ফুল ফুটুক না ফুটুক, উৎপল সিনহার কলম

‘ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।’
সুভাষ মুখোপাধ‍্যায়ের লেখা এই হিরন্ময় শব্দগুচ্ছ বছরের পর বছর মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে, মিটিং- মিছিলে ও সভা-সমাবেশে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। কবিতা পাঠকদের কাছে তো এই শব্দগুচ্ছ বহমূল‍্য অলংকারের মতো সযত্নরক্ষিত। কিন্তু, প্রশ্ন সেখানে নয়। বিজ্ঞাপনে, হোর্ডিং-এ, ব‍্যানার, লিফলেট ও পোস্টারে, এমনকি টি-শার্টে পর্যন্ত উপরিউক্ত লাইনটি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে সেই কবে থেকে। যাঁরা কবিতাপ্রেমী নন তাঁরাও জানেন ফুলের মতো সুন্দর এই পঙক্তিটি। অথচ তাঁদের মধ‍্যে অনেকেই জানেন না মণিমুক্তোখচিত এই লাইনটির স্রষ্টা কে। জানেন না গোটা কবিতাটি। জানেন না এই লাইনটি দিয়েই মূল কবিতাটি শুরু বা শেষ হয়েছে কিনা। জানেন না পুরো কবিতাটিতে এই লাইনটির গুরুত্ব কতটুকু। শুধু জানেন, ‘ ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। ‘

আসলে, এইরকম ক্ষমতাসম্পন্ন বাক‍্যবন্ধগুলির দলছুট হওয়াই বোধহয় দস্তুর। গোটা কবিতাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককভাবে জেগে থাকে। যেন উত্তাল তরঙ্গমন্দ্রিত মহাসাগরের বিপুল অন্ধকারে মাথা তুলে জেগে থাকা লাইটহাউস। যেন হীরের খনির বাইরে পড়ে থাকা একটুকরো হীরে, কবিতার অমূল্য ও অনন‍্য হীরকখন্ড।

‘ প্রিয় ফুল খেলবার দিন
নয় অদ‍্য ‘, কিংবা,
‘ ফুলগুলো সরিয়ে নাও
আমার লাগছে।’
অথবা,
‘ আমাকে একটা ফুলের
নাম বলো —
আমি বলে দেবো
ওদের কপালে কী লেখা আছে। ‘
এইসব অবিস্মরণীয় পঙক্তিগুলি মূল কবিতাগুলি থেকে বেরিয়ে এসে যেন জানান দেয় নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, আবার একইসঙ্গে পাঠককে সচেতন করতে চায় এই ব’লে যে, বটগাছের পাতা দেখে কিন্তু বটগাছের অভিজ্ঞতা ও উচ্চতার পরিমাপ করা যায় না, অর্থাৎ, আমাকে তোমার যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে আমার সৃষ্টিরহস‍্যের সন্ধান করো ; গোটা কবিতাটি পড়ো।

ফুল নিয়ে এতো কবিতা লিখেছেন যে কবি, তিনিই আবার লিখেছেন :
‘ ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনোদিনই
আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি —
যা দিয়ে কোনোদিন
কারো মুখোশ হয় না।’

এও এক অসামান্য জীবনবীক্ষা। এক মহোত্তম উপলব্ধি।
পদাতিক কবির আরেকটি প্রসিদ্ধ হীরকখন্ড এখানে উল্লেখ্য :
‘ ঘোড়াগুলো বাঘের মতো খেলছে।’
‘ ঘোড়ার চাল ‘ কবিতার এই লাইনটি যখন কবিতা থেকে বেরিয়ে একা এসে দাঁড়াচ্ছে কবিতার স্নিগ্ধ আকাশতলে তখন মুখে মুখে ফেরা এই লাইনটির নিজের নিজের মতো ক’রে অর্থ তৈরী ক’রে নিচ্ছেন আগ্রহী শ্রোতারা ( এঁরা কেউ পাঠক নন ) এবং একইসঙ্গে সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়ার জন‍্য আগ্রহও জন্মাচ্ছে মানুষের মনে।

এবার আবার একটু ফিরে যাওয়া যাক ‘ ফুল ফুটুক না ফুটুক ‘ কবিতাটির কাছে। কি অসামান্য শব্দ ও ছন্দের আলো-আঁধার রয়েছে মায়াময় এই কবিতায় :
‘ আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে —
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে —
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।’

