Monday, August 25, 2025

আকাশের ওপারে আরেক আকাশ…সুখেন্দু শেখর রায়ের কলম

Date:

Share post:

 

সম্পত্তির বিবাদে খুন হয়ে গেলেন ছ’বছর বয়সী উমার বাবা-মা দুজনই।

মথুরার কাছের এক গ্রাম থেকে দাদার সঙ্গে উমা গেলেন কাকার বাড়ি। অল্পদিনের মধ্যে দাদাও খুন হল একই দুষ্কৃতীদের হাতে। দু’বেলা রুটি আর আশ্রয় পায় বলে কাকার বাড়ির ছাদের সিঁড়ির তলা থেকে কোথাও যায় না উমা। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে রাতে সিঁড়ির তলায় শুয়ে উমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো। সে সময় তাঁর কানে ভেসে আসত কাকার ঘর থেকে রেডিও-র গান। কখনও কে এল সায়গল, কখনও বা কানন দেবীর অপূর্ব সব গান। সেসব গান শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়তো উমা। স্বপ্ন দেখতো, একদিন সে-ও এমন গাইবে রেডিও-তে।

জেদ চাপলো মনে। প্রায়ই ছাদে গিয়ে রেডিও-তে শোনা গানগুলি সে গলা ছেড়ে গাইত। আর মনে মনে বলত, আমিও পারবো, পারবোই। মনও উত্তর দিত, হ্যাঁ,পারবি।

 

এইভাবে কেটে গেল ১৭ বছর। তারপর মাত্র ২৩ বছর বয়সে উমা কাকার বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এলো বম্বেতে। গত তিন দশকের বিখ্যাত নায়ক গোবিন্দা-র বাবা, মা-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল সেখানে। ওরা দুজনেই হিন্দি চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতেন। তাঁরা উমার গানের প্রতি তীব্র আকর্ষণ জেনে সুরকার নৌশাদ আলির সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলেন।

পরের দিনই উমা পৌঁছে গেলো নৌশাদ সাহেবের বাড়িতে । তাঁকে বলল, ‘আপনি যদি আমাকে ফিল্মে গান গাইবার সুযোগ না দেন তাহলে আপনার বাড়ির সামনে আমি সাগরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরবো’। সদাশয় নৌশাদ শুনলেন উমার জীবনবৃত্তান্ত। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কিন্তু তুমি তো গান শেখোনি। গাইবে কীভাবে ?

উমা বলে উঠল, ‘এইভাবে…।’ আর তারপরই গাইতে শুরু করল, তিনের দশকের ‘চন্ডীদাস’ ছায়াছবিতে সায়গল-উমাশশীর বিখ্যাত গান- “প্রেমনগর মে বনাউঙ্গি ঘর মৈ…।” পরের দিনই হল অডিশন, মনোনীত হল উমা।

১৯৪৬ সাল। ‘ওয়ামিক আজরা’ ছবিতে গান গাইলো উমা। এখন তাঁর পরিচয় উমাদেবী। নৌশাদের সুপারিশে চুক্তিবদ্ধ হলেন প্রযোজক-পরিচালক এ আর কারদারের ফিল্ম কোম্পানিতে। মাসিক বেতন, ২০০ টাকা।১৯৪৭-এ কারদারের ‘দর্দ’ ছবির বিখ্যাত নায়িকা মুনাওয়ার সুলতানার লিপে গাইলেন, ‘অফসানা লিখ রহি হুঁ’ এবং ‘আজ মচি হ্যায় ধুম’-এর মত প্রবল জনপ্রিয় গান। সবার মুখে তখন একটাই প্রশ্ন, কে এই উমা? এমন মধুর কণ্ঠ! রাতারাতি রাজকুমারী, সুরাইয়া, খুরশিদ বানো, জোহরাবাঈ-এর মত গায়িকাদের সারিতে এসে দাঁড়ালেন উমাদেবী। ‘অফসানা লিখ রহি হুঁ’ শুনে দিল্লীর এক গান-পাগল বম্বেতে ছুটে এলেন উমাকে দেখতে। প্রেম আর বিয়ের পরিণতিতে তাঁরা দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা-মা হলেন। উমা তাঁর স্বামীকে ‘মোহন’ নামে ডাকতেন।

 

ইতিমধ্যে মেহবুব খানের ‘আনোখি অদা’ (১৯৪৮) ছবির দুটি গান, ‘কাহে জিয়া ডোলে’ ও ‘দিল কো লগাকে হমে’ দুর্দান্ত হিট হয়েছে। তবে মাদ্রাজের বিখ্যাত জেমিনি ষ্টুডিও-র ছবি, এস এস ভাসানের পরিচালনায় ‘চন্দ্রলেখা’-য় সাত-সাতটি গান গেয়ে উমাদেবী জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান। বেশির ভাগই ছিল রাগাশ্রিত গান। জীবনে সঙ্গীতের কোনও তালিম না নিয়ে এইভাবে যে রাগের অনুরাগে সুর উজাড় করে দেওয়া যায় তা আগে কখনও কেউ শোনেনি।

 

কিন্তু তুঙ্গে ওঠা এই জনপ্রিয়তাই কাল হল। পরিচালক কারদারের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিঙঙ্গের অভিযোগে ফ্যাসাদে পড়লেন উমাদেবী । লেখাপড়া শেখেননি, গানই ছিল তাঁর জীবন। এবার কী করবেন? আবারও পাশে দাঁড়ালেন নৌশাদ সাহেব।বললেন, ‘জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেও তুমি সবসময় হাসিখুশী থাক। তোমার কথা, আচরণ, অভিব্যক্তি সবাই খুব পছন্দ করে। আমি বলি কি, তুমি এবার ফিল্মে অভিনয় শুরু করো’।

উমার চটজলদি উত্তর, ‘ঠিক আছে। তবে আমি দিলীপ কুমারের ছবি ছাড়া অভিনয় করব না। আর তার সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই করে দিতে হবে’।

 

এরপর দিলীপকুমার- নার্গিসের ‘বাবুল’ (১৯৫০) ছবিতে নৌশাদ অভিনয়ের সুযোগ করে দেন উমাকে। উমা আর হেমন্ত কুমারকে দিয়ে ঐ ছবিতে একটি গানও তৈরি করলেন নৌশাদ। কিন্তু দিলীপ কুমার বেঁকে বসায় ছবিতে ওঁদের গান বাদ গেল। শোনা যায়, পেছন থেকে কলকাঠি নেডেছিলেন ওই কারদার-ই। তবে ঐ একই গান আবার রেকর্ড করা হল তালাত মেহমুদ ও শামসাদ বেগমের কণ্ঠে। গানটি সুপারহিট হয়। উমা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বললেন, ‘দাদা, আমার জন্যই আপনি অপমানিত হলেন’। হেমন্ত হেসে বললেন, ‘তুমি তো তবু অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছ। আর আমি একেবারে বাদ (পরে অবশ্য এইচএমভি ওদের ঐ বাদ পড়া গানটি ‘ভার্সান রেকর্ড’ হিসেবে বের করে)।

 

প্রথম অভিনয়েই মাত করে দিলেন উমা। দিলীপ কুমার উমার স্থূল চেহারার জন্য নাম রাখলেন ‘টুনটুন’।

এরপর উমা গুরুদত্তের ছবি আরপার, মি:অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ, প্যায়সা থেকে শুরু করে অমিতাভ বচ্চনের ‘নমক হালাল’ বা রাজেশ খান্নার দো রাস্তে, আখরি খত ছবি মিলিয়ে চার দশকে ১৯৮টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, গুলজার, প্রকাশ মেহরা, বাসু চট্টোপাধ্যায়ের মত পরিচালকের ছবিতে জনি ওয়াকার, মেহমুদ, সুন্দর, মোহন চোটি, আগা, ধূমল, কেষ্ট মুখার্জিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৌতুক অভিনয় করতেন উমাদেবী ।

 

বস্তুত উমা দেবী ওরফে টুনটুনই ছিলেন ভারতীয় ছায়াছবির প্রথম এবং সফল মহিলা কৌতুকাভিনেত্রী। উত্তরপ্রদেশের অখ্যাত গ্রামের ঘরছাডা ভাগ্যহত ২৩ বছরের এক যুবতী, অচেনা বোম্বাই নগরীতে এসে পর্দায় ও পর্দার নেপথ্যে নিজেকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনই রোমাঞ্চকর। আজও মোটা মেয়েদের দেখে রসিকতা করে কেউ কেউ বলে ‘টুনটুন’। কিন্তু উমা থেকে উমাদেবী এবং শেষপর্যন্ত টুনটুন-এ বদলে যাওয়ার পিছনে যে তাঁর জীবনের প্রতিটি নিশ্বাসের ছোঁয়া ছিলো, তার কতটুকুই বা আমরা জানি?

_____

*লেখক- রাজ্যসভার সাংসদ*

 

spot_img

Related articles

কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি: দু-মলাটে বাংলার দুর্গোৎসবের ৪৩৪ বছরের ইতিহাস

রবিবাসরীয় সন্ধেয় গড়িয়াহাটের একটি ব্যাঙ্কয়েটে আড্ডার আবহে প্রকাশিত হল সাংবাদিক-লেখক সম্রাট চট্টোপাধ্যায়ের বই 'কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি'। উপস্থিত...

তৃণমূল–সমাজবাদী পার্টির পথে এবার আম আদমি পার্টি! জেপিসিতে থাকছে না আপও 

সংবিধান সংশোধনী বিল খতিয়ে দেখতে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিল আম আদমি পার্টি।...

মোদির বিরুদ্ধে সরব! হিটলারি কোপে লাদাখের সোনম ওয়াংচু

দফা এক দাবি এক। লাদাখের জন্য একই দাবিতে আজও অনড় সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচু (Sonam Wangchuk)। লাদাখের জমি, যা...

শান্তিপুরে মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর ভোটে গোহারা বিজেপি! ২৬-৪-এ জয়ী তৃণমূল 

এসআইআর ইস্যু নিয়ে রাজ্যে বিজেপির মাতামাতির মধ্যে নদিয়ার শান্তিপুরে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ক্লাস্টার কমিটির নির্বাচনে বড় সাফল্য পেল...