‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। সহ অভিনেতার প্রয়াণে শোকবিহ্বল অভিনেত্রীর স্মৃতিচারণে উঠে এল না জানা অনেক কথা।

আরও পড়ুন : স্মরণে-শ্রদ্ধায়-চোখের জলে শেষবিদায় কিংবদন্তিকে

একসঙ্গে বিদেশ যাত্রা:
দেশ স্বাধীন হওয়ার দুবছর পরের ঘটনা। তখনও ‘অশনি সংকেত’ রিলিজ করেনি। আগে ওয়েস্ট বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হবে, তারপর রিলিজ হবে। আমারও ছবিটা দেখা হয়নি। সৌমিত্র বাবুর সঙ্গে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। সঙ্গে মানিক দা (সত্যজিৎ রায়), তাঁর স্ত্রী, ছবির প্রযোজক সবাই ছিলেন। আগে থেকে আমি খুশিতে আত্মহারা ছিলাম। তাঁর মতো নায়কের সঙ্গে এত বড় ফেস্টিভ্যালে অংশ নিচ্ছি ভাবতেই যেন এক্সাইটমেন্টের শেষ ছিল না।

দিল্লী থেকে আমরা প্রথমে ফ্রাঙ্কফুর্ট যাই। সেখান থেকে যাব ওয়েস্ট বার্লিন। ফ্রাঙ্কফুর্টে সবার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন। এবার আমার পালা। বাংলাদেশি গ্রিন পাসপোর্ট হওয়ায় আমারটা আটকে দেওয়া হয়েছিল। আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। তখন সৌমিত্র দা, মানিক দা খুব সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আমার তখন কান্না চলে এসেছে এই ভেবে যে, এখান থেকে যদি ফিরে যেতে হয়! কিন্তু তাঁরা দুজন বিভিন্নভাবে আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করছিলেন। সমস্যা হচ্ছিল যে, জার্মানি তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। সেই কারণে জার্মানিতে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছিল। মানিক দা তখন ফেস্টিভ্যাল কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ওদিকে সৌমিত্র দা তখন আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন। অনেক জায়গায় যোগাযোগের পর, শেষপর্যন্ত আমাকে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।



প্রথম দেখা:
বীরভূমে শ্যুটিং লোকেশনে গিয়ে সৌমিত্র দার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। যতদূর মনে পড়ে উনি প্রথমে আমাকে দেখে, আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। কারণ, আমার বয়স তখন খুবই কম। উনি অত বড় শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে দেখে কোনওদিনও বোঝা যেত না। কারণ, মানুষটার ব্যবহার, কথাবার্তা খুবই মার্জিত ছিল। মনে হচ্ছিল উনি খুব আপন। যখন শট দিচ্ছি মানিক দার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার মুখ গুঁজে রাখতেন সৌমিত্র দা। দেখতেন আমি কেমন অভিনয় করছি। পরে অনেক জায়গায় আমার প্রশংসা করতেন। ক্যামেরায় সুন্দর লাগলেও বলতেন।


বিশেষ স্মৃতি:
‘অশনি সংকেত’এর শুটিং হচ্ছিল ঈদের দিন। আমার ভীষণ মন খারাপ ছিল। ঈদে দেশে যেতে পারিনি বলে। সেদিন শান্তিনিকেতনে শুটিং হচ্ছিল। সৌমিত্র দা বুঝেছিলেন আমার মন খারাপ। বিকেলে শুটিং শেষে দেখি সেমাই রান্না হচ্ছে। আমাকে দেখে তিনি বললেন, এসো আমরা শুটিংয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেনি। উনি আমাকে একজন বাচ্চা মেয়ের মতো স্নেহ করতেন।

আরও পড়ুন : “শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন রাষ্ট্রনেতার চেয়েও জনপ্রিয়”, সৌমিত্রর অন্তিম যাত্রা নিয়ে তসলিমা

ব্যক্তিগত সম্পর্ক:
সৌমিত্রদার ব্যবহারে কোনওদিন মনে হয়নি, তিনি অত নামী একজন মানুষ ছিলেন। আমাদের মধ্যে ওই কী করছো, কেমন আছোর মত কোনও ফর্মালিটি ছিলনা। আগেই বলেছি, উনি ছিলেন আমার একেবারে আপন মানুষ।

নায়ক সৌমিত্রের মূল্যায়ন:
উনি সত্যজিৎ বাবুর অনেক প্রিয় একজন শিল্পী ছিলেন। সত্যজিৎ বাবুর আচরণে এটা বুঝতে পারতাম। শিল্পের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তাঁর বিচরণ ছিলো না। তাঁকে মূল্যায়ন করতে বললে হয়তো সঠিক শব্দ খুঁজে পাব না। দেশ বিদেশের অনেক শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু সৌমিত্র দার মধ্যে কোনো গুণের কমতি পাইনি। তিনি অসুস্থ থাকাকালীন সবসময় তার খোঁজ খবর রেখেছি। উনি চিরকাল আমার হৃদয়ে থাকবেন।