Monday, May 19, 2025

জন্মদিনে হাসিম আবদুল হালিমকে শ্রদ্ধার্ঘ্য: কুণাল ঘোষের কলম

Date:

Share post:

কুণাল ঘোষ

প্রয়াত হাসিম আব্দুল হালিম। জন্মবার্ষিকীতে প্রণাম।

তিনি রেকর্ড সময়ের বিধানসভার স্পিকার, সিপিআইএমের অন্যতম নেতা।
আমার কাছে তার থেকেও বড় কথা এক বিরল রাজনীতিবিদ, যিনি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ, বিরাট মনের অধিকারী। একদিকে পার্টিই শেষ কথা, অন্যদিকে জনসংযোগ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি সব দলের উপরে; অর্থাৎ পার্টিসর্বস্ব নন।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার পিতৃসম। অবারিতদ্বার ছিল তাঁর ঘর। অন্য নেতারা বসে থাকলেও সেখানে থাকার অধিকার আমাকে সস্নেহে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে দারুণ বিশ্লেষণ। সমৃদ্ধ হতাম। আমার সৌভাগ্য যে তিনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন এবং কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

একবার বিদেশ থেকে আমার জন্য একটি ম ব্লাঁ কলম এনেছিলেন। পরের বার বললাম, “স্যর, এসব না এনে যদি বিদেশি কিছু খবরের কাগজ এনে দেন, তাদের খবর, ডিসপ্লে, লে আউট শিখতাম।” তখন ইন্টারনেটের বা ইপেপারের যুগ নয়। অবাক হয়ে দেখেছি পরের বার লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ঘুরে একটা বিরাট ব্যাগ ভর্তি প্রচুর সংবাদপত্র এনে দিয়ে প্রকাশ্যে বলেছিলেন,” হতভাগা, বুড়োটাকে দিয়ে এসব বওয়ালে।” পরের কদিন এসব কাগজের লে আউট থেকে এখানে নানা প্রয়োগ করলাম। এবং সবাই বললেন, আহা কুণাল কী অপূর্ব সব নতুনত্ব দিল!

আমাকে নতুন বিষয়ে ভাবতে, লিখতে সাহায্য করেছেন। বই বেরোলে বিধানসভা ভবনেই সেই বই প্রকাশ করে দিয়েছেন।একাধিকবার। অনুষ্ঠানের আগে বলেছেন,” অতিথিদের কী খাওয়াবে?” বলেছি, ভাবছি মিষ্টির প্যাকেট দেব। নিজেই কপট রাগে বলেছেন,” পয়সা বেশি হয়েছে, না? আমার বিধানসভায় বই প্রকাশ আর উনি আমাকে প্যাকেট দেখাচ্ছেন! কী সাহস! প্যাকেটের ব্যবস্থাও আমিই করব। যাও ভাগো এখন।”
স্নেহ। স্নেহ।

আমার জীবনের কিছু কঠিন সময়ে পাশে থেকেছেন। বাড়িতে ডেকে দিনের পর দিন মনের জোর দিয়েছেন।
ওঁর কাছ থেকে জীবন দর্শন শেখার চেষ্টা করেছি।
-” কেউ কোনো কাজ দিলে যদি পারো করে দেবে। চেষ্টা করবে। সমস্যা থাকলে মুখের উপর বলে দেবে। দেখছি দেখব করে কখনও ঝুলিয়ে রাখবে না।”

1999/2000। ওড়িশার বিপর্যয়। বললাম,” স্যর, ভাবছি, মুখ্যমন্ত্রী একাদশ আর বিরোধী দলনেতা একাদশ ক্রিকেট করব ত্রাণ তহবিলের জন্য।” একা হাতে সব করে দিয়েছিলেন। আমাকে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে কথা বলালেন। মোহনবাগান মাঠে খেলা হল। বসু ব্যাট করে উদ্বোধন করলেন। আম্পায়ার দুজন। হালিমসাহেব আর মুনমুন সেন !!!

