রাজ্যপাল বুদ্ধদেববাবুকে দেখতে গেলেন কেন?

অপরাজিতা সেন : আগেও গিয়েছেন। এবারও গেলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখতে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। গিয়েছেন, ছবি উঠেছে, ঢালাও প্রশংসা করেছেন বুদ্ধবাবুর।

বুদ্ধবাবু অসুস্থ। তাঁর শ্বাস এবং চোখ নিয়ে সমস্যা আছে। আমরা সবাই তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। রাজ্যপাল দেখতে যেতেই পারেন। এর মধ্যে সাদা চোখে কোনো বিতর্কের জায়গা নেই।

কিন্তু রাজনৈতিক সূত্র এর মধ্যে গভীর অঙ্ক দেখতে পাচ্ছে।
রাজ্যপাল এখন তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারকে ক্রমাগত অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তৃণমূল বলছে রাজভবনটি বিজেপির পার্টি অফিস হয়ে গিয়েছে। রাজ্যপাল যে মানসিকভাবে বিজেপিপন্থী তাতে কোনো সন্দেহই নেই।

এহেন জগদীপ ধনকড় বারবার বুদ্ধদেববাবুর কাছে যাচ্ছেন, তাঁর প্রশংসা করছেন। এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।

১) রাজ্যপাল দেখাতে চাইছেন বুদ্ধবাবু অনেক ভালো ছিলেন। অর্থাৎ তৃণমূল যাঁকে পরাস্ত করে ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁর ইমেজ নিয়ে চর্চা ফেরাতে চাইছেন রাজ্যপাল। বলেছেন,” হি ইজ এ লিভিং স্টেটসম্যান।”

২) রাজ্যপাল বুদ্ধবাবুকে উপলক্ষ্য করে বামেদের, বিশেষত সিপিএমের সমর্থকদের সমর্থন ও সহানুভূতি পেতে চাইছেন। এমনিতে বামেরা যতই ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলুন, বামেদের বড় ভোট বিজেপিতে যাচ্ছে। রাজ্যপাল তাদের অবচেতনসত্তায় সেই প্রবণতা জাগিয়ে রাখতে চাইছেন।

৩) যদি বিজেপি বুঝে যায় বাংলার ভোটে তারা বিধানসভায় জিতবে না, তখন তারা 356 ধারা জারির অঙ্ক কষবে। সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন জগদীপ ধনকড়। তিনি সুকৌশলে বামেদের নরম রাখার খেলা শুরু করেছেন। বুদ্ধবাবু এখানে প্রতীকমাত্র।

বস্তুত বামজমানায় রাজভবনের সঙ্গে বারবার সংঘাতে গিয়েছে মহাকরণ। সর্বশেষ উদাহরণ সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর মধ্যস্থের ভূমিকা পছন্দ না করে সিপিএম রাজভবনের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এখন বিজেপির পাঠানো রাজ্যপাল তৃণমূল সরকারের নিন্দেমন্দ করছেন দেখে তারা মজা পাচ্ছে। রাজ্যপালের বুদ্ধবাবুর বাড়ি যাওয়ার ঘটনার পর বাম সমর্থকদের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টেও বুদ্ধবাবু প্রবলভাবে ফিরে আসছেন। অসুস্থ বুদ্ধের ছবি সহানুভূতি টানছে। আর অবচেতন মনে বামেদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছেন জগদীপ ধনকড়।

ফলে তাঁর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে যাওয়ার মধ্যে গভীর রাজনৈতিক অঙ্কও রয়েছে। যদিও রাজভবনসূত্র এসব উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, বুদ্ধবাবুর প্রতি এই রাজ্যপালের আগে থেকেই একটি ইতিবাচক মনোভাব আছে। একান্ত শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধ থেকেই তিনি বুদ্ধবাবুকে দেখতে গিয়েছেন সস্ত্রীক। তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। এর বাইরে কোনো রাজনীতির অঙ্ক খোঁজা অর্থহীন। কারণ আদর্শগতভাবে দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা।

রাজভবনসূত্র যাই বলুক না কেন, আগামী রাজনীতির কথা ভেবে রাজ্যপাল বামপন্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার জমি তৈরি করছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদি বিজেপি রাষ্ট্রপতি শাসনের দিকে যেতে চেষ্টা করে তাহলে বামেরা যাতে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উগ্র বিরোধিতার পথে না গিয়ে স্রেফ রুটিন বিরোধিতায় সীমাবদ্ধ থাকে; সেই চেষ্টা করছেন ধনকড়।

বুদ্ধবাবুর সঙ্গে তাঁর রাজ্য রাজনীতি নিয়েও কথা হয়েছে। কিছু বিষয়ে বুদ্ধবাবুর মতামত নিয়েছেন রাজ্যপাল। বেশ কিছু বিষয়ে দুজনে সহমতও হয়েছেন। রাজ্যপাল বুদ্ধবাবুকে রাজ্যের বাম শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখছেন। একটি জায়গায় গেলেই সারা বাংলার অবশিষ্ট বাম জনতার কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা কাজ করবে, এভাবেই হিসেব করছে রাজনৈতিক মহল। রাজ্যপাল জানেন, ভোট হলে হয় তৃণমূল- বিজেপি মেরুকরণে বামেদের ভোট বিজেপিতে দরকার। অথবা রাষ্ট্রপতি শাসন করতে গেলে বামেদের তৃণমূল থেকে সরিয়ে রাখা দরকার। আপাতত সেই জমি তৈরির কাজ চলছে। ঝানু আইনজ্ঞ, প্রাক্তন সাংসদ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কট্টর তৃণমূলবিরোধী জগদীপ ধনকড়ের প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্লেষণের দাবি রাখছে। রাজভবনসূত্র অবশ্য বুদ্ধবাবুর বাড়ি যাওয়াকে ব্যক্তিগত সৌজন্যের অরাজনৈতিক পদক্ষেপ বলছে।

আরও পড়ুন-বাংলায় ক্ষমতা দখলে সংশয় থাকলেই ৩৫৬ প্রয়োগ করবে বিজেপি! অভিজিৎ ঘোষের কলম

Previous articleএশিয়ায় সবচেয়ে বড় পুজো ; বাগেরহাটের শিকদার বাড়িতে এবার পুজো হচ্ছে সীমিত পরিসরে
Next articleমহামারির আবহে নিয়মবিধি মেনে পুজোয় মেতেছে ভারত সংঘ স্পোর্টিং ক্লাব