সমর-সজ্জায় বেশ পিছিয়ে বিজেপি: কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

 হায়দরাবাদের ‘মিম’, মহারাষ্ট্রের শিবসেনার পর এবার ঝাড়খণ্ডের জেএমএম-ও৷ বাংলার বিধানসভা ভোট রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে এবার সর্বভারতীয় চেহারা নিতে চলেছে৷

পশ্চিমবঙ্গের বাইরের তিনটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এবার এখানে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী দিতে চলেছে৷ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, উদ্ধব ঠাকরে, শিবু সোরেন-হেমন্ত সোরেনরা এবার হঠাৎ বাংলার রাজনীতিতে পা রাখতে এত উৎসাহী কেন? নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত যে কোনও রাজনৈতিক দল দেশের যে কোনও প্রান্তের নির্বাচনে প্রার্থী দিতেই পারে, কিন্তু তাতে ওই সব দলের ভাবমূর্তি কতখানি বজায় থাকে ? বাংলায় দলের বিধায়ক হলে এই দলগুলি কতখানি লাভবান হবে? না’কি, অন্য কোনও সমীকরণ কাজ করছে এই সিদ্ধান্তের পিছনে ?

জাতীয় রাজনীতির রসায়ন বিশ্লেষণ করলে একটাই ছবি উঠে আসছে, এই তিন দলই ‘আপাতত’ বিজেপি- বিরোধী৷ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে বিজেপিকে পরাস্ত করেই তাদের সাফল্য এসেছে৷ তিন দলই স্পষ্ট জানিয়েছে, বিজেপিকে হারাতেই বাংলায় তারা প্রার্থী দেবে৷ কিন্তু বঙ্গ- রাজনীতিতে যে দলগুলির কোনও উপস্থিতিই নেই, সেই সব দলের প্রার্থীদের বাংলার মানুষ কেন ভোট দেবেন? এ ধরনের ‘পরিযায়ী’ বা ‘বহিরাগত’ দলগুলির মাধ্যমেই বা কেন বাংলার ভোটাররা বিজেপিকে হারাতে যাবেন? বিধানসভার ভোটের ফল কী হবে তা ফল ঘোষণার পর জানা যাবে৷ কিন্তু বাস্তব এটাই বাংলায় বিজেপিকে পর্যদুস্ত করার শক্তি আছে একমাত্র তৃণমূলেরই৷ বামেরা বা কংগ্রেসও এই লড়াইয়ে অনেক পিছিয়ে৷ তাহলে ওয়াইসি, ঠাকরে বা সোরেনদের দল যে বিজেপিকে হারানোর ঘোষণা করেছে, তার অর্থ কী ? যে তিন দলের বাংলায় ন্যূনতম জমিই নেই তারা এ রাজ্যের ভোটে অংশ নিতে এত তৎপর কেন ? ভোট রাজনীতির এই পাটিগণিতের অঙ্ক খুব সহজে মেলানো কঠিন৷

◾ওয়েইসির AIMIM

বিহার বিধানসভা ভোটে সীমান্ত এলাকার ৫ আসন দখল করার দিনেই AIMIM চেয়ারম্যান ওয়েইসি জানিয়ে দেন, এবার বাংলার ভোটে তাঁরা প্রার্থী দেবেন৷ ওয়েইসি সাহেব নিজেকে ও দলকে বিজেপি-বিরোধী বলে প্রচার করলেও দেশের রাজনীতিকরা এই দাবি মানেন না৷ শতকরা ৯৯ শতাংশ দলই মনে করে হায়দরাবাদের ‘মিম’ আসলে বিজেপির ‘গোপন মিত্র’৷ যেখানে বিজেপির দরকার, সেখানেই মুসলিম ভোট কেটে নিতে ‘মিম’ হাজির৷ মুসলিম ভোট বিজেপি- বিরোধী কোনও একটি দলের পক্ষে গেলে বিজেপির হারের আশঙ্কা থাকে৷ তেমন পরিস্থিতি দেখা দিলেই সেই রাজ্যে পৌঁছে যায় ‘মিম’৷ যেমন ‘মিম’ ছিলো বিহারে৷ বিজেপি-নীতীশ কুমার জোটের পিঠ এবার দেওয়াল ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তেজস্বী যাদব৷ পরিস্থিতি প্রায় বিজেপি জোটের নাগালের বাইরে৷ কাকতালীয়ভাবে তখনই বিহারে হৈ হৈ করে হাজির আসাদউদ্দিন ওয়েইসির ‘মিম’৷ বিজেপি-বিরোধী মুসলিম ভোট কেটে তেজস্বীর পথে কাঁটা ছড়িয়ে ওয়েইসি নীতীশ কুমারকে পৌঁছে দিলেন কুর্সিতে৷
রাজনৈতিক মহলের নিশ্চিত অভিমত, বাংলাতেও বিহার-ছকেই খেলতে চাইছে ‘মিম’৷ তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ফাটল ধরাতেই ওয়েইসির বঙ্গে আগমন৷ সেই লক্ষ্যেই কিছুদিন আগে বঙ্গ-সফরে এসে সরাসরি ফুরফুরা শরিফে গিয়ে বৈঠক করেন পীরজাদা আব্বাসউদ্দিন সিদ্দিকির সঙ্গে৷ বাংলায় মেরুকরণের ভোটের জল্পনায় কার্যত সিলমোহর লাগিয়ে ওয়েইসি জানান, আব্বাসের দলের সঙ্গে তাঁর দল জোট গঠন করে ভোটে লড়বেন৷ তৃণমূলের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে বিজেপি-বিরোধী ভোটের একটা অংশ কাটতে পারলে বিজেপির লাভ৷ বাংলাতেও সেই কাজই করতে চান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি৷ ‘বিজেপি ঠেকানো’ নেহাতই কথার কথা৷ এমনই ধারনা রাজনৈতিক মহলের৷

◾ঠাকরের শিবসেনা

দল হিসাবে শিবসেনা আগেই জানিয়েছিলো একুশের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী দেবে তারা৷ গত রবিবার শিবসেনার অন্যতম শীর্ষনেতা সঞ্জয় রাউত টুইট করে পাকা কথা জানিয়েছেন৷ বলেছেন, “দলের প্রধান উদ্ধব ঠাকরের সাথে আলোচনার পরে শিবসেনা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা শীঘ্রই কলকাতায় পৌঁছে যাচ্ছি৷” এবং সবশেষে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেছেন “জয় হিন্দ, জয় বাংলা”৷ জানা গিয়েছে, আগামী ২৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গে আসবেন শিবসেনা সাংসদ তথা দলের সাধারণ সম্পাদক অনিল দেশাই। তিনি ভোটের চূড়ান্ত রণকৌশল নির্ধারণ করতে রাজ্যে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
হিন্দুত্বকে সামনে রেখে বাংলায় ভোট চাইছে বিজেপি৷ আর সেই হিন্দু- আবেগকেই অ্যাজেণ্ডা করে বাংলায় ভোট চাইতে আসছে শিবসেনা৷ ধর্মভিত্তিক ভোটব্যাঙ্কের লড়াইয়ে এবার শিবসেনাও। এ রাজ্যে ঠাকরের দল যে হিন্দুভোটকেই নিজের দিকে টানতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য৷ প্রচারে আসার কথা উদ্ধব ঠাকরের৷ এর অর্থ, বিজেপির হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতেই বাংলায় জোট গড়ে ময়দানে নামতে চলেছে শিবসেনা৷ আর তাতে লাভ তৃণমূলের৷ বাংলায় বিজেপিকে ‘উৎখাত’ করতেই এই লড়াইয়ে নামতে চায় উদ্ধব ঠাকরের দল৷ ভোটে লড়তে জোটও গঠন করছে শিবসেনা৷ শিবসেনার এই জোটে রয়েছে উত্তরবঙ্গ সমাজ পার্টি, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী পার্টি, আমরা বাঙালি৷ ঝাড়গ্রামের স্থানীয় একটি দলও নাকি এই জোটে থাকতে পারে৷ জানা গিয়েছে, রাজ্য বিধানসভার মোট ২৯৪ আসনের মধ্যে শিবসেনার এই জোট মোটামুটি ১০০ আসনে প্রার্থী দেবে। শিবসেনার দাবি, বঙ্গ-বিজেপি যে সব আসনকে খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ বলে মনে করছে, সেই আসনগুলিতে এবার শিবসেনার প্রার্থী থাকবে৷ শিবসেনার রাজ্য নেতাদের বক্তব্য, “বাংলা মূলত বিজেপি বিরোধী। বিজেপির ফ্যাসিস্ট শক্তিকে বাংলা পছন্দ করে না। শিবসেনার দাবি, উত্তরপূর্বের যে সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, সেখানেই বিজেপি বাঙালিদের উপর অত্যাচার করেছে। তাই বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় বাংলাপন্থী দলগুলিতে নিয়ে শিবসেনা জোট গড়ে এবার ভোটে লড়বে।” এই মুহুর্তে চরম বিজেপি- বিরোধী শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক রয়েছে৷ শিবসেনা সত্যিই বাংলার ভোটে প্রার্থী দিয়ে হিন্দু ভোট ভাগ করতে পারলে লাভ তৃণমূলের৷ রাজনৈতিক মহলে তাই জল্পনাও শুরু হয়েছে, তাহলে কি বিজেপির ‘মিম’-এর জবাব দিতেই তৃণমূলের ‘শিবসেনা’? জল্পনা যদি বাস্তব হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা তৃণমূলের ‘মাস্টারস্ট্রোক’৷ ‘বিপদ’ যে এই জায়গা থেকে আসবে, তা স্বপ্নেরও অতীত ছিলো বিজেপির কাছে৷

◾সোরেনের JMM

একুশের ভোটে এ রাজ্যে লড়বে শিবু-হেমন্ত সোরেনের ‘ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা’ও৷ প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতাসীন দল ইতিমধ্যেই এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ ৭ জেলায় প্রার্থী দেবে শিবু সোরেনের দল৷
ঝাড়খণ্ডের পরিবহণমন্ত্রী চম্পাই সোরেন ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন,আগামী ২৮ জানুয়ারি বাংলায় প্রথম প্রচার শুরু করছে জেএমএম৷ ঝাড়গ্রামে দলীয় প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে আসবেন ‘গুরুজি’ শিবু সোরেন ও তাঁর ছেলে, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন৷

কিন্তু হঠাৎ বাংলার ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা? চম্পাই সোরেন বলেছেন, “অনেক দিন থেকেই জেএমএমের ভাবনা ছিল বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার৷ কত আসনে প্রার্থী দেওয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি৷ ২৮ জানুয়ারি ঝাড়গ্রামের জনসভাতেই দলের বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরা হবে”৷
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জেএমএমের সম্পর্ক দারুণ৷ তা সত্ত্বেও বাংলার ভোটে লড়াই করবে হেমন্ত সোরেনের দল৷ কেন ?
ওদিকে আবার ঝাড়খণ্ডে জেএমএমের জোট শরিক কংগ্রেস৷ প্রশ্ন উঠেছে তাহলে ‘গুরুজি’র দলের রাজনৈতিক সমীকরণ কী? বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন জেএমএমের শীর্ষনেতা চম্পাই সোরেন৷ ধন্দ বাড়িয়ে বলেছেন, “বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দিদি৷ আমরা সম্মান করি৷ তবে বাংলায় কতগুলো আসনে জেএমএম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করবেন ‘গুরুজি’ এবং হেমন্তজি”৷
ঝাড়খণ্ডের প্রভাবশালী মন্ত্রীর কথায় ইঙ্গিত স্পষ্ট, রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে সরকার পরিচালনা করলেও বাংলার ভোটে কিন্তু জেএমএম কংগ্রেসের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে৷ এর অর্থ, বিজেপি তো বটেই, কংগ্রেসকেও বাংলার মাটিতে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো৷ এই লক্ষ্যে জেএমএম কতটা সফল হয়, তা সময়ই বলবে৷ তবে চম্পাই সোরেন তো এটাও বলেছেন, “বাংলায় কত আসনে আমরা লড়বো তা মমতাজির সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করবেন ‘গুরুজি’ এবং হেমন্তজি”৷ তাহলে কি এমনও হতে পারে যে, বাংলায় হিন্দিভাষী ভোট এবং ঝাড়খণ্ড- সীমান্তের আসনগুলিতে বিজেপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতেই বাংলায় প্রার্থী দেবে ঝাড়খণ্ডের শাসক দল জেএমএম ?

আরও পড়ুন:অসম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে টক্কর দিতে মহাজোট গড়ল কংগ্রেস

একুশের ভোট খুব সোজা-সাপটা আর থাকছে না৷ তৃণমূলের মুসলিম ভোট ভাঙ্গতে যদি ওয়েইসিকে বাংলায় আনা হয়, তাহলে এর পাল্টা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোট এবং হিন্দিভাষী ভোটে থাবা বসাতে ঠাকরে এবং সোরেনের দলও আসছে৷ বিজেপির কাছে এই ধাক্কা অভাবিত ছিলো৷

বঙ্গ-ভোটে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোট-কৌশল যদি এমনই হয়, তাহলে ‘শত্রুপক্ষের’ সমর- কৌশল অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বিজেপিকে৷

Advt

Previous article২০২১ আইপিএলে সিএসকে তে খেলবেন না ভাজ্জি
Next articleচাপের মুখে ক্ষমা: দৃশ্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিল তাণ্ডব