Monday, November 10, 2025

সময় বদলেছে, সেই সঙ্গে বদলেছে মানুষের চাহিদা ও রুচি। শীতের সার্কাসের আড়াই ঘণ্টার শোয়ের আকর্ষণও যেন হারিয়েছে অনেকটা। লিখেছেন রাতুল দত্ত
কয়েক বছর ধরেই শীতের শহর থেকে কিছু একটা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! ঠিক। শীতের সার্কাস। উত্তরের সিঁথি থেকে মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাসের ময়দান, শহরতলির সোদপুর থেকে সোনারপুর কিংবা খড়্গপুর, আসানসোল ময়দান। আগে শীতকাল মানেই নভেম্বরের শেষ থেকে মাইকে প্রচার আর বিজ্ঞাপন— ময়দানে এবার পড়বে তাঁবু। রাস্তার ধারে শোভা পাবে সার্কাসের আঁকা হোর্ডিং। এদিকে অলিম্পিক তো ওদিকে রোমান, এদিকে গ্রেট ইন্ডিয়ান তো ওদিকে নটরাজ সার্কাস। কোথায় গেল সে-সব দিন! নিয়মের বেড়াজালে আটকে গিয়ে আর বাঘের খাঁচায় লাফিয়ে পড়ার ঘটনার পর, জীবজন্তুর খেলা দ্রুত নিষিদ্ধ হতেই কি জৌলুস হারিয়েছে সার্কাস দলগুলি? জাগলিং, ব্যালান্সের খেলার পাশাপাশি মনোরঞ্জনের যে শেষ ভরসা ছিল ওঁদের রঙ্গরস, তার দেখা কি আর মিলবে!


বাঘ-সিংহ-হাতির খেলা দেখার পাঠ তো বহুদিনই চুকেছে। জোকার, জিমন্যাস্টিকের খেলার আনন্দ চেটেপুটে নেওয়ার যেটুকু সুযোগ ছিল, করোনা কেড়েছে সেটাও। প্রতি শীতে শহরের বিভিন্ন সার্কাসের তাঁবুতে দেখা মিলত নতুন নতুন জোকার। জীব-জন্তুর পাশাপাশি তাঁদের খেলা দেখে হেসে লুটোপুটি খেত আট থেকে আশি। কবে ফিরবে সার্কাস, আদৌ ফিরবে কিনা জানা নেই। অন্তত এই সেশনে তো সব আশা শেষ। অথচ বড়দিন থেকে পয়লা জানুয়ারি— সার্কাস দেখার মজাই ছিল আলাদা। শুধু তাই নয় দুঃখের কথা যে, উল্টে ‘সার্কাস’কথাটা এখন বাংলা ভাষায় একটা শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গের রূপ পেয়েছে।
কেন দেখত সার্কাস?

আগে সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ ছিল বাঘ-সিংহের খেলা। জ্বলন্ত রিংয়ের ভিতর দিয়ে বাঘ লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। সিংহ সামনে রাখা টুলের ওপর পা তুলে দর্শকদের অভিবাদন জানাচ্ছে। হাতি ফুটবলে শট মারছে। ভল্লুক বল নিয়ে নানারকম কেরামতি দেখাচ্ছে। আর হাততালিতে ফেটে পড়ছে সার্কাসের তাঁবু। কিন্তু, এখন নিয়মের গেরোয় সার্কাসে বাঘ, সিংহ, হাতি, ভল্লুকের খেলা দেখানো নিষিদ্ধ। তাই, সার্কাসের চরিত্রও কিছুটা বদলেছে। এখন দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য বেশি করে জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যালান্সের খেলা, ট্রাপিজের খেলা, বাইকের কসরত, অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শন এবং হাস্যকৌতুকের উপর। ফেমাস সার্কাসের যেমন মূল আকর্ষণ উটের খেলা, প্রকাণ্ড জলহস্তীর বাঁধাকপি খাওয়া, রোমাঞ্চকর পাঁচফলা বর্ষার খেলা প্রভৃতি। চিড়িয়াখানায় দূর থেকে খাঁচার মধ্যে দেখা জন্তুগুলিকে কয়েক হাত তফাতে দেখার এমন সুযোগ সার্কাসেই পাওয়া যায়। কাকাতুয়াকে ডিগবাজি খেতে দেখলে বা তিন চাকার ছোট গাড়ি চালাতে দেখলে মজা তো লাগেই! এ ছাড়া জোকারের ভাঁড়ামি তো রয়েইছে।
হাতি নেই, বাঘ নেই, শুধু দুটো বুড়ো ঘোড়া আর ময়না, টিয়া নিয়ে সার্কাস জমে? ট্রাপিজের খেলা অবশ্য বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিত। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাইরে বাঘের ছবি, ভেতরে গর্জন নেই। আসলে মানুষ, পেটের দায়ে হত নকল বাঘ। যদি কিছু লোক আসে! তবে, কাগজে তালমিছরির বিজ্ঞাপনের ছবি দেখে মিছরির স্বাদ পান জিভে? শেষের দশকে তাই আর বয়স্করা সার্কাস দেখতেই আসতেন না। টিকিট বিক্রি হবে কী! অনেক সময় লোক টানতে একটু নাম পালটেও আসত সার্কাস। সেবার শীতে পার্ক সার্কাস ময়দানে ইন্ডিয়া সার্কাসের তাঁবু পড়েছে মাঠে, হইচই পাড়ায়। বয়স্ক একজন বললেন, এটা আসল নয়, নকল। কেন কেন? ভাল করে দেখা গেল, এটা ইন্ডিয়ান সার্কাস নয়, ইন্ডিয়া সার্কাস। নামেই ম্যাজিক করে রাখা!

বাঙালির সার্কাস

বাঙালির সার্কাস প্রসঙ্গে বারবার আসে প্রিয়নাথ বোসের নাম। প্রিয়নাথ বসু চব্বিশ পরগনার ছোটজাগুলিয়া গ্রামে জন্মান। পরে নিজের স্বতন্ত্র আখড়া স্থাপন করেন, যার প্রথমটি ছিল নিজের বাড়ির কাছে, কর্নওয়লিস স্ট্রিটে। সিমলে (বর্তমানের বিবেকানন্দ রোড) থেকে নেবুতলা (সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার) পর্যন্ত গোটা পঞ্চাশেক আখড়া সৃষ্টি হয়— এর প্রত্যেকটিতে প্রিয়নাথ ব্যায়াম শেখাতেন আর মনে মনে নিজের সার্কাস দল খোলার স্বপ্ন দেখতেন। এরপর তিনি মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম, বাঁকুড়া— নানা জেলায় জমিদার বাড়িতে খেলা দেখিয়ে কিছু রোজগার করলেন। রোজগারের পয়সা দিয়ে তাঁবু ইত্যাদি কিছু সরঞ্জাম কিনলেন, আরও দু-একজন খেলোয়াড় জোগাড় করলেন আর দলের নাম দিলেন Professor Bose’s Great Bengal Circus। সেটা ১৮৮৭ সালের কোনও একটি সময়। ১৮৯৬ সালে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস গোয়ালিয়রের মহারাজার জয়বিলাস প্যালেসে খেলা দেখায়। সেই বছরই নভেম্বর মাসে রেওয়ার মহারাজা সার্কাস দেখে খুশি হয়ে দুটি বাঘ উপহার দেন। তার আগে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে বাঘ ছিল না। যেহেতু প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের পরিকল্পনা, পরিচালনা সবের মূলেই একজন বাঙালি, খেলোয়াড়রাও সব ভারতীয়। সেই কারণে এই সার্কাস আর শুধুমাত্র সার্কাস বলেই গণ্য থাকেনি, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালির গর্বের বস্তু হয়ে ওঠে। দেশীয় সংবাদপত্রও গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের প্রশংসা করে।


এখানেই খেলা দেখাতেন একজন মহিলা, নাম সুশীলাসুন্দরী। একজোড়া বাঘ নিয়ে খেলা দেখাতেন, খালি হাতে খাঁচায় ঢুকতেন, হাতে একটা সামান্য লাঠি পর্যন্ত থাকত না। খেলা দেখাতে দেখাতে বাঘের গালে চুমু খেতেন। বাঘের খেলা ছাড়াও ট্র্যাপিজ আর জিমন্যাস্টিকসের খেলা দেখাতেন। গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের একজন নামকরা জিমন্যাস্ট ছিলেন পান্নালাল বর্ধন। প্রিয়নাথ বসুর শিষ্য এই জিমন্যাস্টের স্পেশ্যালিটি ছিল হরাইজেন্টাল বারের খেলা। প্রিয়নাথ বসুর নিজের কথায়, ব্যাক ফ্লাইং এবং ডবল সমারসল্টে এনার মতো দক্ষ খেলোয়াড় তখনকার দিনে ইংরেজদের মধ্যেও বিরল ছিল। ছিলেন জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী। ইনি সার্কাসে যোগ দেন বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকার জন্যে।
সার্কাস চালানো মানেই হাতির খরচ
সময় বদলেছে। বদলেছে মানুষের চাহিদা ও রুচি। বর্তমানে সার্কাসের আড়াই ঘণ্টার শোয়ের আকর্ষণ যেন অনেকটাই হারিয়েছে। একটা সার্কাস দলে কমবেশি জনা ষাটেক লোক থাকেন। তার উপর জন্তুজানোয়ার, পাখির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বিপুল। শো আয়োজনের খরচও রয়েছে। সব মিলিয়ে গড়ে দিন-প্রতি কমবেশি হাজার ৪০-এর মতো খরচ লাগেই। শুধু টিকিট বিক্রি থেকে এই বিপুল খরচ মেটানো বেশ সমস্যার। জন্তুজানোয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের পর শারীরিক কসরতের খেলার উপর জোর দিতে হচ্ছে। কিন্তু, কম টাকা এবং ঝুঁকির কারণে এই পেশার প্রতি এখন অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে, প্রতিভার খোঁজে এবং শোয়ের আকর্ষণ বাড়াতে এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশ থেকে কলাকুশলী আনতে হচ্ছে। রাশিয়া, কেনিয়া থেকে শিল্পী আনাও বন্ধ। সামান্য কিছু যা পাখি, প্রাণী আছে তা-ও বিদেশ থেকে আনা আর বছরভর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, তাদের খাওয়া, পরিচর্যা। কম খরচ!
ফিরবে কি সেদিন? ফিরবে না। ফিরবে না কোনওদিন।

আরও পড়ুন:মা সারদা আসলে কেমন ছিলেন?

Related articles

যন্তরমন্তরে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার অভিযোগ! তদন্তে দিল্লি পুলিশ

সোমবার যন্তরমন্তরে (Jantan Montar) ভয়াবহ কাণ্ড! সকাল ৯টা নাগাদ প্রকাশ্যে গুলি করে আত্মঘাতী (Suicide) হলেন এক ব্যক্তি। যন্তরমন্তর...

সিনেমা দেখে খুনের ছক! স্ত্রীকে পুড়িয়ে নদীতে ছাই ফেলে থানায় অভিযোগ স্বামীর

সিনেমা দেখেই পরিকল্পনা! ‘দৃশ্যম’ দেখে অপরাধের ছক কষেছিলেন পুনের (Pune) বাসিন্দা সমীর যাদব। ৩৮ বছরের স্ত্রী অঞ্জলি যাদব...

১ ডিসেম্বর থেকে নয়া হারে আবগারি শুল্ক কার্যকর! রাজ্যে কত হচ্ছে সুরার দাম

শীতের শুরুতে মৌতাতের পরিকল্পনা করলে, সেই আনন্দে কিছুটা ধাক্কা। কারণ পশ্চিমবঙ্গে (West Bengal) বাড়ছে সব ধরনের মদের  দাম...

অচলায়তন ভেঙে মুক্ত চিন্তাভাবনার অঙ্গন হবে বাংলা: রাখি-রিয়াকে শুভেচ্ছা তরুণদের আইকন অভিষেকের

তিনি যুব সমাজের আইকন। তৃণমূলের (TMC) সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Abhishek Banerjee) ঘিরে সব সময়ই তরুণ প্রজন্মের জনজোয়ার। আর...
Exit mobile version