Tuesday, November 11, 2025

অজানা সৌমিত্র: ফিরে দেখা কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

Date:

চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রেখে গেলেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। আজ কিংবদন্তি অভিনেতার মহাপ্রস্থানে ফিরে দেখা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। যার বেশিরভাগটাই হয়তো অনেকের কাছে অজানা। আর সেই অজানা সৌমিত্রকে জানার চেষ্টায় “এখন বিশ্ববাংলা সংবাদ”।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি। ফলে অভিনেতা ব্রিটিশ শাসন দেখেছেন। দেখেছেন দেশভাগ। আবার পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত হতেও দেখেছেন। এক শতক থেকে অন্য শতকে যাত্রার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর।

পেশাদার জীবনে রুপোলি পর্দা হোক কিংবা নাটকের মঞ্চ,
দুই মাধ্যমেই সমানভাবে সাবলীল ছিলেন সৌমিত্রবাবু।
বয়স ছিল তাঁর কাছে একটা সংখ্যা মাত্র। তাইতো মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অভিনয়ের সঙ্গেই নিজেকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছিলেন ৮৫ বছরের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাই শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয়, আগামী আরও কয়েকটি প্রজন্মের অভিনেতাদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। তাঁদের আইকন হয়ে থাকবেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পেশাগত জীবনের নেপথ্যে অনেক অজানা গল্প আছে। যেগুলি তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধরাও হয়তো সকলে জানেন না। জানার কথাও নয়। কারণ, সৌমিত্রবাবু অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া নয়, বরং বর্তমান ও আগামী নিয়েই বেশি ভাবতেন।

অভিনয় জগতে তাঁর সাফল্যের ঝুলি বহু সম্পদে পরিপূর্ণ।
অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও বহু জাতীয়-আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মানের পালকে ভরপুর তাঁর মুকুট।

রেডিও ঘোষক সৌমিত্র

বিনোদন জগতে শুরুতেই অভিনেতা নয়, ঘোষক হিসেবেই ছিল তাঁর পরিচয়। অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে ঘোষক হিসেবেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পেশাগত জীবন শুরু। তিনি খুব ছোট বয়স থেকেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরের প্রশংসা কুড়োতেন। আমহার্ট স্ট্রিট সিটি কলেজের ছাত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কলেজ জীবন থেকেই মঞ্চাভিনয়ে হাতেখড়ি। যা আগামীদিনে তাঁর বাচিক দক্ষতা আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে
পেশাগত জীবনে মঞ্চ বা পর্দা নয়, রেডিওই ছিল তাঁর প্রথম পেশাগত উপার্জনের মাধ্যম।

সৌমিত্রর প্রথম গুরু

অভিনয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম গুরু ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। কিন্তু অভিনেতা হিসেবেই যে জীবনে তিনি এগোতে চান, সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক দেখার পরে।

অপুর চরিত্রে সৌমিত্রকে নাকচ করেছিলেন সত্যজিৎ

১৯৫৬ সালে যখন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় “অপরাজিত” ছবির মুখ্য চরিত্রের জন্য নতুন মুখের সন্ধান করছেন, তখনই প্রথমবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয় সত্যজিৎ রায়ের। তখন সৌমিত্রের বয়স মাত্র ২০। সদ্য কলেজ পাশ করেছেন। সৌমিত্রকে একপলক দেখে অপুর চরিত্রে পছন্দও হয়ে গিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সৌমিত্রর কাস্টিং বাতিল করেন তিনি। আসলে “অপরাজিত”র অপু চরিত্রে তিনি আরও কম বয়সী কাউকে চেয়েছিলেন।

এরপর বছর দুই তাঁদের মধ্যে আর কোনও সাক্ষাৎ হয়নি বলে শোনা যায়। এরপর একদিন সত্যজিৎ রায় যখন “জলসাঘর”-এর শুটিংয়ে ব্যস্ত, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুটিংয়ের ব্রেকে সত্যজিৎ রায় অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আলাপ করিয়ে দেন। এবং সত্যজিৎ ছবি বিশ্বাসকে বলেন, “এই ছেলেটির সৌমিত্র। আমার পরের ছবি অপুর সংসার-এ অপু চরিত্রে অভিনয় করছে।” যা শুনে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল সৌমিত্রর। কারণ, সেই প্রথম তিনি জানতে পারেন যে দু’বছর আগেই মনে মনে কাস্টিংটা ঠিক করে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

