Tuesday, December 16, 2025

ভোট ঘোষণার পর রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন৷ রাজ্য প্রশাসন কার্যত দর্শক হয়ে যায়৷ এটাই চালু সিস্টেম৷

এই বিষয়টি এতটাই পছন্দসই ছিলো যে বাংলার ভোটে বঙ্গ-বিজেপিকে সেই বিধির আওতাতেই ফেলে দেন মোদি-শাহ৷ ফলে বঙ্গ-বিজেপির হতভাগ্য নেতারা নিতান্তই দর্শক হয়ে যান৷ বাংলার ভোটে জেতার সব সুতো চলে যায় ভিনরাজ্যের লোকজনের হাতে৷ যাবতীয় কলকাঠি নাড়ায় দিল্লি ৷ হাতে অজস্র এজেন্সি, গোটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক৷ সে সব জায়গা থেকে একের পর এক পছন্দসই খবর আসছে৷ কোনও খবরে কোনও কনফিউশন নেই৷ ২০০ আসন নিশ্চিত আসছে৷ মোদিজি, শাহজি, নাড্ডাজি আলোচনায় বসে যান, কাকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হবে !

একুশের ভোটপর্ব ছিলো প্রায় দু’ মাসের৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন বাংলার ভোটের নির্ঘন্ট ঘোষণা করে। কিন্তু বিজেপি মাঠে নেমে যায় আরও অনেক আগে থেকে৷ কৈলাস বিজয়বর্গীয় আগেই ছিলেন৷ দিল্লি থেকে একে একে পাঠানো হলো অরবিন্দ মেনন, শিবশেখর, বিএল সন্তোষ, ভূপেন্দ্র যাদব, সুনীল দেওধর,দুষ্ম্যন্ত গৌতম, বিনোদ তাওড়ি, হরিশ দ্বিবেদি, বিনোদ সোনকর, অমিত মালব্য, আরও আরও অনেককে৷ দলে দলে এলেন শ’খানেক পর্যবেক্ষক৷ জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে ঘুরলেন৷ রিপোর্ট দিলেন দিল্লিতে৷ মোদি-শাহ ‘ছানবিন’ করে বুঝলেন বাংলা এবার গেরুয়া হচ্ছেই৷ আর এই গেরুয়াকরণ করবে দিল্লির. লোকজন৷ বাংলার নেতাদের দায়িত্ব শুধু ঘুরে ঘুরে মিটিং করা৷ প্রার্থী বাছাই থেকে ইস্তাহার, অর্থ থেকে কপ্টার, সব করবে দিল্লি, দিল্লি মানে অমিত শাহ৷

তাতেই খুশি বঙ্গ-ব্রিগেড৷ খুশি হবেন তো বটেই, ‘ক্ষমতায় এলে তো আর দিল্লি থেকে মন্ত্রী হবে না, ওই সব পদে তো আমরাই বসবো!’

ফলে দিল্লির নেতারা তাঁদের মেধার ভিত্তিতে বাংলার ভোটের কৌশল ঠিক করে ফেললো৷ বঙ্গ-নেতাদের বলা হলো, হিন্দি-বলয়ের মতো বাংলার আকাশ-বাতাস ভাসিয়ে দাও ‘জয় শ্রীরাম’-এ, এতেই কাজ হবে৷ দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারীরা গোটা ভোটপর্বে এক কোটি বার রামনাম উচ্চারণ করে ফেললেন৷ কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা নির্দেশ দেওয়া শুরু করলো৷ দলের শীর্ষ নেতারা প্রায় রোজই কেউ না কেউ বাংলায় পা রাখলেন। নিজেদের মতো ভাষণ দিলেন৷ কোথাও বাংলা ভাষার ছোঁয়া নেই৷ দু’মাস ধরে হিন্দি শুনতে শুনতে বাঙালিরা অধৈর্য হয়ে পড়লেন৷ ওদিকে, বঙ্গ-নির্বাচনের প্রতিটা বিষয় নজরে রেখেছেন শাহ ও নাড্ডা। তাঁদের অনুমতি ছাড়া বঙ্গ- বিজেপির নেতারা একটা পাতাও নাড়াতে পারেননি৷ দিল্লি চরম আশাবাদী হলো, বাংলায় এবার ২০০ পার হচ্ছেই।

কিন্তু রবিবার ফলাফল ঘোষণা হতেই দেখা গেলো ট্রেন্ড প্রথম থেকেই তৃণমূল ঘেঁষা। বেলা যতই গড়িয়েছে, ততই কমেছে ‘বিজেপির এগিয়ে থাকা’৷ শেষপর্যন্ত আর পদ্ম ফুটলো না বাংলায়৷

বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ পরাজয়ের পর বলেছেন ‘আত্ম সমালোচনা করতে হবে৷’ এখন আত্ম সমালোচনার ভাব যতখানি চাগিয়ে উঠেছে, তার সিকিভাগও যদি প্রথম দিকে দিল্লিকে বোঝাতেন যে এভাবে ‘ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করবেন না৷ বাংলার মাটির কথা শুনুন৷ বাংলার নেতাদের কথা শুনুন৷ জয় শ্রীরাম কমান, ‘দিদি ও দিদি’ বলা বন্ধ করুন, বাংলার তালিকা মেনে প্রার্থী করুন, আসানসোলের দু’বারের জেতা সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়কে প্রার্থী করতে হলে ওই আসানসোল থেকেই করুন, কল্যান চৌবেকে কৃষ্ণনগরে প্রার্থী না করে কোন কাণ্ডজ্ঞানে কলকাতায় আনলেন, কোন লজিকে একগাদা অযোগ্যকে কলকাতার নানা কেন্দ্রে প্রার্থী করলেন, তাহলে আজ হয়তো ‘আত্ম সমালোচনা’ করার বাসনা এতখানি তীব্র হতো না৷ এভাবে হুমড়ি খেয়েও পড়তে হতো না৷

আরও কারন আছে৷ মোক্ষম সেই সব কারন৷

◾আদি, নব্য আর প্যারাস্যুট বিজেপির ক্ষত সামলাতে পুরোপুরি ব্যর্থ বিজেপি৷ আদি বিশ্বস্ত বিজেপি নেতাদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দলবদলুদের ‘তেন্ডুলকর’ বানিয়েছে দিল্লির নেতারা৷ দলে দলে টিকিট পেয়েছে৷ ক’জন জিততে পেরেছেন ? গোটা ভোটপর্বে বারবার বিজেপির আদি-কাঁটা গলায় বিঁধেছে৷ বিজেপির প্রার্থী ঘোষণা হতেই জায়গায় জায়গায় শুরু হয় ‘বিদ্রোহ’। কলকাতায় হেস্টিংস পর্যন্ত তার আঁচ এসে লাগে। দল বলেছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটি ক্ষেত্রেও হয়নি৷ সিঙ্গুর, উত্তরপাড়া, বালি, চৌরঙ্গি, যাদবপুর, ডোমজুড়, বারাকপুর, বেলেঘাটা-সহ সর্বত্রই শেষদিন পর্যন্ত দলের একটা অংশ বসে ছিলো৷ এই ছবি সবাই দেখেছে। ভোটের ফলাফলে দিন দেখা গেল ৫০ শতাংশ আসনে প্রার্থী বাছাই-ই ঠিক হয়নি। দলবদলু প্রার্থীরাই বিজেপির আপাত শক্ত ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে অংংখ্য কেন্দ্রে৷ আজ বিজেপি এসব বুঝছে, ঠিক সময়ে বোঝার চেষ্টাই করেনি৷

আরও পড়ুন- পূর্ব মেদিনীপুরে ভেঙে চুরমার অধিকারী গড়ের মিথ, নন্দীগ্রাম আদালতে যাবে তৃণমূল

