ৩ ও ৭ নভেম্বর। ফল ঘোষণা হবে ১০ নভেম্বর৷ নীতীশ কুমারের আশা এবার বিজেপির মদতে চতুর্থবার বিহারের মসনদে বসবেন। গত নির্বাচনে নীতীশ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন লালু প্রসাদের সমর্থন নিয়ে বিজেপিকে হারিয়ে৷ এবার উল্টো, ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে নীতীশ কুমার হাত মিলিয়েছেন বিজেপি’র সঙ্গে৷ লালু’র RJD ও কংগ্রেস জোটই তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ৷

২০১৫-র বিহার নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন নীতীশ কুমারের ‘রাজনৈতিক DNA’ নিয়ে৷ সেবার মোদির এই মন্তব্য বিহার-ভোটে ‘খেয়েছিলো’৷ আজও বিহারবাসীর মনে আছে এই মন্তব্য ৷ ২০২০-এর নির্বাচনে RJD- কংগ্রেস-সহ বিহারের বিজেপি বিরোধীরা মোদির ওই মন্তব্যকেই প্রচারের হাতিয়ার করেছেন পাটনার পথঘট ছেয়ে গিয়েছে মোদি-নীতীশের ছবি এবং মোদির ওই মন্তব্য লেখা ব্যানার-পোস্টার৷

ওদিকে, নীতীশের বড় আশা ছিলো বলিউডি সুশান্ত রাজপুতের মৃত্যুকে সামনে রেখেই পার হবেন ভোট-বৈতরণী৷ বিহার-পুত্র রাজপুতকে খুন করা হয়েছে, এই প্রচারও শুরু করেছে বিজেপি-JDU জোট৷ বিহারের ভূমিপুত্র সুশান্তের ছবি দেওয়া পোস্টারে বিহার ছেঁয়ে গিয়েছে৷ রাজপুতের ছবি এবং বিজেপির পদ্মফুলের ছবি দেওয়া এই পোস্টারে লেখা, ‘ না ভুলে হ্যায়, না ভুলনে দেঙ্গে”৷ সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে মহারাষ্ট্র-বিহার বিবাদ সর্বজনবিদিত৷ এই মৃত্যুর ফয়দা তুলতে বিজেপি বিহারের ভৈটের দায়িত্ব দিয়েছে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তণ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশকে৷ কিন্তু সেই স্বপ্নে ঠাণ্ডা জল ঢেলেছে AIIMS-এর রিপোর্ট, যাতে বলা হয়েছে, কোনও রহস্য নেই, রাজপুত আত্মহত্যাই করেছেন৷ ফলে নীতীশের এই হাতিয়ারও ভোঁতা হয়েছে৷

এবং নীতীশকে সব থেকে বড় বিপদে ফেলেছে হাথরাস৷ বিহারে দলিত-ভোট বিরাটভাবেই ফ্যাক্টর৷ ভারতে দলিতদের সংখ্যা, মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১৬ ভাগ। আবার বিহারের জনসংখ্যার শতকরা ১৮ শতাংশই দলিত৷ নীতীশের শরিক বিজেপি উত্তর প্রদেশের শাসক দল৷ ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি’র ‘পোস্টার-বয়’ অজয় বিস্ত৷ দলিত- কন্যার ধর্ষণ এবং মৃত্যু নিয়ে ওই বিস্তের একগুঁয়েমি এবং হাস্যকর কাজকর্ম এবং জেদে উত্তর প্রদেশের দলিত, পিছড়ে বর্গ এবং জনজাতি সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ ৷ সেই ক্ষোভের আগুন বিহারে দাবানল সৃষ্টির অপেক্ষায়৷ রামমন্দির আন্দোলনে বিজেপির সঙ্গী শিবসেনা তো উত্তর প্রদেশের বিস্ত সরকারকে নিশানা করে বলেই দিয়েছে, “উত্তরপ্রদেশে রামরাজ্য নয়, জঙ্গলরাজ চলছে।”

বিজেপির শীর্ষনেতারা এই ঘটনায় ফাটা বাঁশে আটকে গিয়েছেন৷ অজয় বিস্তের ‘অসাধারণ’ শাসন পদ্ধতি বিজেপিকে এখন সরু দড়ির উপর তুলে দিয়েছে৷ একদিকে ধর্ষণের সুবিচার করে দলিতদের হাতে রাখার চেষ্টা, অন্যদিকে ধর্ষকদের শাস্তি দিয়ে দলিতদের হাতে রাখতে হলে ঠাকুর-রা চটে যাবে৷ কারণ, ওই ধর্ষণ-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া ৪-জনই ঠাকুর তথা উচ্চবর্ণের ৷ ফলে বিজেপি বুঝেছে, বিহার ভোটে ঠাকুর বা উচ্চবর্ণ অথবা দলিত,জনজাতি বা পিছড়ে বর্গ, এই দু’তরফকেই একসঙ্গে এবার পাশে পাওয়ার আশা কম৷ একটি অংশ এবার উল্টোদিকেই ভোট দেবে৷

পাশাপাশি বিজেপি’র সর্বোচ্চ স্তর এটাও বুঝে ফেলেছে, অজয় বিস্তের ‘হাতযশে’ বিহারের বিরোধীরা খামোকা ‘পাশুপাত’ অস্ত্র হাতে পেয়ে গিয়েছে৷ হাথরাসের ঘটনা বুদ্ধি দিয়ে সমলাতে পারেনি আমলা ও পুলিশ৷ তবে এই দোষ পুলিশ ও প্রশাসনের বড়কর্তাদের নয়৷ মুখ্যমন্ত্রীর তরফে যে এমনই নির্দেশ ছিলো, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিজস্ব তদন্তে তা জেনে ফেলেছে৷ আর এটা জানার পরেই, বিজেপি অন্দরের খবর, বিজেপির তফসিলি মোর্চার প্রধান লাল সিং দলের শীর্ষ স্তরের নির্দেশে নিজেই অযজয় বিস্তের সঙ্গে কথা বলে, বিজেপি হাই কম্যাণ্ডের অসন্তোষ আর দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন। তারপরই চরম বিপাকে পড়ে অজয় বিস্ত নিজের পরের পর ‘ব্লাণ্ডার’ সংশোধন করে রাতারাতি সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী নেতানেত্রীদের হাথরাসে ঢোকার অনুমতি দেন৷ পুলিশকর্তাদের সাসপেণ্ড করেন৷ যদিও সাসপেণ্ড হওয়া পুলিশকর্তাদের মধ্যে সেই অফিসারও আছেন, যিনি ঝুঁকি নিয়ে চার ধর্ষককে গ্রেফতার করেছিলেন এবং তিনিই এই মামলার প্রথম তদন্তকারী অফিসার৷ এর পরই বিস্ত দিল্লির প্রবল চাপে ঘটনার সিবিআই তদন্তেরও নির্দেশ দিতে বাধ্য হন৷

বিজেপি শীর্ষনেতাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী অজয় বিস্ত মূর্খের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে, জোর করে, পরিবারকে না জানিয়ে, লুকিয়ে মাঝরাতে ডিজেল ঢেলে ওই দলিত তরুণীর দেহ জ্বালিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে পাঠিয়েছেন নিজেই৷ আর বিস্তের একের পর এক ভুল কাজের মাশুল দিতে হচ্ছে বিজেপিকে৷

এবং এমন আশঙ্কাও তেরি হয়েছে, অজয় বিস্তের অযোগ্যতায়, অদক্ষতায়, ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে বিজেপি-JDU জোটের হাতছাড়া হতে পারে বিহার৷

তেমন ঘটলে, পরদিনই না বিজেপি শীর্ষমহল উত্তর প্রদেশের নতুন মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে দেয় ৷

আরও পড়ুন-একাই বিজেপি’র বারোটা বাজাচ্ছেন অজয় বিস্ত, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

 

Previous articleনিঁখোজ নাবালিকার ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার ক্ষেত থেকে, ঘটনাস্থল ফের উত্তরপ্রদেশ
Next articleবিধানসভা ভোটে জোট নয়, নীতীশের বিরুদ্ধে প্রার্থী, সঙ্কট বাড়াল পাশোয়ানরা