2004। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় লোকসভার স্পিকার। আব্দার করলাম দুই স্পিকারের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেব। প্রথমে প্রায় মারতে এলেন। তারপর সোমনাথবাবুর সঙ্গে সময় করে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে আমাকে দুজন ফাটাফাটি সাক্ষাৎকার দিলেন। সম্ভবত চ্যানেল ভিশনে সম্প্রচারিত। তারপর প্রতিদিন -এ লিখলাম ছবিসহ।

একবার আমার বাড়ির একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ। গৃহপ্রবেশ বোধহয়। পুরনো বাড়িটি ভেঙে ফ্ল্যাট। বললেন,” যাবো, একটা গাড়ি পাঠিও তো। ড্রাইভারকে আর ছুটির দিন বলব না।” গাড়ি পাঠালাম। ওখান থেকে খবর এলো সাহেব বাড়ি নেই। বেরিয়ে গেছেন। মনটা একটু খারাপ লাগল। তারপর দশ মিনিট পর দেখি হালিমসাহেব নিজে গাড়ি চালিয়ে হাজির। বললেন,” কাজের বাড়ি। যদি দশকাজে গাড়ি পাঠাতে ভুলে যাও। তাই চলে এলাম।”

একের পর এক এক্সক্লুসিভ ডেকে হাতে তুলে দিয়েছিলেন যা নিয়ে তখন ঝড় উঠেছিল। বিধায়কদের রেল কুপন কেলেঙ্কারি বা মেডিকেল বিল কেলেঙ্কারি। মেডিকেল বিলের খবরের জেরে এক বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ হয়েছিল। বলতে বাধা নেই আমার সোর্স হালিমসাহেব। ফাইল হাতে তুলে দিতেন। অন্য সব কাগজ ঝাড়।

সাংবাদিকদের সর্বভারতীয় সম্মেলন সেবার কলকাতায়। বিদেশিরাও আসবেন। দিল্লি থেকে গৌতম লাহিড়ি উদ্যোক্তা। জয়ন্ত ঘোষালরাও ছিল। গৌতমদা বলছে কোথায় কী করা যায়। হালিমসাহেবকে বললাম। গোটা ব্যবস্থা বিধানসভায়। বুদ্ধবাবু থেকে প্রণববাবু- জমজমাট কর্মসূচি। মূল আয়োজকের ভূমিকায় প্রায় হালিমসাহেব।

দুষ্টুমিতে ভরা মাথা। বিধানসভায় গোলমালের পর ভাঙা ফার্নিচারের প্রদর্শনী বা বিধায়কদের বেতন কাটা- সিপিএম যা চিমটি বিরোধীদের কাটতে পারেনি; বিধানসভার মঞ্চ থেকে হালিমসাহেব বসে বসে উৎপাত করে দিয়েছেন। আবার সেদিনই ঘরে বসে নিজের পার্টির নেতাদের বলেছেন,” কত আর তোমাদের সামলাবো? এভাবে মমতাকে ঠেকাতে পারবে না। ওর জেদটা দেখে শেখো।”

আলিমুদ্দিনের মূলস্রোত তাঁকে প্রাপ্য জায়গা দেয় নি। সব দলে তাঁর প্রবল প্রভাব। স্পিকারের আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তিনি নেতা। পেশায় আইনজীবী। দুরন্ত ব্যক্তিত্ব। বারবার বিধানসভায় বামেদের বাঁচিয়েছেন। আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব। মন্ত্রীদের বকতেন। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুদেরও অনায়াসে নির্দেশ দিতেন। সব কটি দাঁত বাঁধানো নয়। একটু ফাঁক। তাই নিয়ে যখন ঝড়ের বেগে অবোধ্য সাহেবি ইংরেজি বলতেন, সভা এমনিই ঠান্ডা হয়ে যেত। কারণ অধিকাংশের পক্ষেই সেটা বোঝা সম্ভব হত না।

হালিমসাহেব জ্যোতিবাবুর ঘরানা। বুদ্ধবাবুদের সঙ্গে মন মিলত না। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম প্রকল্প সমর্থন করতেন। কিন্তু পদ্ধতি সমর্থন করেন নি। বরং মনে করতেন বুদ্ধবাবুর ভুল নীতিতে দল ডুবছে। খোলাখুলি বলেও দিতেন। তবে আচরণ ছিল সুশৃঙ্খল কমরেডের মতো।

মমতাদির বহু কাজ সমর্থন করতেন না। কিন্তু মমতাদির লড়াইয়ের মানসিকতাকে কদর করতেন। আমার ওদিকের প্রতি দুর্বলতা জানতেন বিলক্ষণ। হয়ত ঘরে ওঁরই পার্টিনেতারা বসে। আমি ঢুকলাম। চিৎকার করে বললেন,” এই যে দিদির লোক এসে গেছে। ওকে চা দাও।” তারপর আড্ডা। এইসব পরিবেশ আজ বড় মিস করি। এসব আড্ডায় থাকতেন কয়েকজন, তার মধ্যে তৎকালীন বিধায়ক কণিকা গাঙ্গুলি, পুরপিতা দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রায় নিয়মিত। বিরোধীদেরও অনেকেই তাঁর প্রিয়। সোমেনদা, সুব্রতদারা তো ছিলেনই, পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে খুব পছন্দ করতেন তিনি। বলতেন,” অনেক বড় দায়িত্ব সামলানোর যোগ্যতা আছে ওর।”
ঐ ঘরের স্মৃতি আমার কাছে চিরদিন উজ্জ্বল থাকবে।
এবং বুক বাজিয়ে বলতে পারি, ঐ সময়টা বিধানসভার খবরে আমাকে ম্যানমার্কিং করেও সামলাতে পারত না বাকিরা। কারণ রাখেন হালিমসাহেব মারে কে!!

তখন আমি তৃণমূলের সাংসদ। উনি 2011তে আর ভোটে লড়েননি। শরীরও ঠিক নেই। বাড়িতে দেখা করতে গেলাম। টিপস্: ” নিজে ভালো বক্তৃতার জন্য খেটেখুটে তৈরি হবে। সবাইকে উপেক্ষা করে সেরা বক্তৃতা করবে। আর বিরুদ্ধ কোনো ভালো বক্তা বললে চেষ্টা করবে মাঝপথে তার ছন্দ নষ্ট করতে। ছন্দ পেতে দেবে না। আর তোমাকে যদি নিয়ম দেখিয়ে কেউ কিছু বলতে বাধা দেয়, ঝগড়া না করে শুনবে। তারপর কী কী বলছ না সেটা বলতে থাকবে।”
আমি এটা রাজ্যসভায় পরে প্রয়োগ করেছিলাম। স্বয়ং সীতারাম ইয়েচুরিকে দাঁড়াতে হয়েছিল নবাগত সদস্যকে ঠেকাতে। তুমুল তর্ক হলেও পরে সবাই বলেছিলেন জব্বর কৌশল।
সৌজন্যে হালিমসাহেব।

সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামকান্ডের পর একবার মুখ্যমন্ত্রী বদলের কথা উঠেছিল। হালিমসাহেব আর অসীম দাশগুপ্ত। জল্পনা সর্বত্র। হালিমের পাল্লা ভারি। কিন্তু পার্টি সে পথে যায় নি। যদি সেই সময় বুদ্ধবাবুকে সরিয়ে হালিমসাহেবকে মুখ্যমন্ত্রী করা হত, তাহলে অনেক ইতিহাসের বদল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে শোক অনেক। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে কাকিমার কাছে মানুষ। আবার পরে বড় মেয়ের অকালমৃত্যু। ক্যানসারের শিকার।

তার মধ্যেও দৈনন্দিন জীবনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবির হালিমসাহেব নিজেকে এমনভাবে রেখেছিলেন, তাঁর জন্যে এখনও বুকভরা শ্রদ্ধা।
তাঁকে নিয়ে এইটুকু জায়গায় লেখা সম্ভব নয়। অনেক ঘটনা। এ নিয়ে আমার একটি ই-বইও আছে। তাতেও সবটুকু ধরা সম্ভব নয়। আসলে দীর্ঘ সময় অধিবেশন থাকলে যেতাম। না থাকলেও যেতাম। হালিমসাহেবের টানে, তাঁর কাছে। না গেলে ফোন আসত। লোক মারফৎ খবর আসত। -” লাটসাহেব হয়ে গেছো? আসতে পারো না?”
কানে বাজে।

পরের স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমার পূর্ব পরিচিত। আইনজীবী। দারুণ মানুষ। 2011তে তাঁর ভোটে লড়া এবং সম্ভাব্য দায়িত্বটির বিষয়ে নেত্রীর সিদ্ধান্তের প্রথম ফোন তিনি আমার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন বলে মনে হয়। তবু, হালিমসাহেবের পর এই বিধানসভা ভবনটি আমার কাছে এক গভীর শূন্যতা।
অল্পবয়স থেকে হালিমসাহেবের সান্নিধ্য, স্নেহ পেয়েছি। এক বর্ণময় বহুমুখী ব্যক্তিত্বকে দেখেছি। তারপর এক শূন্যতা লাগে।

আমার সৌভাগ্য, আমি বহু নেতার ভালোবাসা পেয়েছি। বহু বিশিষ্টকে কাছ থেকে দেখেছি।

কিন্তু পিতৃসম শব্দটা প্রয়োগ করা যায় দুজনের ক্ষেত্রে।
উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রয়াত সম্পাদক সুহাস তালুকদার। আর হাসিম আবদুল হালিম।

হালিমসাহেব সিঙ্গাপুরে। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সিঙ্গাপুরনিবাসী প্রবাসী বাঙালি শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে বললাম। প্রসূনদা ছুটে গেলেন হাসপাতালে। তারপর ফুয়াদদারাও পৌঁছলেন। সে যাত্রা সেরে উঠে কলকাতা ফিরলেন হালিমসাহেব।

পরে হালিমসাহেবের মৃত্যুর সময়ে আমি প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি। খবর পেয়ে মন ভেঙে গেছে। শুধু মরদেহ দেখতে যাওয়ার জন্য একঘন্টা প্যারোল আবেদন করেছিলাম ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে। ছেলেটি ভালো। তবে একটু পরে এসে জানালো, এটা নিয়ে এগোবেন না। আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না। বোঝেন তো সব। সুপার বোঝালেন, আইনেও আটকাচ্ছে।

স্যর, প্রণাম।
খুব খুব মিস করি আপনাকে। যতদিন বাঁচবো, এই ভাবেই মনে রাখব।
যদি আগামী জন্ম বলে কিছু থাকে, সেখানেও যেন আপনাকে অভিভাবকের জায়গায় পাই।

Advt

spot_img

Related articles

রাম-রাম রাজনীতির বোঁড়ে অভয়ার বাবা-মা! আচমকাই হাজির শিক্ষক আন্দোলন মঞ্চে

রাজ্য সরকার অপরাধীকে গ্রেফতার করে তার সর্বোচ্চ শাস্তির পথ সুগম করেছিল। আদালতে বিচারাধীন এই মামলা এখনও বিচার দিতে...

খুশির আবহ দার্জিলিং চিড়িয়াখানায় ! দুটি স্নো লেপার্ড শাবকের জন্ম দিল “রের”

সুখবর দার্জিলিংয়ের পদ্মজা নাইডু চিড়িয়াখানা থেকে। স্নো-লেপার্ড ‘রের’ এবং ‘নামকা’-র ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। ১৩ মে রাতে ওই...

বীর সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা! তৃণমূলের শহিদতর্পণ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে ব্যাপক সাড়া রাজ্যে 

দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে দেশের বীর সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শহিদদের আত্মার শান্তি কামনায় রাজ্যজুড়ে পালিত হল তৃণমূল...

হরপ্রীত ব্রারের দুরন্ত স্পেলেই প্লেঅফ পাকা পঞ্জাব কিংসের

শ্রেয়স আইয়ারের(Shreyas Iyer) বদলে ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার হরপ্রীত ব্রার(Harpreet Brar)। আর সেটাই যে এদিন পঞ্জাব কিংসের(PBKS) মাস্টার স্ট্রোক ছিল...