মাইল ফলক ১৯৬১

১৯৬১ সাল। এই বছরটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনে একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে। এই বছরেই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ছবি “ঝিন্দের বন্দী”। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রথমবারের জন্য দর্শকরা পেয়েছিলেন একটি নেগেটিভ বা খলনায়ক চরিত্রে। যে অভিনেতা সত্যজিৎ রায়ের অপু হিসেবে দর্শকের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন, যে অভিনেতা “ক্ষুধিত পাষাণ”, “দেবী” অথবা “সমাপ্তি”-তে যে সুদর্শন নায়ক হিসেবে ঝড় তুলেছেন মহিলা দর্শকের হৃদয়ের মণিকোঠায়, সেই অভিনেতাকে তপন সিনহা বানিয়ে দিলেন একটি নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল প্রবল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত সুদর্শন ও লম্পট যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের। অভিনেতার পেশাগত জীবনে তাই এই বছরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রথম ভারতীয় অভিনেতার ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান

“ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে ময়ূরবাহনের চরিত্রে ভিলেনের অভিনয় করেই প্রথম ভারতীয় অভিনেতার ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লাভ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যা তাঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের কাছে ঈর্ষার ছিল।

“অর্ডার দি আর্ট এ দে লেটার” হল শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে তিনিই প্রথম এই সম্মানে ভূষিত হন।

ফ্রান্সে”লিজিয়ঁ অফ অনার” সৌমিত্র

ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান, আমাদের দেশের “ভারতরত্ন”র সমতুল্য। প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০১৮ সালে এই সম্মানে ভূষিত হন বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান

১৯৭০ সালে যখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অভিনয় দক্ষতার জন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু অচিরেই তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। ওই সময়ে ভারত সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য তেমন কিছুই করছিল না। তারই প্রতিবাদ জানিয়ে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

তবে ওই ঘটনার ৩৪ বছর পর, ২০০৪ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করা হয়।

জনপ্রিয় সংলাপে ১৯৮৬

রুপোলি পর্দায় বহু চরিত্রকে চিরস্মরণীয় করে গিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যা যুগ যুগ ধরে দর্শকদের হৃদয়ে লেখা থাকবে। সৌমিত্র মানেই “অপু”, আবার সৌমিত্র মানেই “ফেলুদা”। যা আজও দর্শকদের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য। যা আজও দর্শক মনে পুলক জাগায়।

কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবির বাইরেও এমন আরও কিছু ছবি ও চরিত্র রয়েছে যার সংলাপ অথবা দৃশ্য, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নস্টালজিক স্বরূপ হয়ে রয়েছে। তার প্রথমটি অবশ্যই “কোনি” ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ– “ফাইট কোনি ফাইট”। সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিতে বাংলার চলিত সংস্কৃতিতে এখনও এই সংলাপটি ঘুরে ফিরে আসে।

সৌমিত্র আরও একটি বিখ্যাত সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে ফেরে। যে সংলাপটি তাঁর মুখে উচ্চারিত নয়, অথচ ওই সংলাপটি বলা হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রের উদ্দেশে। ছবিতে সেই সংলাপটি যতবার এসেছে, ততবারই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নীরব থেকেছেন আর তাঁর সেই নীরবতা যে ওই চরিত্রটি যে কতটা অসহায়, যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা কোনওদিনই ভুলতে পারবেন না। ছবির নাম “আতঙ্ক” এবং সংলাপ– “মাস্টারমশায়, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।” ঘটনাচক্রে ওই দুটি ছবিই মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে।

 

 

Related articles

ধর্মেন্দ্রর অবস্থার অবনতি, রাতেই হাসপাতালে ছুটলেন শাহরুখ-সলমন

বর্ষীয়ান বলিউড অভিনেতা ধর্মেন্দ্রর (Dharmendra) শারীরিক অবস্থার অবনতি। রাতেই ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে গেলেন শাহরুখ-সলমানরা (Shahrukh Khan - Salman...

সলমনই হামলার মাস্টারমাইন্ড? দিল্লি বিস্ফোরণে গ্রেফতার ব্যবহৃত গাড়ির মালিক

সাদা রঙের একটি হুন্ডাই আই–২০ গাড়ি ধীরে ধীরে এসে ট্রাফিক সিগন্যালের সামনে থামতেই মুহূর্তের মধ্যে ঘটে বিস্ফোরণ। সোমবার...

দিল্লি বিস্ফোরণের জের: কলকাতার সব থানাকে সতর্ক করেছে লালবাজার, গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে চলছে নাকা চেকিং

দিল্লির লালকেল্লার কাছে মেট্রো স্টেশনের এক নম্বর গেটের সামনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের জেরে দেশের রাজধানীর পাশাপাশি হাই অ্যালার্ট (High...

দিল্লির বিস্ফোরণের ঘটনায় শোকপ্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর! ঘটনাস্থলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গ্রেফতার গাড়ির মালিক

দিল্লির বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার ১। বিষ্ফোরণ হওয়া গাড়ির মালিককে গ্রেফতার করল পুলিশ। প্রসঙ্গত, শনিবার সন্ধ্যায় লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের...
Exit mobile version