রবি ঠাকুরের সঞ্চারী, উৎপল সিনহার কলম

আরাধনা কখনও উচ্চকিত ও কোলাহলময় হয় না। আরাধনা বলতেই শান্ত, অবনত, ধীরস্থির ও নম্রস্নিগ্ধ ধ‍্যানমগ্নতার ছবি ফুটে ওঠে। মুখের কথায় এই সমর্পনের আকুতির ব‍্যাখ‍্যা করা খুব কঠিন কাজ নয়। আরাধনার সংজ্ঞা ও স্বরূপ বর্ণনা করা যেতেই পারে পাতার পর পাতা লিখে। কিন্তু, যদি বলা হয় শুধুমাত্র কয়েকটি স্বর ও সুরের ওঠাপড়া দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে আরাধনার তাৎপর্য, তাহলে তার মতো দুরুহ কাজ আর কিছুই হতে পারে না।

এই দুরুহ কাজটি অনায়াস দক্ষতায় বারবার করে গেছেন সুরকার রবি ঠাকুর। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে

‘ আমি হেথায় থাকি শুধু
গাইতে তোমার গান ‘ গানটির সঞ্চারী অংশটি।
‘ নিশায় নীরব দেবালয়ে
তোমার আরাধন,
তখন মোরে আদেশ কোরো
গাইতে হে রাজন। ‘
শুদ্ধ মধ‍্যম, প্রায় স্পর্শস্বরের মতো করে একটুখানি পঞ্চম এবং শুদ্ধ গান্ধারে এসে সঞ্চারীর প্রথম অংশের সামান্য বিশ্রাম, যাতে রাতের দেবালয়ের নীরবতা আশ্চর্যরূপে মূর্ত হয়ে ওঠে, আর, আরাধনার প্রকৃত রূপ যথার্থ বিনম্রতার সঙ্গে ফুটে ওঠে। এর পরে আরও নত হতে হবে। কারণ তখন ঈশ্বরের আদেশে গান গাইতে হবে।প্রকৃষ্টরূপে নত হওয়াই তো প্রণতি। যত হবে নত তত উন্নত। সর্বশক্তিমানের কাছে সম্পূর্ণ নতজানু হওয়া ছাড়া ভক্তের আর কোনো পথ নেই।

তাই সঞ্চারীর দ্বিতীয় অংশে মধ‍্যসপ্তকের সা নেমে এসে স্পর্শ করে মন্দ্রসপ্তকের কোমল ধৈবত, তারপরেই মন্দ্রশুদ্ধনিষাদ ও মধ‍্যসপ্তকের কোমল রেখাব ছুঁয়ে সা-তে ফিরে আসে। প্রার্থনা সম্পূর্ণ হয়। মাত্র এই কয়েকটি স্বরের ওঠাপড়া দিয়ে ভক্তের আকুল মিনতির এই অশ্রুসিক্ত ছবি আঁকা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারোর পক্ষেই সম্ভবত অসম্ভব। পরজ ও বসন্ত রাগে গাঁথা এই গানটি সুরারোপের পরীক্ষা নিরীক্ষার এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।

বাংলা গানে সঞ্চারী এনেছেন রবীন্দ্রনাথ। আগে ছিল তিন তুক। স্থায়ী, অন্তরা ও আভোগ বা দ্বিতীয় অন্তরা। মৌলিক গান তৈরী করতে গিয়ে কবি দেখলেন এই তিন তুক দিয়েও গানের ভাব যেন সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তখন তিনি সৃষ্টি করলেন সঞ্চারী অংশটি। এবার বাংলা গানে এলো চতুর্থ অংশ। গান হয়ে উঠলো চারতুকবিশিষ্ট।

‘ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু…’, গানটির সঞ্চারী নিয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে । রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনবদ্য সঞ্চারীগুলির মধ‍্যে এটি অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ। রাগ ললিত, বিভাস ও যোগিয়া-র সমন্বয়ে রচিত এই সুরকাঠামোটি একতাল-এ নিবদ্ধ। কী এমন মণিমুক্তো আছে এই গানের সঞ্চারীতে? দেখা যাক।
‘ তরঙ্গ মিলায়ে যায়
তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে
কুসুম ফুটে। ‘

উত্তাল তরঙ্গ যখন সাময়িক স্তিমিত হয়ে আসে তখন মনে হয় স্থির ও শান্ত জলধারায় তা মিলিয়ে গেল। কিন্তু, পরমুহূর্তেই আবার ঢেউ ওঠে এবং বিশাল উঁচুতে উঠে যায় তরঙ্গচূড়া। আবার নিমেষেই মিলিয়ে যায় সে। এই ওঠাপড়ার খেলা চলতেই থাকে অনন্তকাল।

