জাগিয়ে রাখেন জীবনানন্দ, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ কোথাও রয়েছে যেন
অবিনশ্বর আলোড়ন ;
কোনো এক অন‍্য পথে —
কোন্ পথে নেই পরিচয় ;
এ মাটির কোলে ছাড়া
অন‍্য স্থানে নয় ;
সেখানে মৃত্যুর আগে
হয় না মরণ।… ‘
(কবিতা ও কাব‍্যগ্রন্থ : আলোপৃথিবী )

আজীবন কান্তিময় আলোর সন্ধানী কবি জীবনানন্দকে তাঁর জীবদ্দশায় যেভাবে তিক্ত সমালোচনার ক্রুশে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছিল তা পাঠকসমাজকে আজও বিস্মিত করে। তাঁর কবিতা ও কাব‍্যপ্রতিভার প্রতি বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত নিক্ষিপ্ত হয়েছে চোখাচোখা বাক‍্যবান তথা বিশেষণ। দুর্বোধ‍্য, অশ্লীল, বিভ্রান্তিকর, জীবনবিমুখ, নির্জনতার কবি, হতাশা ও নৈরাশ্যের কবি, আত্মঘাতী ক্লান্তি, অন্ধকারের উপাসক ইত্যাদি প্রভৃতি কাঁটা দিয়ে সাজানো হয়েছিল তাঁর মুকুট। কবিতায় উপমার ব‍্যবহার ঠিক কোন্ উচ্চতায় পৌঁছতে পারে তা আবহমান বাংলাকে শিখিয়ে গেছেন এই নীলকন্ঠ কবি, যা বাংলা কাব‍‍্যে অমর হয়ে আছে। কিন্তু, এই সমালোচনা কি তাঁর প্রাপ‍্য ছিল? তাঁর সারাজীবনের কাব‍্যচর্চার মূল অন্বেষা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ তথা গবেষণা আজও সমাপ্ত হয়েছে কি?
ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি,
বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, শ্রেষ্ঠ কবিতা, রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা, অন‍্যান‍্য কবিতা, আলোপৃথিবী ইত্যাদি কাব‍্যগ্রন্থগুলি ছাড়াও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাগুলি সম‍্যক অনুধাবন করার প্রয়াস করলে বেরিয়ে আসে যে সারসত‍্য, তার মূল অভিমুখ কিন্তু ওই কান্তিময় আলো, ওই অবিনশ্বর আলোড়ন, ওই অনির্বান আশাবাদ, ওই সত‍্য ও সুন্দরের জীবনব‍্যাপী সন্ধান।
কোথায় মিলতে পারে সেই অবিনশ্বর আলোড়ন তার কিছু সঙ্কেত রেখে গেছেন কবি। ‘ হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা ফেনিল বুদ্ধির দৌড়…’, ‘ হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা বুদ্ধির বিচ্ছিন্ন শক্তি…’। এবার লক্ষ্য করা যাক সারাজীবন আলোর জয়গান গাওয়া কবির জীবনব‍্যাপী কাব‍্যপরিক্রমার অম্লমধুর আরোহন ও অবরোহনগুলির কিছু কিছু শব্দবন্ধ।

‘ প্রদীপ নিভায়ে মানবদেহের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন,
আসন করিব ক্ষয়!
— জয় মানবের জয়! ‘
( কবিতা: নব নবীনের লাগি,
কাব‍্যগ্রন্থ: ঝরা পালক )

‘ আমি চলে যাব — তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে
সেইদিন পৃথিবীর ‘পরে ;
আমার সকল গান তবুও
তোমারে লক্ষ্য ক’রে! ‘
( কবিতা : নির্জন স্বাক্ষর,
কাব‍্যগ্রন্থ : ধূসর পাণ্ডুলিপি )

‘ পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা-হতাশা —
বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!—
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন! ‘
( কবিতা : জীবন,
কাব‍্যগ্রন্থ : ধূসর পাণ্ডুলিপি )

‘ আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর
করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর
বিছানার কিনারে। ‘
(কবিতা : কমলালেবু,
কাব‍্যগ্রন্থ : বনলতা সেন )

‘ তবুও তো পেঁচা জাগে ;
গলিত স্থবির ব‍্যাঙ আরো
দুই মুহুর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।’
( কবিতা : আট বছর আগের একদিন, কাব‍্যগ্রন্থ : মহাপৃথিবী )

‘ মরণের হাত ধ’রে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে? ‘
( কবিতা : স্থবির যৌবন,
কাব‍্যগ্রন্থ : মহাপৃথিবী )

‘ এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট‍‍্যাঁক, ধর্ম মরেছে ;
তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে
অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।’
( কবিতা : মনোকণিকা,
কাব‍্যগ্রন্থ : মহাপৃথিবী )

‘ আমরা কি তিমিরবিলাসী?
আমরা তো তিমিরবিনাশী হ’তে চাই।
আমরা তো তিমিরবিনাশী। ‘
( কবিতা : তিমিরহননের গান,
কাব‍্যগ্রন্থ : সাতটি তারার তিমির )

‘ কী ক’রে ধর্মের কল নড়ে যায় মিহিন বাতাসে ;
মানুষটা ম’রে গেলে যদি তাকে
ওষুধের শিশি
কেউ দেয়— বিনি দামে —
তবে কার লাভ —- ‘
( কবিতা : লঘু মুহূর্ত,
কাব‍্যগ্রন্থ : সাতটি তারার তিমির )

‘ তবুও নক্ষত্র নদী সূর্য নারী
সোনার ফসল মিথ্যা নয়।
মানুষের কাছ থেকে মানবের হৃদয়ের বিবর্ণতা ভয়
শেষ হবে ; তৃতীয় চতুর্থ — আরো সব
আন্তর্জাতিক গ’ড়ে ভেঙে গ’ড়ে দীপ্তিমান কৃষিজাত
জাতক মানব। ‘
( কবিতা : সৌরকরোজ্জল,
কাব‍্যগ্রন্থ : সাতটি তারার তিমির )

‘ মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়, অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে আরো ভালো —
আরো স্থির দিক নির্ণয়ের মতো চেতনার পরিমাপে
নিয়ন্ত্রিত কাজ কতদূর অগ্রসর হয়ে গেল
জেনে নিতে আসে।’
( কবিতা : মানুষের মৃত্যু হলে,
কাব‍্যগ্রন্থ : শ্রেষ্ঠ কবিতা )

‘ সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! ‘
( কাব‍্যগ্রন্থ : রূপসী বাংলা )

‘ ভাসানের গান শুনে কতবার
ঘর আর খড় গেল ভেসে,
মাথুরের পালা বেঁধে কতবার
ফাঁকা হল খড় আর ঘর। ‘
( কাব‍্যগ্রন্থ : রূপসী বাংলা )

‘ আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে?
আমাদের মনীষীরা আমাদের
অর্ধসত‍্য বলে গেছে
অর্ধমিথ‍্যার? জীবন তবুও অবিস্মরণীয় সততাকে চায় ;… ‘
( কবিতা : ইতিহাসযান,
কাব‍্যগ্রন্থ : বেলা অবেলা কালবেলা )

‘ হে আকাশ, হে সময়গ্রন্থি সনাতন,
আমি জ্ঞান আলো গান মহিলাকে ভালবেসে আজ ;
সকালের নীলকন্ঠ পাখি জল
সূর্যের মতন। ‘
( কবিতা : একটি কবিতা,
কাব‍্যগ্রন্থ : বেলা অবেলা কালবেলা )

‘ সকল অজ্ঞান কবে জ্ঞান আলো হবে,
সফল লোভের চেয়ে সৎ
হবে না কি
সব মানুষের তরে সব মানুষের ভালবাসা। ‘
(কবিতা : অন্ধকার থেকে,
কাব‍্যগ্রন্থ : বেলা অবেলা কালবেলা )

‘ ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি-রাশি
দুঃখের খনি
ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত শত শত
জলঝর্ণার ধ্বনি। ‘
( কবিতা : হে হৃদয়,
কাব‍্যগ্রন্থ : বেলা অবেলা কালবেলা )

‘ জ্বলিতেছে যে মশাল
অন্ধকারে আমাদের হাতে!
সমুদ্র দাঁড়াতে পারে —
পারি নাকো আমরা দাঁড়াতে!
পৃথিবী ঘুমাতে পারে —
আমাদের চোখে ঘুম নাই!
নক্ষত্র নিভিতে পারে —
আমরা যেতেছি তবু জ্বলে!
আমরা বাতাস হ’য়ে চলিতেছি দিকে দিকে বয়ে!
সময়ের সাথে সাথে আমরা সময় হয়ে হয়ে
যতদিন জেগে আছি এমনি জাগিতে শুধু চাই!
আমরা চলিতে চাই আকাশ বাতাস পায়ে দ’লে! ‘
( কবিতা : আমরা,
কাব‍্যগ্রন্থ : অন‍্যান‍্য কবিতা )

এবার এ লেখার সমাপ্তিরেখায় পৌঁছনোর আগে একটু প’ড়ে নেওয়া যাক কবিতা লেখা নিয়ে জীবনানন্দ কবির ব‍্যাখ‍্যা।
‘ অন্তঃপ্রেরণা আমি স্বীকার করি। কবিতা লিখতে হলে ইমাজিনেশনের দরকার ; এর অনুশীলনের। আমার মনে হয় ইমাজিনেশন মানে কল্পনাপ্রতিভা বা ভাবপ্রতিভা।
যে কবির কল্পনাপ্রতিভা আছে সে ছাড়া আর কেউ কাব‍্যসৃষ্টি
করবার মতো অন্তঃপ্রেরণার দাবি করতে পারে কি? ‘
কবি আরও বলছেন, ‘ কিন্তু
ভাবনাপ্রতিভাজাত এই অন্তঃপ্রেরণাও সব নয়। তাকে সংস্কারমুক্ত শুদ্ধ তর্কের ইঙ্গিত শুনতে হবে ; এ জিনিস ইতিহাসচেতনায় সুগঠিত হওয়া চাই। ‘
পরিশেষে ‘ আত্মঘাতী ক্লান্তি ‘
নিয়ে কবির জবাবটি বড়োই অর্থবহ এবং সম্ভবত সর্বকালেই প্রাসঙ্গিক।
‘ আত্মঘাতী ক্লান্তি বা আজকের যুগের যে-কোনোরকম ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু
‘ আশাবাদী মনোভাব ‘ কবচের মতন যে-কোনো
জ্ঞান- বিজ্ঞানালয় থেকে কিনে আনলে চলবে না। সে মনোভাব আশাবাদী হতে পারে, কিন্তু তা আরোপিত ও আড়ষ্ট — স্বাভাবিক ও সার্বজনীন নয়। ‘

আরও পড়ুন- বাইরে বের হতে গেলে লাগবে সাদা রিবন, না থাকলেই গুলি! মারিউপোলবাসীকে নির্দেশ রাশিয়ার

 

 

 

Previous articleবাইরে বের হতে গেলে লাগবে সাদা রিবন, না থাকলেই গুলি! মারিউপোলবাসীকে নির্দেশ রাশিয়ার
Next articleভোট-পরবর্তী হিংসা মামলা: সিজিও-তে হাজিরা দিতে যাচ্ছেন না অনুব্রত