গবেষণা রিপোর্ট: ধনীদের তুলনায় বস্তিবাসীদের শরীরে অ্যান্টিবডি বেশি

খায়রুল আলম, ঢাকা

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাসরত ধনী লোকদের চেয়ে বস্তি এলাকার লোকদের অ্যান্টিবডি ক্ষমতা অনেক বেশি। এধরণের কথা অতিমারি করোনা শুরুর পর থেকে মুখে মুখে শোনা গেলেও এবার এটির বাস্তবতা মিললো এক গবেষণায়। এতে দেখা গেল রাজধানী ঢাকার বস্তি (Slum) এবং বস্তিসংলগ্ন এলাকার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনের শরীরেই করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি ( Antibody) তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রামের (Chottogram) বস্তি এলাকাগুলোতেও এই হার ৫৫ ভাগ। অর্থাৎ বস্তি এবং বস্তির আশপাশের এলাকার এই অধিবাসীরা কোনও না কোনও সময় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন অথবা সংস্পর্শে এসেছিলেন। আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি-ICDDRB) তাদের এক গবেষণার ফলাফলে (Research) এ তথ্য জানিয়েছে।

মঙ্গলবার এক ওয়েবিনারে (Weabinar) এই গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশিত হয়। আইসিডিডিআর,বি করোনা সংক্রমণের বিস্তার নির্ণয়ের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তি এবং বস্তিসংলগ্ন এলাকায় ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই গবেষণা চালায়। গবেষণায় প্রধান গবেষক ছিলেন আইসিডিডিআরবির ডা. রুবহানা রাকিব ও ড. আবদুর রাজ্জাক। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও-FCDO) এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ-UNFPA)। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এ গবেষণায় অ্যাডভোকেসি পার্টনার (Advocacy Partner) হিসেবে কাজ করেছে।

গবেষণায় বলা হয়, গত পাঁচ মাসে তিন হাজার ২২০ জনের মধ্যে করা এ গবেষণায় বয়স্ক ও তরুণদের মাঝে এর হার প্রায় সমান। গবেষণার জন্য এসব এলাকায় বসবাসকারী করোনার উপসর্গযুক্ত ও উপসর্গহীন ব্যক্তিদের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় গৃহস্থালি পর্যায়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ, রক্তচাপ ও শরীরের পুষ্টি পরিমাপ এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

এ সমীক্ষার মাধ্যমে সেরোপজিটিভিটি Seropositivity (রক্তে SARS-CoV-2–এর উপস্থিতি) সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বস্তি এবং বস্তির বাইরে বসবাসকারী মানুষের রক্তে কোভিড-১৯ ( Covid-19) এর উপস্থিতি এবং তার সম্ভাব্য কারণ নির্ণয় করা। সম্ভাব্য যেসব কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- শরীরে অন্য কোনও শ্বাসকষ্টজনিত ভাইরাসের উপস্থিতি, পুষ্টিগত অবস্থা (যেমন: ভিটামিন ডি, জিংক, সেলেনিয়াম) এবং রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় চট্টগ্রামের তুলনায় অ্যান্টিবডির হার (সেরোপজিটিভিটি-Seropositivity) বেশি। চট্টগ্রামে যেটি ৫৫ শতাংশ, ঢাকায় সেটি ৭১ শতাংশ। অপরদিকে, বয়স্ক ও তরুণদের মধ্যে অ্যান্টিবডির হার প্রায় সমান। আবার পুরুষের তুলনায় নারীদের অ্যান্টিবডির হার বেশি। নারীদের মধ্যে অ্যান্টিবডির হার ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ আর পুরুষদের শরীরে অ্যান্টিবডির হার ৬৬ শতাংশ।

আইসিডিডিআরবি জানায়, যেসব অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির (মোট ২ হাজার ২০৯ জন) মধ্যে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে শুধু ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। স্বল্পশিক্ষিত, অধিক ওজন, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস যাদের আছে, তাদের মধ্যে অধিক মাত্রায় সেরোপ্রিভ্যালেন্স (রক্তে কোভিড উপস্থিতির হার) দেখা গেছে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বারবার হাত ধোয়ার প্রবণতা, নাক-মুখ কম স্পর্শ করা, বিসিজি টিকা গ্রহণ এবং মাঝারি ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করা ব্যক্তিদের মধ্যে কম মাত্রার সেরোপ্রিভ্যালেন্স দেখা গেছে। সেরোনেগেটিভ ব্যক্তিদের তুলনায় সেরোপজিটিভ ব্যক্তিদের মধ্যে সেরাম জিংকের মাত্রা বেশি দেখা গেছে। এটাই হয়তো গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে রোগের মৃদু লক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গবেষণায় ভিটামিন ডির (Vitamin-D) অপর্যাপ্ততার সঙ্গে সেরোপজিটিভিটির কোনও প্রভাব দেখা যায়নি; বরং গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ভিটামিন ডির উচ্চমাত্রার ঘাটতি দেখা গেছে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বস্তির বাইরে, বস্তিসংলগ্ন এলাকার নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের তুলনায় করোনা অ্যান্টিবডি হার বস্তিতে বেশি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মধ্যে ঘন ঘন হাত ধোয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রভাব ফেলেছে। সেরোপজিটিভিটির সঙ্গে যুক্ত অন্য প্রভাবক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। মাঝারি কায়িকশ্রম যারা করেন, তাদের মধ্যে সেরোপজিটিভিটির সম্ভাবনা কম দেখা গেছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হলেও অ্যান্টিবডি পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের লক্ষণ উপসর্গ ছাড়াও অনেকে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন। যে কারণে তাদের মধ্যে সেরোপজিটিভিটি তৈরি হয়েছে। তবে তা কেন হয়েছে তা নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।
‘কিন্তু আমরা এই স্টাডি ছাড়াও আরও কয়েকটি স্টাডিতে আমরা একই প্যাটার্ন দেখেছি যে বস্তি এলাকার মানুষ ভাইরাসের সংস্পর্শে বেশি এসেছে। যে কারণে তাদের শরীরে অ্যান্টবডি তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাসের ৯০ শতাংশই লক্ষণ-উপসর্গহীন হয়, সুতরাং বস্তিতে বেশি হওয়ার কারণ এটা’- যোগ করেন তিনি। এই গবেষণার বরাত দিয়ে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ( Executive Director) ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, এতে দেখা গেছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়ানো যায়। তিনি বলেন, মানুষকে কায়িক পরিশ্রম করতে হবে, ব্যয়াম করতে হবে। করোনাভাইরাস থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। লক্ষণ উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা করাতে হবে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ( Cheif Scientific Officer ) ডা. এএসএম আলমগীর, আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরিসহ আরও অনেকে ওয়েবিনারে অংশ নেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআর,বির প্রধান গবেষক ডা. রুবহানা রাকিব।

আরও পড়ুন- তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য ভ্যাকসিনেশনের উদ্যোগ, টিকা নিলেন মিমিও