‘ গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো। ‘

এই কবিতা পড়লে রবি ঠাকুরের একটি জনপ্রিয় গানের প্রথম দুটি চরণ মনে পড়ে।
‘ বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে।
দেখিস নে কি শুকনো-পাতা
ঝরা-ফুলের খেলা রে।। ‘
বিষাদ-যন্ত্রণা-আশাবাদ ও স্মৃতিমেদুরতা অতিক্রম ক’রে কিন্তু একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে তালগাছের মতো একলা জেগে রইলো
‘ ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত ‘ এবং নানান বয়সের লক্ষ লক্ষ শ্রোতা সমগ্র কবিতাটি না প’ড়ে এই একটি মাত্র লাইন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলেন। কবি একরকম ভেবে এই লাইনটি লিখেছিলেন, কিন্তু নানাজনে নানা অর্থে এই বিশেষ লাইনটি প্রয়োগ ক’রে কবিতাছুট হিরন্ময় শব্দগুলিকে অমর ক’রে রাখলেন। যুগের পর যুগ বেঁচে রইলো কবিতার হীরকখন্ড অথবা হিরন্ময় শব্দগুচ্ছ।

‘ আমি যেন আমার কলমটা
ট্র‍্যাক্টরের পাশে নামিয়ে রেখে
বলতে পারি —
এই আমার ছুটি
ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও।। ‘
‘ আমার কাজ ‘ শিরোনামে রচিত এই কবিতার শুরুটাও হীরকখচিত :
‘ আমি চাই কথাগুলোকে
পায়ের ওপর দাঁড় করাতে।
আমি চাই যেন চোখ ফোটে
প্রত‍্যেকটি ছায়ার।
স্থির ছবিকে আমি চাই
হাঁটাতে। ‘

‘ রংরুট ‘ কবিতায় কবি শুরুতে ও শেষে দু’বার লিখেছেন অনবদ্য এই শব্দগুচ্ছ :
‘ হেরেছি? তাতে কী?
কখনও যায় না শীত
এক মাঘে।
আছে লড়াইতে
হারজিত। ‘

আর একটি আশ্চর্য পঙক্তি
উদ্ধৃত করতেই হয় :
‘ হায়, আজ পাকা- দেখা। ‘
কবিতার নাম ‘ ছেই ‘।
পাকা দেখা তো আনন্দ-সংবাদ। কিন্তু, কী আশ্চর্য! এখানে পাকা-দেখা শব্দবন্ধের আগে ‘ হায় ‘ শব্দটি এসে শব্দগুচ্ছকে হিরন্ময় ক’রে তুলেছে।
‘ গালে হাত দিয়ে ভাবছে
এক বোকা হাবা —
হায়, মেয়েটির আজ
পাকা-দেখা! ‘

এইভাবেই কখনো কখনো যেন মূল কবিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে জেগে থাকে হীরার মতো অত‍্যুজ্জ্বল দ‍্যুতি নিয়ে দলছুট কবিতাংশগুলি। হিন্দি ভাষায় এগুলিকে বলা হয় ‘ এক টুকড়া চাঁদ কা ‘।
হিমশৈলের চূড়ার মতো জেগে থাকা কবিতার দেহাংশ নিয়ে মাতামাতি চলতেই থাকে। এ এক অপ্রতিরোধ‍্য প্রবণতা।

কবিতারূপ ঝিনুক থেকে শব্দালংকারে ভূষিত বহমূল‍্য মুক্তো খুঁজে নেওয়া। এই খন্ড-প্রবণতা অন্তহীন। কবি চান বা না চান কবিতার আকাশে অগণন তারকার মাঝে হীরকদ‍্যুতিতে ইতিউতি জ্বলজ্বল করতে থাকে কবিতা থেকে আপাতবিচ্ছিন্ন তথাকথিত জনপ্রিয় হিরন্ময় চরণগুলি।

আরও পড়ুন- Asia Cup Hockey: এশিয়া কাপ হকিতে মধুর প্রতিশোধ ভারতের, জাপানকে ২-১ গোলে হারাল তারা

Previous articleশ্রুতিদিগন্তের তৃতীয় মিলন উৎসব
Next articleBreakfast News: ব্রেকফাস্ট নিউজ