ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক থ্রেবিয়া পুরস্কার জিতে নিলেন প্রথম ভারতীয় বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বাংলার বাউল পাপিয়া ঘোষাল

জন্ম হুগলিতে।বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। নিউ আলিপুরের বিখ্যাত স্কুলে পড়লেও গতানুগতিক পড়াশুনার বাইরের জগতটাই বরাবর তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল। সবসময় ছবি আঁকা, গান, খেলাধূলা, সেলাই সব কিছুতেই থাকতেন ফার্স্ট পজিশনে। তাঁর চরিত্রের সবথেকে লক্ষণীয় বিষয় হল সাহসীকতা এবং জেদ। যা তাঁকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে সবসময় সাহায্য করেছে। অসাধ্যকে সাধ্য করতে তিনি সবসময় চেষ্টা চালিয়েছেন। যার ফলসরূপ সম্প্রতি চেক রিপাব্লিকে পাপিয়া ঘোষালকে আন্তর্জাতিক থ্রেবিয়া অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। যা বাংলা তথা ভারতকে বিশ্বদরবারে গৌরবান্বিত করে তুলেছে।

আরও পড়ুন:পুরনো ছন্দে নজরুল মঞ্চ, অনুষ্ঠান করতে আসছেন একঝাঁক বলিউড তারকা

কলকাতার মেয়ে পাপিয়া এখন চেক রিপাব্লিকের বাসিন্দা। তবে মাটির টানে প্রতিবছরই বাংলায় আসেন। আর বাংলা মানেই শহর ছেড়ে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে তাঁর থাকা। তাঁদের সঙ্গে জীবনযাপন । কংক্রিটের জীবন সবসময়ই তাঁর নাপসন্দ। তাই বাউলের আখড়াতেই দিন কাটান তিনি। নিজেও পূর্ণদাস বাউলের কাছে তালিম নিয়েছেন।লালনের মতো উদাসী বাউল হয়েই দিন কাটান। বাউল পাপিয়া নিজের পয়সায় গ্রামবাংলার বহু বাউলকে বিদেশে গান গাওয়ারও সুযোগ করে দিয়েছেন বহুবার। বিশ্ববাংলার একান্ত সাক্ষাৎকারে পাপিয়া জানান, ‘অবলুপ্ত গানগুলিকে তুলে সেগুলিকে গবেষণা করে সেটা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করি। যাতে পাশ্চাত্যের দর্শকরা সেই গানের মধ্যে দিয়ে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে খুঁজে পায়।’ এমনকী এই অবলুপ্ত গান পাশ্চাত্যে পৌঁছে দিতে অনেকসময় গ্রামীণ প্রবীণ শিল্পীর সঙ্গেও নিজের মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন শিল্পী পাপিয়া। যা আজকের দিনে বিরল।  পাপিয়া বলেন, বিশ্বের কাছে আমাদের দেশের মূল্যবান শিল্পকে ছড়িয়ে দেওয়াই আমার কাজ। তা গান হোক বা পটশিল্প। আসলে পাপিয়ার স্বপ্ন পূর্বের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিলন। দু’দেশের ভালোমন্দ দুটোকেই তিনি তাঁর কবিতা-গান-আঁকার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন।তবে সবসময় প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে থেকেছেন তিনি।তাই ভার্সেটাইল শিল্পী হয়েও তাঁকে নিয়ে চর্চা কমই হয়েছে।

সালটা ১৯৯৯। লন্ডন থেকে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়ছেন পাপিয়া। পরিবারের থেকে অনেক দূরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পড়াশুনা করছেন। জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়ার সুবাদে পাপিয়া কখনও মাথা নত করতে শেখেননি। আত্মীয়ের বাড়িতে কোথাও আত্মনির্ভরতার প্রশ্ন ওঠে। সেইসময় আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে ‘হোমলেস’দের সঙ্গে কখনও রাস্তায় তো কখনও তাদের তাবুতে দিন কাটিয়ে ক্লাস চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু কখনও নিজের মাথা নত করেননি পাপিয়া। নিজের অসম্ভব সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে চিত্র প্রদর্শনীতে পুরুষদের নগ্নতাকে ছবির মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী পাপিয়া ঘোষাল। শিল্পীর এহেন ভাবনা নিয়ে রীতিমত শোরগোল পড়ে যায় গোটা দেশে। প্রতিটি ছবিই বিক্রি হয়ে যায়। তাঁর আঁকা ছবি বিশ্বের বহু নামীদামি গ্যালারিতে সংরক্ষিত রয়েছ্। এখন লন্ডনেই ছবি প্রদর্শনী করেন পাপিয়া। যা লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি হয়। বর্তমানে ২০০ বছরের পুরনো ব্রিটিশ হেরিটেজ আর্ট ও লিটারারি ম্যাগাজিনের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন পাপিয়া।

পাশাপাশি কবিতাও লেখেন তিনি। যার মধ্যে নিহিত থাকে ভারতের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশের সংস্কৃতি। পাপিয়া এক সুতোয় পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনকে বাঁধতে চান। আর এনিয়ে তাঁর প্রচেষ্টা দীর্ঘকালীন। শুধু বাংলা ভাষায় নয় , ইংরাজি ও চেক ভাষাতেও তাঁর কবিতার অনুবাদিত বই রয়েছে। পাপিয়ার বাউল জ্ঞান, স্বরচিত গান, ও বিরল বাউল ও ঝুমুর গান, সবেরই ভক্ত অগাধ, এপার – ওপার বাংলা ছাপিয়ে পশ্চিমের নানা দেশেও।অভিনয়ও করেন পাপিয়া। কসমিক সেক্স ও কাঁটাতারের অভিনয়ে বেশ জনপ্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন তিনি। সম্প্রতি চেক ফিল্ম “পৃবেহ তন্ত্রীর” মূল প্রটাগনিস্ট হিসেবে কাজ করে জিতে নিয়েছেন বহু পুরস্কার।

প্রাগ প্রাসাদে পাপিয়ার এই বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালোবাসার জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। ভার্সেটাইল শিল্পীকে থ্রেবিয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন প্রাক্তন ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান ক্লাউসোভা। পুরস্কার হাতে নিয়ে পাপিয়া জানান, ভবিষ্যতে তিনি তাঁর দেশের গ্রামের মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থেকেই গ্রামের অপ্রচলিত অথচ বহু মূল্যবান ঐতিহ্যকে পশ্চিমের মাটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।

Previous articleশাসক নাকি বিরোধী জোট? খেলা ঘোরাবে কে? একঝলকে রাইসিনা হিলসের সমীকরণ
Next article‘অগ্নিপথ’-এর প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ বিহার, অগ্নি সংযোগ-অবরোধের ব্যাহত জনজীবন