ভারতের সাংবাদিকরা বিপন্ন, আন্তর্জাতিক রিপোর্টে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী

দুনিয়ার যে সব দেশে কর্মক্ষেত্রে সাংবাদিকরা বিপন্ন, সেই তালিকায় জ্বল জ্বল করছে ভারতের নাম৷ সাংবাদিকদের পক্ষে বিপজ্জনক দেশগুলিরও অন্যতম ভারত৷

বিশ্বের মোট ১৮০টি দেশের সাংবাদিকদের (Journalist) পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ সংস্থা (Reporters without Border) একটি তাৎপর্যপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। আর সেখানেই তুলে ধরা হয়েছে উদ্বেগজনক এই তথ্য৷ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার (Freedom Of Press) প্রশ্নে ১৮০টি দেশের মধ্যে ব্রাজিল, মেক্সিকো ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতকে রাখা হয়েছে ১৪২ তম স্থানে৷

এই রিপোর্টে মুক্ত সাংবাদিকতার মানচিত্রে সার্বিক পরিস্থিতি ও স্কোরের বিচারে ১৮০টি দেশকে ভালো, সন্তোষজনক, সমস্যাসঙ্কুল, কঠিন পরিস্থিতি ও গুরুতর- এই ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভারত আছে ‘সাংবাদিকতার জন্য কঠিন পরিস্থিতির’ দেশের ভাগে। ১৮০ দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪২ নম্বরে৷ স্কোর, ৪৬.৫৬ ৷

চলতি বছরের রিপোর্টে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সাংবাদিকদের এই বিপদের জন্য নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) সরকার, বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীদের সরাসরি দায়ী করা হয়েছে৷ তাদের ভূমিকার কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে৷ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, “বিজেপির কর্মী- সমর্থকরা ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ভারতের সাংবাদিকদের কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করলেই সাংবাদিকদের ‘দেশদ্রোহী’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বা ‘জাতীয়তাবিরোধী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশজুড়ে ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে তিনি কব্জা করে রেখেছেন। তাঁর আমলেই সাংবাদিকদের উপর হামলা, রাজনৈতিক হিংসা ও হঠাৎ আক্রমণ করার ঘটনা দ্রুত গতিতে বাড়ছে৷ বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের উপরে হামলা, প্রশাসনিক সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকদের হেনস্তা করার অপকর্মে কেন্দ্রের শাসক দল, শাসক দল নিয়ন্ত্রিত নানা সামাজিক সংগঠন থেকে শুরু করে দুষ্কৃতীবাহিনী, দুর্নীতিগ্রস্ত
প্রশাসনিক কর্তারা, কেউই পিছিয়ে নেই। ২০১৯-এ বিপুল ভাবে জিতে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সাংবাদিকদের উপরে চাপ বাড়ছে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের’ তালে তাল মিলিয়ে চলার জন্য৷

বিশ্ব-স্বীকৃত এই সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, হিন্দুত্ববাদীদের অপছন্দের কিছু লেখা হলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সাংবাদিকদের শুধু হেয়, অপমান করা হচ্ছে না, তীব্র ঘৃণা ও রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। বহু ক্ষেত্রে শারীরিকভাবেও হেনস্তা করা হচ্ছে তাঁদের৷ গুরুত্বপূর্ণ এই রিপোর্ট বলছে, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে নিজের কাজ করতে গিয়ে ২০২০ সালে ভারতে প্রাণ খুইয়েছেন ৪ জন সাংবাদিক। ভারত তাই সাংবাদিকদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির একটি। পাশাপাশি নিন্দা করা হয়েছে, নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের৷ অনলাইন খবরের উপরে প্রশাসনিক বা সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ভারতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কোভিড- অজুহাত সামনে এনে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও গণ্ডা গণ্ডা নতুন বাধা ও বিরোধিতার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। প্রকৃত তথ্য প্রকাশের বদলে কেন্দ্রীয় শাসক দল এবং তাদের একপেশে প্রচারের শরিক হতে ভারতীয় সাংবাদিকদের তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে।

প্যারিসভিত্তিক এই সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’-এর এই বার্ষিক সূচকে ভারতের অবস্থান এবার ১৮০ দেশের মধ্যে ১৪২তম। ২০২১ সালের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ বলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকারের প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে।

মোট ৭টি মাপকাঠিতে খুঁটিয়ে বিচার করে একটি দেশের সংবাদমাধ্যম কতখানি স্বাধীনতা ভোগ করছে তা বোঝারই চেষ্টা করেছে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’। এই ৭ টি মাপকাঠি হল-

◾১) সংবাদমাধ্যমে বহুমতের প্রকাশ

◾২) সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ

◾৩) কাজের পরিবেশ, অবকাঠামো

◾৪) স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ

◾৫) আইনি কাঠামো

◾৬) সংবাদমাধ্যমের কাজে স্বচ্ছতা

◾৭) সংবাদকর্মীদের ওপর নিপীড়ন

সবগুলো মাপকাঠির স্কোরের গড় করে তৈরি করা হয় একটি দেশের গ্লোবাল স্কোর। ১০০ পয়েন্টের এই সূচকে যে দেশের স্কোর যত কম, সে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা তত বেশি বলে ধরা হয়।

এই সমীক্ষা রিপোর্টে সাংবাদিকদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রসঙ্গটিও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২৮টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে এই সংস্থাটি দেখেছে, ৫৯ শতাংশ মানুষের ধারণা, সাংবাদিকরা ইচ্ছাকৃত ভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে মিথ্যাকে সত্য হিসেবে পরিবেশন করছেন। পাশাপাশি সাংবাদিকদের যে বহু ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়, তাও স্পষ্ট করা হয়েছে রিপোর্টে। বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭৩ শতাংশ দেশে অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা বিশেষ প্রবল এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে। কোভিড অতিমারির কারণে এক একটি দেশে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণও চাপানোর দরুণ, সাংবাদিকতা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে৷

রিপোর্টে পাকিস্তান রয়েছে ভারতের ৩ ধাপ নীচে, ১৪৫-এ। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ, ১৫২ নম্বরে। ওদিকে ভারতের চেয়ে ঢের ভালো অবস্থায় রয়েছে নেপাল, স্থান ১০৬ নম্বর, শ্রীলঙ্কা ১২৭। সামরিক অভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত মায়ানমার ছিল ১৪০ নম্বরে।

আরও পড়ুন:১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কোভিড ভ্যাকসিনের জন্য ২৪ এপ্রিল শুরু রেজিস্ট্রেশন! দেখুন পদ্ধতি

২০২১-এর তালিকায় এ বারও পয়লা নম্বরে রয়েছে নরওয়ে। ২ এবং ৩ নম্বরে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক। একেবারে তলার দিকে টিমটিম করছে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ এরিট্রিয়া, ১৮০ নম্বরে৷ ১৭৯-তে উত্তর কোরিয়া, ১৭৮-এ তুর্কমেনিস্তান এবং ১৭৭-এ প্রতিবেশী চিন।

Advt

Previous article‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানের মুখে রাজ-কৌশানী, অভিযোগ বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে
Next articleবিদেশে প্রচুর অক্সিজেন রফতানি করেছে কেন্দ্র, তাই দেশজুড়ে বিপুল ঘাটতি, ফাঁস হল রিপোর্ট