◾দিল্লির বুদ্ধিতে চড়াসুরে ‘মেরুকরণ’-এর আওয়াজ তুলেছিলো বিজেপি৷ বাংলায় এসব ব্যুমেরাং হয়েছে৷ হিন্দুত্ব, মতুয়া, অবাঙালি ভোটকে এবার বিজেপি তাদের ‘ঘরের লোক’ হিসাবে ধরে নিয়েছিলো, অকারনে৷ ইভিএম খুলতেই দেখা গেল, এসব কোনও কাজে লাগেনি৷ ‘শ্রীরাম’-কে ভোটের হাতিয়ার হিসাবে মেনে নেয়নি বাংলা৷ অথচ বিজেপি নেতারা এসবই প্রোমোট করে গেলেন কিছু না বুঝে৷

◾মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিকিভাগ জনপ্রিয়তা আছে এমন কোনও নামকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি৷ মুখের এই অভাবও বিজেপির পর্যুদস্ত হওয়ার অন্যতম কারন৷

আরও পড়ুন- বাংলার রায়কে সম্মান জানালেও মমতাকে অভিনন্দন জানালেন না অমিত শাহ

◾হাতে গোনা কয়েকটি জায়গা ছাড়া, বিজেপির কোনও সংগঠনই যে নেই, তা এবার বোঝা গিয়েছে৷
সভায় ভিড় করা আর ভোট করানোর অভিজ্ঞতা থাকা, এক নয়৷ নেতারা ভিড় দেখেই আবেগে ভেসেছেন৷ ওই ভিড়কে কে বা কারা ইভিএমে পৌঁছে দেবে, তা আজ, এখনও জানেন না বিজেপি নেতৃত্ব ৷ ভোটের কাজে প্রায় সব বিষয়েই তৃণমূলের চেয়ে পিছিয়ে ছিলো বিজেপি। হিন্দু ভোটের মেরুকরণেও সেভাবে সাড়া দেননি ভোটাররা৷

◾ গোটা তৃণমূলকে তোলাবাজ, কয়লা-চোর, ত্রিপল-চোর ইত্যাদি বলে যাওয়াটা মেনে নেয়নি ভোটাররা৷ এমনই প্রচার করেছে বিজেপি, সেটা কাজে যে লাগেনি, তা এখন নিশ্চয়ই বুঝছে গেরুয়া বাহিনী৷

◾ভুলভাল টলি- তারকাদের টিকিট দেওয়ায় দলের অন্দরে চরমে ওঠে ক্ষোভ । নিষ্ঠাবান আদি নেতা- কর্মীরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও এই সব প্রার্থীদের হয়ে নামেননি, হয়তো ভোটও দেননি৷

বিজেপি আপাতত ময়না-তদন্ত করুক, আর আগামী ৫ বছর রাজ্য শাসন করুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এটাই পাওনা ছিলো বিজেপির৷

আরও পড়ুন- তৃণমূলের জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে মমতাকে রাজভবনে আমন্ত্রণ রাজ্যপালের

চিতার ধোঁয়াকে সন্ধ্যারতি ভেবেই ডুবে গেলো বিজেপি৷

Related articles

মোটা অঙ্কের বাজেট নিয়ে মিনি নিলামে নামছে কেকেআর, দল পেতে পারেন ঈশ্বরণ

মঙ্গলবার আবুধাবিতে ২০২৬ সালের আইপিএলের মিনি নিলাম(IPL Mini Auction)। ৭৭টি জায়গার জন্য নিলামে উঠবেন ৩৫০ ক্রিকেটার। এই ৩৫০...

বাংলা না কি জ্বলছে! গদি মিডিয়ার অপপ্রচারকে ধুয়ে দিলেন সাধু থেকে আমজনতা

বাংলা না কি জ্বলছে! এখানে খুন-জখমের রাজনীতি চলছে! আক্রান্ত হিন্দু! গদি মিডিয়া এই খবর করতে এসেছিল কলকাতায় আর...

রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা! কেন্দ্রের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লোকসভায় সোচ্চার তৃণমূল

পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিকে বাগে আনতে না পেরে এবার দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো লঙ্ঘন করে...

মতুয়াদের সঙ্গে প্রতারণা! রাজ্যসভায় বিজেপির পর্দাফাঁস সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের

পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মতুয়াকে ভুল বুঝিয়ে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করছে মোদি সরকার ও বিজেপি—এমনই অভিযোগ তুলে সোমবার...
Exit mobile version