বাংলায় রাজনীতির পালাবদল ও কংগ্রেসের পতন: অজন্তা বিশ্বাসের গবেষণায় ইতিহাসের দলিল

অবিভক্ত বাংলা এবং স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের পরিস্থিতি কী? কীভাবে ১৯৩৭ থেকে ধীরে ধীরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৬৭-তে বাংলা থেকে তাদের সরে যেতে হল- সে বিষয়ে নিয়েই ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যাডভান্স রিসার্চে (Iternational journal of advanced research) নিজের গবেষণার বিষয় প্রবন্ধ লিখলেন ডক্টর অজন্তা বিশ্বাস (Ajanta Biswas)। রবীন্দ্র ভারতীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস (History) বিভাগের সহকারি প্রফেসর তিনি।

অজন্তা তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে ১৯৩৭ থেকে ধীরে ধীরে বাংলায় অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে গিয়েছে কংগ্রেস (Congress)। যে বিষয়গুলির উপর তিনি আলোকপাত করেছেন- তার প্রধান ছিল কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্র এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এই কারণগুলিই কংগ্রেসকে বাংলায় মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি।

দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা থেকে হাজারে হাজারে লোক আসছেন এপার বাংলায়। কিন্তু সেই সময় কংগ্রেস শাসকরা সাধারণ মানুষের চাহিদা, তাঁদের সমস্যা বুঝতে পারেনি। বদলে তারা ক্রমশ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ হয়ে গিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে রেষারেষি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ১৯৪৭-এর পর মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (Prafulla Ghosh)। কিন্তু ৬ মাসের বেশি থাকতে পারেননি। হুগলি লবি সমর্থন করে বিধানচন্দ্র রায়কে (Bidhanchandra Ray)। ফলে তিনি হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই পদে ছিলেন। তারপরে সেই হুগলি লবি-র পৃষ্ঠপোষকতাতেই মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র সেন (Prafullachandra Sen)।

কিন্তু এই সময় কংগ্রেসের মধ্যে সবচেয়ে যে সমস্যা দেখা দেয়, তা হল দলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রভাব। আর সেখানে জমিদার, জোতদার, সুদখোর ব্যবসায়ীদের ছিল রমরমা। ফলে সাধারণ মানুষের সমস্যা সামনে আসছিল না। দেশভাগের পরে এই বাংলায় আশা মুসলিমদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।

এই পরিস্থিতিতে মাথাচাড়া দেয় খাদ্য আন্দোলন। এই আন্দোলনে থেকেই কংগ্রেসের কফিন তৈরির কাজ শুরু হয় বাংলায়। অজন্তা তাঁর গবেষণাপত্রে লিখছেন, খাদ্য আন্দোলনের ফলে বাংলায় ধীরে ধীরে কংগ্রেসের জমি আলগা হয়ে যায়।

অজয় মুখোপাধ্যায়ের (Ajay Mukherjee) নেতৃত্বে তখন গঠিত হয় ‘বাংলা কংগ্রেস’। আর সেই বাংলা কংগ্রেসের মাধ্যমে হাজার 1967-তে যুক্তফ্রন্ট বাংলার ক্ষমতা দখল করে। চিরতরে মুছে যেতে হয় কংগ্রেসকে।

২০১১ তৃণমূলের সঙ্গে জোট করেছিল কংগ্রেস। ২০১৬ এবং ২০২১ বামেদের সঙ্গে জোট করে তারা। কিন্তু ২০২১-এ সারা পশ্চিমবঙ্গে একটি আসনও পায়নি তারা। জাতীয় রাজনীতিতেও ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিতে অজন্তা বিশ্বাসের এই গবেষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে আজকে নয়, ১৯৩০ থেকে ধীরে ধীরে বাংলায় আলগা হয়ে গিয়েছিল কংগ্রেসের পায়ের তলার মাটি। হয়তো বাংলার বীরপুত্র সুভাষচন্দ্র বসুর (Subhash chandra Basu) কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সেই কাজে আরও বেশি ইন্ধন দিয়েছিল। অজন্তা তাঁর গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধে বলেছেন, ভারতে চিরকালই গণতন্ত্রের একটা ভুয়ো মোড়ক ছিল- যেটা আজও বর্তমান। যার ফলে শ্রেণী-বৈষম্য থেকে লিঙ্গ-বৈষম্য, ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ-এই সবই রয়েছে স্বাধীনতার আগে থেকে। শুধু বিভিন্ন সময়ে তার ওপর একটা মোড়ক চড়েছে মাত্র।

আরও পড়ুন- টিকাকরণের গতি বহাল রাখতে এনজিও-র সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ মোদির