একাই বিজেপি’র বারোটা বাজাচ্ছেন অজয় বিস্ত, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

উত্তরপ্রদেশ সরকারের গালে কষে এক থাপ্পড় মেরেছেন এবিপি নিউজের মহিলা সাংবাদিক প্রতিমা মিশ্র এবং চিত্রসাংবাদিক মনোজ অধিকারি৷

গোটা দেশ এবং বিদেশ দেখেছে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের সামনে কীভাবে উলঙ্গ হয়ে গেলো উত্তর প্রদেশ সরকার৷ এক মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট, একদল পদস্থ পুলিশ কর্তা, একপাল কনস্টেবল, হাবিলদারকে স্রেফ প্রশ্ন করে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন প্রতিমা৷ উত্তর দিতে ঘেমে-নেয়ে একশা উর্দিধারীরা৷ উত্তর একটাই, যেন রেকর্ডেড,কখনও বলে, ‘‘উপরওয়ালাদের বারণ আছে।’’ কখনও বলে, ‘‘করোনা আছে।’’ নির্যাতিতা পরিবারের কাছে সংবাদমাধ্যমকে কেন যেতে দেওয়া হবে না, তার উত্তর এদের কেউ শিখিয়ে দেয়নি, তাই এরা কিছু বলতেই পারেনি৷ কী অসহায় !

তবে প্রতিমার ওই থাপ্পড়েই ঘোর কেটেছে অজয় বিস্ত-এর৷ দেশজুড়ে ছিঃ ছিঃ রব প্রবল থেকে প্রবলতর হতেই হাথরাসের নির্যাতিতা পরিবারের কাছে সংবাদমাধ্যমকে যেতে দেওয়া হলো৷ তার আগে পর্যন্ত বিস্তের নির্দেশ ছিলো, হাথরসের ‘খবর’ করতেও দেওয়া যাবেনা সংবাদমাধ্যমকে৷

আরও পড়ুন- শ্রীযুক্ত যোগী, আত্মসম্মান থাকলে এক মাস মুখে কুলুপ এঁটে থাকুন, অভিজিৎ ঘোষের কলম

কী করছে না উত্তর প্রদেশ সরকার, যে সরকারের মাথায় আছে ‘হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত এক পোস্টার- বয়”৷ হাথরসের ওই দলিত তরুণীর ধর্ষণ নিয়ে কোনও সাংবাদিক টুইট করলেই অজয় বিস্ত সরকারের তথ্য অধিকর্তা শিশির সিং হুমকি দিয়েছেন, এভাবে ‘ফেক নিউজ ছড়ালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’৷ বলেছেন, ‘সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, হাথরসে এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না৷ এই নির্দেশ তা মানতেই হবে সবাইকে’৷

ঠিক কথা, ‘সরকার নিষেধাজ্ঞা’ জারি করলে তা মানতে হয়৷ কিন্তু ২০০৭ সালে সেই বোধ এবং বিবেচনা অজয় বিস্তের কোথায় ছিলো?

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে মহরম উৎসবের সময় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষে রাজ কুমার আগ্রহরি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়৷ সেই সময় বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অজয় বিস্ত ছিলেন গোরক্ষপুরের সাংসদ৷ তিনি ঘটনাস্থল পৌঁছে যান৷ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অজয় বিস্তকে জানান, ঘটনাস্থলে কাউকে যেতে দেওয়া হবেনা, নিষেধাজ্ঞা জারি আছে৷ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়াতে ওখানে যেন তিনি না যান। ওখানে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ বিস্ত এবং তাঁর দলবল সেই আদেশ পরোয়া না করে জোর করে, উত্তেজনা তৈরি করে, ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান৷ এরপরই তিনি ওই মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি ‘হেট-স্পিচ’ শুরু করেন৷
গোরক্ষপুরের তৎকালীন সাংসদ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “যদি কেউ হিন্দুদের ঘর ও দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি না যে আপনারাও সেই একই কাজ না করে ঘরে বসে থাকবেন”!

অজয় বিস্তের এই বক্তৃতা ভয়ঙ্কর অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য ট্রেন, বাস, মসজিদ, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিস্তের অনুগামীরা একটি মুসলিম কবরস্থানেও আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ কারফিউ জারি করে, কিন্তু অজয় বিস্ত সেই কারফিউও ভঙ্গ করেন৷ এর পরের ঘটনায় অন্তত ১০ জন প্রাণ হারান। ভারতীয় দণ্ডবিধি আইপিসির ১৫১এ, ১৪৬, ১৪৭, ২৭৯, ৫০৬ ধারায় বিস্তের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর পরে গোরক্ষপুরের সাংসদ এবং তাঁর জনাকয়েক চেলাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রেফতার করে পুলিশ৷

বিজেপি বড্ড ভালোবেসে অজয় বিস্তকে ‘ফায়ারব্র্যান্ড’ নামে ডাকে৷ এই বিস্ত বিতর্কিত এবং ঘৃণামূলক বক্তৃতা দিয়েই এই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তার ‘হেট স্পিচ’, তাঁর ‘হেটফুল অ্যাকটিভিটিজ’-এর পর
তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়৷

◾ ২০০৫ সালে উত্তর প্রদেশের এটোয়ায় খ্রিস্টানদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে অজয় বিস্ত এক ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’ করে৷ সেদিন প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টানকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিলো৷ একাধিক মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে ৷

আরও পড়ুন- যীশুর নিউ লুকে মুগ্ধ টলিউড, ছবি ভাইরাল

◾ ২০১১ সালে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে অজয় বিস্তের সেই ‘মূল্যবান’ উক্তি, “হিন্দুদের উচিত মুসলিম নারীদের কবর খুঁড়ে মৃতদেহ বার করে ধর্ষণ করা”। এই জঘণ্য ভাষণের জন্য বিস্তের বিরুদ্ধে হয়
একাধিক মামলা৷

◾ ২০১৪ সালে বিস্তের এক পুরোনো ঘৃণামূলক ভাষণের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস নেতা শেহজাদ পুনাওয়ালা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের কাছে একটি চিঠি লিখে বিস্তের বিরুদ্ধে FIR করেন৷

◾২০১৫ সালে অজয় বিস্তের এক বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণের ভিডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে বিস্ত আন্তঃধর্মীয় বিবাহের কথা উল্লেখ করে বলেন, “যদি মুসলমানরা একটি হিন্দু মেয়েকে নিয়ে যায়, তাহলে আমরা ১০০ জন মুসলিম মেয়েকে নিয়ে চলে যাবো”। তিনি বলেন, যদি মুসলিমরা একজন হিন্দুকে হত্যা করে, তাহলে আমাদের উচিত ১০০ জনকে হত্যা করা”। এই বক্তৃতার জন্যও মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে ৷

◾২০১৫ সালে সূর্য নমস্কার এবং যোগের কথা বলতে গিয়ে বিস্ত বলেছিলেন, “যারা যোগ এড়াতে চান তাদের হিন্দুস্তান ছেড়ে চলে যেতে হবে”৷ মামলা হয় এক্ষেত্রেও৷

আরও পড়ুন- ‘বিরাট’ ফর্মে কোহলি! রাজস্থানকে ৮ উইকেটে হারাল বেঙ্গালুরু

◾২০১৫ সালেই ‘অসহিষ্ণুতা’ বিতর্কে অজয় বিস্ত অভিনেতা শাহরুখ খানকে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হাফিজ সঈদের সাথে তুলনা করে বলেন, “এসআরকে-র মনে রাখা উচিত যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাকে তারকা বানিয়েছে, তারা যদি ওই শিল্পীর চলচ্চিত্র বয়কট করে, তাহলে তাঁকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এসআরকে আর হাফিজ সঈদ একই ভাষায় কথা বলছেন। এর পরেও একাধিক মামলা হয় বিস্তের বিরুদ্ধে ৷

সুতরাং, এক কথায় বলা যায় এই অজয় বিস্তের যাবতীয় ‘পপুলারিটি’, ‘হেট-স্পিচ’-এর কারনেই ৷ উত্তর প্রদেশে বিস্তের জনপ্রিয়তা হু হু করে নেমে আসছে৷ দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশের বিজেপিও তাঁর কাজের ধরনে অখুশি৷ দলিত, জনজাতি-সহ সমস্ত বর্ণের হিন্দুকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার যে কৌশল নিয়েছিলেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব, তাতে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছেন একা এই অজয় বিস্ত৷ নরেন্দ্র মোদি যখন-তখন আম্বেদকরের নাম উল্লেখ করে দলিতদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন, আর অজয় বিস্ত আদাজল খেয়ে মোদির চেষ্টায় ঠাণ্ডাজল ঢেলে চলেছেন৷

অজয় বিস্তকে সমর্থন করছেন করুন, কিন্তু ভক্তরা একবার মূল দলটির কথাও ভাবুন৷ বিস্ত কতখানি দলের উপকার করছেন, সেটাও ভাবনার মধ্যে আনলে, বিজেপির লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না৷

(‘যোগী’ বললেই যাদের মুখ ভেসে ওঠে, তাঁদের একশো যোজনের মধ্যে নেই আদিত্যনাথ৷ তাই ওনার বাবার দেওয়া ‘অজয় মোহন বিস্ত’ নামেই তাঁর পরিচয় হওয়া উচিত৷)

আরও পড়ুন- দলিতকন্যা মনীষার হত্যাকারীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর হুঁশিয়ারি পার্থর

Previous articleদলিতকন্যা মনীষার হত্যাকারীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর হুঁশিয়ারি পার্থর
Next articleন্যায়বিচার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে: হাথরাসে নির্যাতিতার পরিবারের পাশে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা