কুমোরটুলি থেকে কফি হাউস, পার্বণ থেকে প্রেম, অসুখী সময়ের ইতিবৃত্ত, দিব্যেন্দু ঘোষের কলম

কুমোরটুলি, কফি হাউস
দিব্যেন্দু ঘোষ

কুমোরের টুলি

মৃন্ময় জগতের আঁতুড়ে সন্ধের শঙ্খধ্বনি সুর ভুলেছে | পলেস্তারা খসা অমসৃণ সময়ের দেওয়ালে মনখারাপ জমাট হয়ে আসে| তাল তাল মাটি আর দক্ষ হাতের যুগল কাজে মন দিতে অপারগ| জীবন আর উপার্জনের সঙ্ঘাত তীব্রতর বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে| তবুও ওরা পড়ে থাকে সৃষ্টির অবিন্যস্ত গলিতে| ধূসর স্বপ্নের ছায়া আর বুকে বারুদঠাসা আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ওরা রাতের চাটাই পাতে| ভোরের আজান মিইয়ে আসার আগেই একে একে খুলে যায় টিনের একচালা| টালির উঠোন জুড়ে পড়ে থাকা মূর্তি আর ঘন রোদে আঁধার কাটা কুঁড়ে| গলি থেকে তস্য গলি, মাটির আনকোরা গন্ধে মনের উচাটনি অভ্যাস বার বার অসুখের পাড়ে ধাক্কা খায়| বছরের পর বছর ধরে ওরা থাকে ওখানে| এমনতরো মিথ্যে অভ্যাসের পালে কখনও হাওয়া লাগেনি | লাগার কথাও ছিল না | বাঙালির পার্বণী প্রতিক্ষা ওই গলিজুড়েই যে আবর্তিত হয়েছে | বছরভরের ব্যস্ততা কুড়িয়ে নিতে নিতে ওরা ক্লান্ত হয়েছে| কখনও নিদারুণ বিশ্রামে ক্লান্তি নামেনি মাটির আগলে|

কলেজ স্ট্রিটের আড্ডা

কোথাও আবার নরম সিঁড়ি, টানা বারান্দা, ঢাউস পাখার ঘসটানো শব্দের নীচে পাতা থাকে বিশ্রাম| আড্ডা জমে| সিগারেটের ধোঁয়া ওঠার কোনও বিরাম থাকে না| আড্ডা চরমে উঠতে উঠতে কখনও এলিয়ে পড়ে কাঠের চেয়ারে| আঙুল জুড়ে থাকে একান্ত আপন হয়ে| ঠোঁট এগিয়ে এসেও দূরে সরে যায়| সম্পর্কের ব্যবধান কাছে আসে| আরও কাছে| কোল্ড কফির পেয়ালা আর সম্পর্কের উত্তাপ যেন বিনি সুতোয় বাঁধা হয়ে যায়| ফিশ কাটলেট বা চিকেন পকোড়ার অর্ডারের জন্য় হাপিত্যেশেও সুখ দুলে ওঠে| সিগারেটের কাউন্টার এক ঠোঁট থেকে আরেক ঠোঁটে স্থাপিত হয়| প্রথম প্রেমের নিভৃত অভিঘাতে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত জন্ম নেয় অচেনা কফি হাউস. বই-খাতার দুদণ্ড আলাপ আর কলেজ-ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের সখ্যতা ঝুল-বারান্দার কোণের টেবিলে গাঢ় হয়| সিঁড়ির দেওয়ালে স্লোগান আর হাতে আঁকা ছবি, সঙ্গী কিছু টেরাকোটা| ভিতরে একঝাঁক অজানা অচেনা পাখি| এক ছাদের তলায় বিলকুল কিচিরমিচির| অভিজাত রেস্তোরাঁর ফিসফিসানি যেখানে উধাও| মেঝে থেকে সিলিংয়ের দূরত্ব, দেওয়ালে রবিঠাকুরের প্রতিকৃতি আর আড্ডার রোশনাই সব পেয়েছির আসরে ঘাঁটি গাড়ে| বড় বড় কাঠের জানলা, দমকা হাওয়ার ঝাপটা আর ভেতরে আলো-আঁধারি খেলা| কোথাও শেষ বিকেলের আলো, কোথাও টিমটিমে বৈদ্যুতিক বাতি. ঝুলপড়া নিয়নের নীচে নিখাদ আড্ডাসরণি| বিকেল সাড়ে চারটেতেই হাউসফুল| দাঁড়িয়ে হত্যে দেওয়া. তেলেভাজা, আদা-চা আর কফির গন্ধ মিলেমিশে সুগন্ধের খিচুড়ি পাকায় অন্দরে| করিডর ধরে টেবিলের মাঝখান দিয়ে হাঁটার সময় মনে আসে, ওই কোণার টেবিলটায় কি ঝাঁকড়া চুলে মাথা নিচু করে, মোটা চশমায় চোখ লুকিয়ে নিজের নীল ডায়েরির পাতায় কবিতা লিখছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায় ? লম্বাটে টেবিলটায় কি ব্রিটিশ হঠাও আন্দোলনে স্বদেশি নেতারা মিটিং করেছিল ? কোনও টেবিলের কোণায় ধারালো কিছু দিয়ে লেখা ইংরেজি এম| তখনই মনের মধ্যে সিঁদ কাটে মান্না দে| মইদুল চলে যাওয়ার পর তারই কোনও স্মৃতিকাতর বন্ধু টেবিলে আনমনে লিখে রেখেছে নামের আদ্যক্ষর ? মইদুল কি জানতে পেরেছিল কোনওদিন এ কথা ? ওয়েটারের বাঁকা চোখ, ফরমাশে তাড়া, মিলেজুলে আড্ডার সর্বনাশ পেরিয়ে বাঙালি দার্শনিক কেশবচন্দ্র সেনের বসতবাড়িটি চঞ্চল হয়ে ওঠে| পরে ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অ্যালবার্টের নামে এর নাম দেওয়া হয় অ্যালবার্ট হল|১৯৪২ সালে সরকারি উদ্যোগে অ্যালবার্ট হল হয়ে যায় কফি হাউস| আরও পরে ইন্ডিয়ান কফি হাউস| অসুখে অসুখে কফি হাউসের সেই আড্ডা আজ বড় দৈন্য|

আরও পড়ুন-দেখে নিন ২০২১ সালের দুর্গাপুজোর নির্ঘণ্ট

কুমোরের টুলি

মাটি নিয়েই চলে জীবন-জীবিকা| মাটির ঘরেই ওদের বাস| শহর লাখ টাকার থিমপুজোয় মাতে| ওদের অন্ন জোগানোর তীব্র প্রয়াস| মৃন্ময়ী প্রতিমায় নিপুণ তুলির টান| চিন্ময়ী হয় তিলোত্তমা| অশুভ নিধনে শুভ চেতনা জাগরণে| খুশির বার্তা বয়েই ঘরে ফেরে উমা| উৎসবের আলোতেও আঁধার ঘর| সেই ব্যস্ত পাড়াটির নাম কুমোরটুলি| আসলে ওদের হাতেই পুজো আসে| তোমার মুগ্ধতায় তৃপ্ত ওদের ঝুলি| এ গলিতে আজ কঠিন অসুখ| গলি, তস্য গলি পেরিয়ে ছোটে রিক্ততার জীবাণু| প্রাণের শেষ বিন্দুটি ধরে রাখার অনবরত বিফল চেষ্টা| কুমোরটুলি আজ ক্লান্ত| অসুখের ব্যর্থতা আর ধুলোওঠা বিবর্ণ সাদাকালো ক্যানভাস তফাত বোঝে না জ্বলন্ত রৌদ্রে| বাঁশের কাঠামো আর খড়ের আস্তরণ পেরিয়ে মাটির অন্তরঙ্গে প্রাণ আজ বড্ড বেশি বহিরাঙ্গিক| সৃষ্টিসুখের দেওয়াল কেঁপে কেঁপে উঠছে| মুহুর্মুহু জীবন ও যাপনের কলহের আঘাত| কুমোরটুলির গভীর ক্ষত| ধীর হয় স্পন্দন| থেমে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস| সামনে শুধুই অন্ধকার| এ অন্ধকার আমার কুমোরটুলি না| এ দৈন্যতা আমার কুমোরটুলি না| এ বিবর্ণতা আমার কুমোরটুলি না| আস্ত তালাটা খুলে ফেলো| আটচালার আবছা ছবিটা তীব্রতর রং পাক, ভোরের শিশিরের গন্ধ আর শিউলির মনোরম দৃশ্যপটে তোমায় বাঁচতেই হবে| শহুরে আলো আর মূর্তির তেলরঙা আতিথেয়তার জন্ম কুমোরপাড়া, তোমায় জেগে উঠতেই হবে| এ গলিতে আঁধার চাই না| অসুখের তপ্ততা চাই না| মহামারীর বিষাদ চাই না| মাটিমাখা আঙুলগুলোর চলমান তারুণ্য চাই| সৃষ্টিসুখের উল্লাস চাই| নতুন জামা চাই| মহালয়ার ভোর চাই| বায়না চাই| কুমোরপাড়ার ঘরে ঘরে ব্যস্ততা চাই| কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপে ঠাকুর চলে যাওয়ায় মনখারাপ চাই|

কলেজ স্ট্রিটের আড্ডা

আড্ডায় মনখারাপ চাই না| সোনালি বিকেল হারিয়ে যাক, চাই না| নিখিলেশ প্যারিসে, মইদুল ঢাকাতে থাকলেও তাদের খবর চাই| গ্র্যান্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিজ ডিসুজা আর কত ঘুমোবে কবরে ? রমা রায় তার ভালবাসা ফিরে পাক, ক্যানসার সারিয়ে ফিরে আসুক অমল| সুজাতা সুখী থাক, আজীবন| নিখিলেশের বিজ্ঞাপনের ছবি কদর পাক| ডিসুজা শুধু বসে কেন থাকবে ? সে কবিতা লিখুক, বিষ্ণু দে, যামিনী রায়কে নিয়ে তর্কে মাততে তো কোনও আপত্তি নেই| রমা রায়ের অভিনয় শুধু অ্যামেচার নাটকেই কেন বন্দি থাকবে| মইদুলের দুরন্ত কপি কেন বাইলাইন পাবে না, কেন তার কপি অ্যাঙ্কর স্টোরি হিসেবে ছাপা হবে না| বুড়ো ট্রাম তার আদর বিছিয়ে ফিরে যাক| বন্ধু বন্ধুর কথা শুনুক, গা ঘেঁষে থাক| নিরন্তর ভাল লাগা, ভালবাসার গল্প তৈরি হোক সেই টেবিলে| কফির সৌরভে ভালবাসা ভেসে থাক, অবিরাম জন্ম নিক প্রেম| ফের স্বপ্নের রোদ উঠুক|
পার্বণ ছাড়়া কি প্রেম হয়, কিংবা প্রেম ছাড়া পার্বণ!

কুমোরটুলি আর কফি হাউস তাই বন্ধনহীন গ্রন্থির মতো জুড়ে থাক| অসুখ শেষে ফিরব, কথা দিলাম|

Previous articleআগামী সপ্তাহেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবদল, বঙ্গ-বিজেপি তাকিয়ে দিল্লির দিকে
Next articleবিশ্বে অস্ত্র বিক্রির দৌড়ে চিনকে পিছনে ফেলতে চলেছে ভারত