আর,ফুলের কী হয়?
ফুল নিঃশব্দে ঝরে যায়। ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। শুকিয়ে যায়। ফুলের মৃত্যু হয়। কিন্তু, আবার ফুল ফোটে। আকাশের দিকে, সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে গাছে ফোটা ফুল। এই জীবনচক্রেরও কোনো শেষ নেই। বিরামহীন। এই কথাগুলো কয়েকটি মাত্র স্বরের নাড়াচাড়া দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন রবি ঠাকুর। তরঙ্গের আর ফুলের ওঠাপড়ার ছবি এঁকে গেছেন সুরের মাধ‍্যমে। রাগ ললিতের স্পষ্ট ছায়া পাওয়া যায় তাঁর সৃষ্ট অসামান্য সুরসমন্বয়ে।

মধ‍্য সপ্তকের শুদ্ধ গান্ধারে এসে তরঙ্গ মিলিয়ে যাচ্ছে এবং মধ‍্যম ও গান্ধার স্পর্শ ক’রে কোমল নিষাদ-এ তরঙ্গ পৌঁছচ্ছে সর্বোচ্চ জলস্ফিতির ঊর্ধ্বক্রমে, যা এসে দাঁড়াচ্ছে কোমল ধৈবত ছুঁয়ে মধ‍্য সপ্তকের পঞ্চমে।
স্বরের রং ও সুরের তুলি দিয়ে শব্দ ও বাক‍্যবন্ধের এই ছবি আর কেউ আঁকতে পেরেছেন কি আমাদের এই সঙ্গীতবিশ্বে? জানা নেই।

এরপরেও বাকি রইলো ফুলের ঝরে পড়া ও আবার নতুন হয়ে ফুটে ওঠার আবহমান ছবি। শুদ্ধ মধ‍্যম ছুঁয়ে শুদ্ধ রে ও শুদ্ধ গা ব‍্যবহার ক’রে আবার শুদ্ধ মধ‍্যমে ফিরে সা-তে এসে ক্ষণিকের বিশ্রামের পরেই আমাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় ক’রে দিয়ে সুরকার রবীন্দ্রনাথ যথাক্রমে কোমল রে, শুদ্ধ গা, শুদ্ধ মধ‍্যম ও কড়ি মধ‍্যম পরপর স্পর্শ ক’রে যখন শুদ্ধ মধ‍্যমে এসে থামেন তখন আমাদের চেতনা যেন চৈতন‍্য হয়ে দেখা দেয় ক্ষণিকের জন‍্য। আশ্চর্য এক আলোকছটায় আপ্লুত হ’য়ে ওঠে আমাদের অন্তরমহল।

ফুল নানাভাবে ঝরে। কখনো সোজাসুজি মাটিতে এসে পড়ে। কখনও আবার হালকা হাওয়ায় কিছুটা ঘুরপাক খেয়ে একটু সময় নিয়ে দোল খেতে খেতে ফুলজীবনের ইতি টানে। কিন্তু, সঙ্গেসঙ্গেই আবার নতুন ফুলের জন্ম হয়। তরঙ্গের মতোই ফুলও মৃত্যুহীন, অনির্বান। আবহমান। স্বর ও সুরের রং ও তুলি দিয়ে কবি যে শুধুমাত্র সঞ্চারীর ছবিই এঁকে গেছেন তা- ই নয়, ‘ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু ‘ গানটির সর্বোত্তম অংশও সঞ্চারীর এই কথাগুলি। আবহমান অপরাজেয় জীবনের জয়গান , দুঃখ, ব‍্যথাযন্ত্রণা ও শোকসন্তাপ অতিক্রম ক’রে আবার নতুন ক’রে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন-আশ্বাস ধ্বনিত হতে থাকে এই গানের সঞ্চারীতে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রবি ঠাকুরের গানগুলির প্রধান শক্তিকেন্দ্র তাঁর সৃষ্ট সঞ্চারীগুলির অর্থবহ সঞ্চরণ।
সঞ্চারী যেন গানগুলিতে হৃৎপিণ্ডের কাজ করছে। ধ্রুপদী শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগে বাংলা গানে সঞ্চারী এনে এক অনন‍্য মাত্রা যোগ করেন রবীন্দ্রনাথ। সঞ্চারী ক্রমেই হ’য়ে ওঠে বাংলা গানের অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ। কী অসাধারণ মৌলিক প্রয়োগ রবীন্দ্রসৃষ্ট এই সঞ্চারী!

গানের ভাবপ্রকাশ ও বিস্তারের এক অনিবার্য মাধ‍্যম । গানের মূলভাবটিকে রসোত্তীর্ণ করার এক আশ্চর্য জাদুকাঠি। সঞ্চারীর আগমন ও সক্রিয়তায় রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বটেই, আধুনিক বাংলা গানও যেন সাবালকত্ব অর্জন করেছে।

‘ আমরা সবাই রাজা ‘ গানে যে উন্নত দেশ ও রাষ্ট্রব‍্যবস্থার ছবি এঁকে গেছেন কবি, তা সর্বদেশের ও সর্বকালের আদর্শ হওয়া উচিত। এই গানের সঞ্চারীতে আছে :
‘ রাজা সবারে দেন মান,
সে মান আপনি ফিরে পান…’
আসলে আলাদা ক’রে কোনো রাজার অস্তিত্ব নেই যে স্বপ্নের দেশে,গণতান্ত্রিক কাঠামোর সর্বোৎকৃষ্ট যে রূপের ধারণা রেখে গেছেন কবি এই গানে, সেখানেও সঞ্চারীর উপরিউক্ত কথাগুলোই যেন গানের মূল কথা হয়ে দেখা দিচ্ছে। আমরা সেই চিরআকাঙ্খিত ছবি যেন প্রত‍্যক্ষ করি গানের সঞ্চারী অংশে এসে যেখানে রাজা অর্থাৎ একজন সাধারণ মানুষ সম্মান প্রদর্শন করছেন অন্যদের ( আসলে এই অন‍্যরাও তো সকলেই ‘ রাজা ‘ অর্থাৎ সাধারণ মানুষজন, কারণ এই রাজত্বে তো সবাই রাজা ) এবং অন‍্যরাও সেই সম্মান সবিনয়ে হার্দ‍্যচিত্তে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, এমন অনন‍্যসাধারণ ছবি আমরা দেখতে পাই।

আর একটি গান :
‘ মধ‍্যদিনের বিজন বাতায়নে…’
স্মৃতিমেদুর এই গানের সঞ্চারীতে রয়েছে :
‘ যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে ডুবেছিল বিস্মরণের তলে… ‘,
মধ‍্য সপ্তকের শুদ্ধ ধা, কোমল নি, শুদ্ধ ধা, পা / মা পা মা গা / রেগা রেপা মা / গা গারেসা নি / ক্রমশ নিম্নগামী হতে থাকা এই স্বরসমন্বয় নিরাশার গভীর অশ্রুজলে ডুবে যাওয়ার স্পষ্ট ছবি আঁকে এবং আমরা সুরকার ও সঞ্চারীর ভগীরথ রবীন্দ্রনাথের হিমালয়সম উচ্চতার কাছে এসে স্তব্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই যখন দেখি বিস্মরণের তলে ডুবেছিল বোঝাতে তিনি ব‍্যবহার করেন নিম্নলিখিত স্বরসম্ভার :
মন্দ্র সপ্তকের নি নি পা নি নি সা ও মধ‍্য সপ্তকের সা মা মা গা রেগা রেপামামা গা গা রে সা। ভাবা যায় না।

আরও কয়েকটি গান, যেমন,
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়,
চোখের আলোয় দেখেছিলেম,
কাছে ছিলে দূরে গেলে, নয় নয় এ মধুর খেলা, আমি চঞ্চল হে, আজি বিজন ঘরে,
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে, মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে, আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে, আধেক ঘুমে নয়ন চুমে, আলোকের এই ঝর্ণাধারায়,
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে, জাগরণে যায় বিভাবরী, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো, আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ ইত্যাদি গানগুলিতে যেন হৃদস্পন্দনের মুখ‍্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সঞ্চারীগুলি।
গানগুলিকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। রবি ঠাকুরের সঞ্চারী নিয়ে হাজার হাজার পাতা লিখলেও সেটা কম মনে হবে। তবুও, ‘ প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ ‘ গানটির সঞ্চারী এই লেখার উপসংহারে উল্লেখ্য।
‘ আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।’
ক্রমাগত আঘাত ও বেদনার দহনের পরশমণির স্পর্শে চেতনার দ্বার খোলানো ও সকল বাধা বন্ধন ছিন্ন ক’রে সর্বোৎকৃষ্ট উপলব্ধি দানের মাধ‍্যমে ত্রাণের আকুল আর্তি আমাদেরও যেন সেই পরমার্থের সন্ধান দেয় যেখানে এই বিপুল বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে,এই অনন্ত চরাচরে নয়নভরা আলো আর হৃদয়ভরা প্রেম নিয়ে একাকী মানবের
বিস্ময়ভ্রমণ সফল ও সার্থক হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন- ধুলো মাটির গান, উৎপল সিনহার কলম

Previous articleবিরোধীদের লাগাতার আন্দোলনের ফল, জ্বালানির দাম কমাতে বাধ্য হল মোদি সরকার
Next articleBreakfast News: ব্রেকফাস্ট নিউজ