দেশকে পথ দেখাচ্ছে কলকাতা

দূষণমুক্ত পরিবহণের ভবিষ্যৎ ইলেকট্রিক বাস

পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে ইলেকট্রিক চালিত যানবাহনের কোনও বিকল্প নেই। ই-পরিবহণ ব্যবস্থা চালু হলে অনেকটাই রেহাই পাবে সাধারণ মানুষ। লিখলেন রাতুল দত্ত

এই কিছুদিন আগের একটি ছোট খবর। উষ্ণায়নের হাত থেকে বাঁচতে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎচালিত যানে মুক্তির উপায় খুঁজছে বিশ্ব। আর সেই প্রেক্ষিতেই কলকাতায় মাথায় উঠল আরেক সম্মান। বিশ্বের তৃতীয় স্থানে কলকাতা। ইলেকট্রিক বাস পথে নামানোয় বাংলায় সৃষ্টি হল নজির। লন্ডনের মতো তাবড় প্রথম বিশ্বের শহরকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন আলোচনার বিষয় কলকাতার যাত্রী পরিবহণের বিকল্প মাধ্যম। EV City Casebook-এর মাধ্যমে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য শহরগুলিতে কীভাবে ইলেকট্রিক যাত্রী পরিবহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার সমীক্ষা করা হয়। Casebook 2021-এ তিলোত্তমার পাশাপাশি তালিকায় নাম ছিল ব্রিটেনের লন্ডন, কানাডার ভ্যানকুভার, চিনে শেনজেন, চিলির স্যান্টিয়াগোর মতো বিখ্যাত শহরের। সমীক্ষা অনুযায়ী ইলেকট্রিক বাসের ক্ষেত্রে বিশ্বে এক নম্বর স্থানে চিনের শেনজেন শহর, কলকাতা তৃতীয়।

আরও পড়ুন:BJP: টালমাটাল বঙ্গ বিজেপি, শান্তনুর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়া নিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা দিলীপের!
খরচ কম, পরিবেশবান্ধব
পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং দূষণ মোকাবিলায় ইলেকট্রিক বাসের ভাবনা । দূষণহীন, কারণ বাসগুলো ব্যাটারিচালিত, শুধু চার্জ দিলেই হবে। পেট্রোল ডিজেল পুড়বে না বলে বাতাসে মিশবে না কার্বন কণা। এ ধরনের বাসে থাকে রিচার্জেবল ব্যাটারি। আর সেই ব্যাটারির বিদ্যুতেই বাস চলে। প্রথম দফায় ২৫টি বাস পরীক্ষামূলকভাবে চলবে কলকাতায়। এ ধরনের বাস সাধারণ বাস থেকে আলাদা হয়। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছে, কলকাতার ট্রাম ডিপো থেকে এই বাসের রুট তৈরি করা হবে। কারণ, বিদ্যুৎচালিত যান চালানোর অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ নিগমের রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই কলকাতায় চলছে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম। তাই ট্রাম ডিপোগুলোতে বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত কিছু পরিকাঠামো তৈরিই রয়েছে। এখানেই নয়াবাসের ব্যাটারিগুলো চার্জ দেওয়া যেতে পারে। খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম এবং পরিবেশবান্ধব। শব্দও কম হয় এবং খনিজ তেলও লাগে না। সবদিক বিবেচনায় এনেই এই বাস চালানোর পরিকল্পনা।

দীর্ঘদিন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সাধারণ বাসে চড়ার পর বিদ্যুৎচালিত বাসের অভিজ্ঞতা যাত্রীদের একটু অন্য রকম। তাঁদের মতে, বিদ্যুৎচালিত বাস শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সাধারণ বাসের চেয়েও আরামদায়ক। আগামী দিনে ইলেকট্রিক বাসের সংখ্যা আরও বাড়ানো হতে পারে বলে পরিবহণ মহল সূত্রের খবর। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে শহরের রাস্তায় অন্তত ৫,০০০ বাস নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর। অর্থাৎ কলকাতায় পরিবহণকে যতটা সম্ভব দূষণমুক্ত করার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী তিনি। ইতিমধ্যেই চার্জিং স্টেশনের সংখ্যা বাড়ানো থেকে শুরু করে আধুনিক মানের বাস স্ট্যান্ড তৈরি— একগুচ্ছ পদক্ষেপ করা হয়েছে। ফলে এই ধরনের বাস বাড়ালে পরিকাঠামোগত দিক থেকে কোনও সমস্যা হবে না। ৪০টি ইলেকট্রিক বাস কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ। কিছু পথে নেমেছে, কিছু নামার অপেক্ষায়। এই ৪০টি বাসের মধ্যে ২০টি বাসের দৈর্ঘ্য ৯ মিটার এবং আসনসংখ্যা আনুমানিক ৩০। বাকিগুলি হবে ১২ মিটার লম্বা, আসন সংখ্যা হবে ৪০। এই দুই ধরনের বাসেই মানুষের দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকবে। শহরের বাস ডিপোগুলিতে ৩০টি ব্যাটারি চার্জার বসানো হবে। আরও ১০টি ফাস্ট ব্যাটারি চার্জার বসানো হবে কয়েকটি বাস টার্মিনালে।

একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
একদিকে শহরের পরিকাঠামো উন্নয়ন, অন্যদিকে বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণে বছরখানেক আগে কলকাতায় চালু হয়েছিল ইলেকট্রিক বাস যা শুরুতেই জনপ্রিয় হয়। কলকাতার সেই ই-বাস পরিষেবা আন্তর্জাতিক দরবারে স্বীকৃতিও জিতে নেয়। আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ এজেন্সির ২০২০-এর গ্লোবাল ইলেকট্রিক ভেহিকল আউটলুক (জেভো) রিপোর্ট প্রকাশিত হয় প্যারিসে। দেশের একমাত্র শহর হিসাবে কলকাতার ই-বাস পরিষেবা প্রশংসিত হয়েছে ওই রিপোর্টে। চিনের শেনঝেন, ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি ও চিলির সান্তিয়াগোর সঙ্গেই চতুর্থ শহর হিসাবে উঠে এসেছে কলকাতা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক শহরের কাছেই আদর্শ হয়ে উঠেছে কলকাতা। পাশাপাশি রাজ্য বিদ্যুৎ দপ্তরও ইতিমধ্যেই ইলেকট্রিক গাড়ি (ই-কার) পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করেছে। অন্যদিকে, কলকাতাই দেশের একমাত্র শহর, যেখানে ইলেকট্রিক বাস পরিষেবা নজির স্থাপন করেছে বলে আইইএ-এর এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। কলকাতা ছাড়া কেবল মাত্র গুজরাতের আমেদাবাদের নাম এসেছে এই সমীক্ষায়। যদিও সেটা ইলেকট্রিক বাস নয়, ইলেকট্রিক ট্যাক্সির সেগমেন্টে।

নিউ টাউনে ইলেকট্রিক বাস
নতুন বছরেই রাজারহাটকে কেন্দ্র করে ছ’টি রুটে সরকারি ভর্তুকি নিয়ে ছুটবে ইলেকট্রিক বাস। রুটগুলি হল : ১. সাপুরজি-হাওড়া। ২. সাপুরজি-ইডেন সিটি। ৩. নিউ টাউন-পার্ক সার্কাস। ৪. ইকো স্পেস-সাঁতরাগাছি। ৫. সাপুরজি-এয়ারপোর্ট এবং ৬. ইকো স্পেস-বাঙুর। এর জন্য দেওয়া হচ্ছে ভরতুকিও। কেন্দ্রীয় সরকার ইলেকট্রিক বাস কেনার জন্য ৪০ শতাংশ অর্থিক সাহায্য দেবে। শর্ত হল, রাজ্য সরকারের নির্ধারণ করা ভাড়ায় নির্দিষ্ট রুটে কমপক্ষে ১০ বছর সেই বাস চালাতে হবে। কিন্তু সেই ভাড়ায় বাস চালাতে গিয়ে বেসরকারি সংস্থা যাতে লোকসানের শিকার না-হয় তার নিশ্চয়তা দেবে রাজ্য। বাসের চালক ও পরিকাঠামো বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকলেও কন্ডাক্টর দেবে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ নিগম কন্ডাক্টর নিয়োগ করবে। বাসের টিকিট বিক্রির টাকা কন্ডাক্টর বেসরকারি সংস্থার বদলে সরাসরি নিগমকে জমা দেবে। গড়ে প্রত্যেক মাসে প্রতিটি বাস ন্যূন্যতম পাঁচ হাজার কিলোমিটার চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পাঞ্চল আসানসোল-দুর্গাপুরের জন্য ২৫টি ও শিলিগুড়ির জন্য আরও ২৫টি ইলেকট্রিক বাস বরাদ্দ হয়েছে এই প্রকল্পে।

উত্তরবঙ্গেও নামছে ইলেকট্রিক বাস
কলকাতার পর এবার উত্তরবঙ্গের পথে নামবে ইলেকট্রিক বাস। পথে নামবে সিএনজি ইলেকট্রিক বাস। এর ফলে রাজ্য সরকারের অর্থ সাশ্রয় ও দূষণ দুটোই কমবে। প্রথমে পর্যয়ে থাকছে ৫০টি বাস। এরপর ধীরে ধীরে বাড়বে সংখ্যা। নতুন করে নিয়োগ হবে চালক ও কনডাক্টর। মালদহের নালাগোলা রুটে এই বাস আরও বেশি চালানো হবে। প্রয়োজনে নতুন রুট তৈরি করে সেসব স্থানে চালানো হবে বাস। এমনকী মালদহের পর্যটনকেন্দ্র ও পিকনিক স্পটগুলিতে আগামীদিনে দোতলা বাস চালানোর পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য একটা করে প্যানিক বাটন থাকবে। সিসিটিভি ক্যামেরাও থাকবে বাসগুলিতে। বাসগুলিতে জিপিএসও বসানো হবে।
আসছে ই-অটো, ই-ভেসেল
অগ্নিমূল্য পেট্রল-ডিজেলের দাম। অর্ধেক বাস-মালিকদের পক্ষে বাস চালানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষকেও স্বাভাবিকের থেকে বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতেই এই বছরের মধ্যে রাজ্য জুড়ে ইলেকট্রিক বাস, ই-অটো এবং ই-ভেসেল নামানোর পরিকল্পনা করেছে পরিবহণ দপ্তর। গঙ্গাবক্ষে দূষণ কমাতে ডিজেলচালিত না করে ইলেকট্রিক চালিত ভেসেল নামানোর পরিকল্পনা চলবে। চালু হবে ই-অটোও।
পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে ইলেকট্রিকচালিত যানবাহনের কোনও বিকল্প নেই। ই-পরিবহণ ব্যবস্থা চালু হলে অনেকটাই রেহাই পাবে সাধারণ মানুষ।

Previous articleBJP: টালমাটাল বঙ্গ বিজেপি, শান্তনুর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়া নিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা দিলীপের!
Next articleCovid19: করোনায় আক্রান্ত লক্ষ্মীরতন শুক্লা, অভিষেক ডালমিয়া