বিপন্ন কয়েকশো বছরের প্রাচীন মালদহের  আমসত্ত্ব শিল্প

বাঙালির হেঁশেলে আমসত্ত্ব নেই, এমনটা খুব একটা দেখা যায় না ৷ এক সময় মুঘল বাদশারাও আমসত্ত্বের স্বাদে মজেছিলেন ৷
কিন্তু কয়েকশো বছরের প্রাচীন , মালদার এই আমসত্ত্ব শিল্প এখনও সেভাবে বাজার পায়নি ৷ এমনিতে প্রতি বছর ভিন রাজ্যে হওয়া ফুড মেলাগুলিতে মালদার আমসত্ত্ব বেশ বাহবা পায় ৷ তাই সঠিক প্যাকেজিং, হাইজিনের দিকটি খেয়াল রেখে ঠিকঠাক বাজারজাত করতে পারলে অন্তত বছরে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে ৷
মালদায় প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয় ৷ বছরে আমের ফলন তিন লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যায় ৷
এবারও জেলায় অন্তত সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে ৷ ফলন ভাল হওয়ায় এবার আমসত্ত্ব তৈরিতে জোর কদমে নেমে পড়েছেন জেলার মহিলারা ৷ কারণ আমসত্ত্ব তৈরিতে মহিলারাই বেশি দক্ষ ৷ মালদার কালিয়াচক থেকে হরিশ্চন্দ্রপুর, আমসত্ত্ব তৈরি হয় সব জায়গাতেই ৷ তবে রং ও স্বাদে সবার প্রথমে নাম আসে ইংরেজবাজারের কোতোয়ালি, টিপাজানি, ধানতলা প্রভৃতি এলাকার তৈরি আমসত্ত্ব ৷

আম থেকে তৈরি এই আমসত্ত্বে দাম মান অনুযায়ী কিলো প্রতি ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে ৷
খেতে যতটা সুস্বাদু, আমসত্ত্ব তৈরি করার প্রক্রিয়া মোটেও ততটা সহজ নয় ৷ দু কেজি আমসত্ত্ব তৈরি করতে ৩৫ থেকে ৪০ কিলো ভাল মানের আমের প্রয়োজন হয় ৷ বারবার মুছে অল্প অল্প করে রস দিয়ে প্রলেপ দিতে হয় ৷ এতে যেমন সময় লাগে তেমনই পরিশ্রম রয়েছে ৷ যদিও এ-বছর মালদায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে ৷ এতে প্রচুর আম নষ্ট হয়েছে ৷ আমসত্ত্ব শুকোতেও কড়া রোদের প্রয়োজন ৷ সব মিলিয়ে বিপাকে মালদার আমসত্ত্ব কারিগররা ৷
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের তরফে কিছু স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীকে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ দেওয়া হয়েছে ৷ এই কাজে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং কিছু যন্ত্রও দেওয়া হয়েছে ৷ যদিও তার সংখ্যা খুব কম ৷ এখনও প্রচুর মহিলা অসংগঠিতভাবে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ করে থাকেন ৷ কোতোয়ালি এলাকার একটি স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা বলছেন, “একাধারে ফলন ও আবহাওয়ার উপর আমাদের এই কাজ নির্ভরশীল ৷ আমসত্ত্ব তৈরি করতে দিনভর কড়া রোদের প্রয়োজন ৷ এবার যশের ধাক্কায় আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে ৷ এখন আমের দাম চলছে ১২০০ টাকা মণ ৷ এক মণ আম থেকে আড়াই কিলো আমসত্ত্ব পাওয়া যায় ৷ তাই অন্তত দেড় থেকে দু’হাজার টাকা কিলো দরে বিক্রি করতে না পারলে আমাদের ক্ষতি ৷ সরকারিভাবে আমাদের আমসত্ত্ব তৈরি করার জন্য যন্ত্র দেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু যন্ত্রে তৈরি আমসত্ত্বের মান ভাল হয় না ৷ উৎপাদনও কম হয় ৷ তাই আমরা প্রাচীন পদ্ধতি অনুযায়ীই আমসত্ত্ব তৈরি করি ৷”

মালদা ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস্‌ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উজ্জ্বল সাহার ধারণা মালদার আমসত্ত্ব বিদেশেও পাঠানো যেতে পারে ৷ এর জন্য আমসত্ত্ব নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে ৷ মালদায় কেন্দ্রীয় সরকারের আম গবেষণা সংস্থা রয়েছে ৷ কিন্তু তারা আমসত্ত্ব নিয়ে কিছু ভাবেনি ৷ এ-নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস্‌ অ্যাসোসিয়েশন ৷
এনিয়ে কী ভাবছে প্রশাসন ? জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু নন্দন বলেন, এখানকার তৈরি আমসত্ত্বের গুণগত মান যেরকম তা বিদেশ পাঠানোর উপযুক্ত নয় ৷ যে পদ্ধতিতে এখানে আমসত্ত্ব তৈরি হয় তা স্বাস্থ্যকর নয় ৷ তবে জেলার আমসত্ত্ব বাজারজাত করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করছি ৷ পুরোনো রীতিতে তৈরি আমসত্ত্ব রফতানির ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে ৷ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধুলোবালি ও জীবাণুমুক্ত আমসত্ত্ব তৈরি করলে তবেই তা বিদেশে পাঠানো যেতে পারে ৷ আসলে বাইরের মানুষ আমসত্ত্ব চেনে না বলেই এতদিন এর বাজার তৈরি হয়নি ৷ আমসত্ত্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে ৷

Previous articleকরোনা মোকাবিলায় ৭৭.৮ শতাংশ কার্যকরী কোভ্যাক্সিন! বলছে সমীক্ষা
Next articleকরোনা সংক্রমণ: সারাদেশের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন