Thursday, December 25, 2025

বাংলার পুজো-সাহিত্য, দুনিয়ায় জুড়ি নেই

Date:

Share post:

প্রচেত গুপ্ত

পুজোর সময় গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।
গল্প ১
আজ থেকে সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর আগের কথা।
পুজোর হাতেগোনা ক’টা দিন বাকি। বিকেলে খেলা শেষে মাঠে বসে গুটিকতক বালক গল্প করছে। গল্পের বিষয়, পুজোয় কার ক’টা জামা হল। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ধরে ধরে হিসেব। ছোটদের যেমন হয়। একটি বালক মাত্র দুটি জামার হিসেব দিতে পেরেছে। এর বেশি তার হয়নি। বন্ধুরা বেজায় দুঃখ পেল। ইশ্‌ মাত্র দুটো জামা! সান্ত্বনাও দিতে লাগল।
এক বন্ধু বলল, ‘মন খারাপ করিস না।’
অন্য বন্ধু বলল, ‘এবার হয়তো ‌মা কিনে দিতে পারেননি, আগামী বছর নিশ্চয় দেবেন।’
আরেকজন বলল, ‘তুই জোর করলি না কেন? আরও জামার জন্য বায়না ধরতে পারতিস।’
বাকি বন্ধুটি বলল, ‘তোর জন্য আমাদের খারাপ লাগছে। মাত্র দুটো জামা নিয়ে কীভাবে চারদিনের পুজো কাটাবি কে জানে।’
এতক্ষণ চুপ করে শুনে এবার দুটো জামার বালকটি মুখ খুলল। এক গাল হেসে বলল, ‘আমার মন খারাপ হয়েছে!‌ তোদের কে বলল? আমার তো মন খুবই ভাল। আহ্লাদিত বলতে পারিস। জামার বদলে এছর আমার চারটে পুজোবার্ষিকী হবে। জামা তো আমার আছেই। বেশি নিয়ে কী হবে? পুজোর ছুটিতে এবার কত্ত নতুন গল্প-উপন্যাস পড়তে পারব বল তো। বাবা-মা আমরা এই বায়না শুনেছেন। তাঁরা কথাও দিয়েছেন, পুজোসংখ্যা বেরোলেই কেনা শুরু হবে।’
এবার বন্ধুদের অবাক হবার পালা। এ কেমন ছেলে রে বাবা!‌ নতুন জামার বদলে নতুন গল্প-উপন্যাস!‌
বালকটি বলল, ‘চিন্তা করিস না, আমার পড়া হলে তোরা যদি চাস, তোদেরও দেব। একবার মজা পেয়ে গেলে দেখবি তোদের অবস্থাও আমার মতো।’
সত্যি তাই হল। পরের পুজোয়, সেই ছেলের বন্ধুরা জামা কমিয়ে পুজোবার্ষিকী নিতে শুরু করল। পুজোর আগে সবাই মিলে বসে হিসেব হত। কার কাছে কোন পুজোবার্ষিকী আসবে। সমস্যা নেই, ছোটদের অনেক পত্রিকাই বেরোয়। ঠিক হত, কেমন ভাবে সবাই একে অপরটা ভাগ করে নিয়ে পড়বে। পুজোবার্ষিকী তখনও বেরোয়নি, তার আগেই ভাগাভাগির রুটিন তৈরি হয়ে যেত।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এই বালক এবং তার বন্ধুদের আমি তো চিনিই, আপনারাও কি চেনেন না? নিশ্চয়ই চেনেন। কে জানে, এদের মধ্যে আপনারা কেউ সেদিন ছিলেন কি না।
গল্প ২
এটা গল্প নয়, একেবারে সত্যি। বলা যেতে পারে, গল্পের মতো সত্যি।
ধরে নেওয়া যাক বছর কুড়ি আগের কথা। এক নবীন লেখকের মনে খুব ইচ্ছে, শারদীয় সংখ্যায় দিকপাল লেখকদের পাশে তারও একটা লেখা জায়গা পাক। জুন মাসের এক ভসভসে গরমের দুপুরে সে একটি গল্প খামে ভরে নিয়ে হাজির হল এক সাহিত্য-সম্পাদকের টেবিলে। রাশভারী সম্পাদক মুখ না তুলে বললেন, ‘কী চাই?’
নবীন লেখক আমতা আমতা করে বলল, ‘একটা গল্প এনেছিলাম।’
সম্পাদক এবার মুখ তুললেন। বললেন, ‘রোববারের পাতার জন্য?’
‘না, পুজোসংখ্যার জন্য।’
সম্পাদক মহোদয় আঁতকে উঠলেন। চোখ বড়। যেন বলতে চান, সাহস তো কম নয় হে!‌
‘কী বললে?’
নবীন মাথা চুলকে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘খুব ইচ্ছে ছাপা হোক, যদি একবার‌ দেখেন।’
সম্পাদক কড়া গলায় বললেন, ‘এই সবে লেখালিখি শুরু করেছ। হামাগুড়ি দিচ্ছ।
এর মধ্যেই পুজো সংখ্যায় লিখতে চাই?’
লেখক মাথা চুলকে বোকা হেসে বলল, ‘আসলে পুজোতে না লিখলে ঠিক লেখক হওয়া যায় না যে । বাংলা ভাষার সব বড় বড় লেখকরাই তো পুজোতে লিখেছেন, এখনও লিখছেন।’
‌সম্পাদক মাথা নামিয়ে বললেন, ‘তুমি আগে বড় লেখক হও তারপরে দেখা যাবে। এখন এসো দেখি বাপু, পুজো সংখ্যা নিয়ে কেমন চাপে রয়েছি দেখতে পাচ্ছো না?’
‘লেখাটা কি একবার দেখবেন?’
সম্পাদক ফের মুখ তুলে ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘খেপেছ? দেখছ কেমন হাবুডবু খাচ্ছি। যাও বলছি।’
ঘাড় ধাক্কা একেই বলে। কী আর করা? নবীন লেখক মাথা নামিয়ে বেরিয়ে আসে। একবার ভাবে গল্পটা ছিঁড়ে পথের ধারের আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবে। তারপর কী মনে হতে, খানিক হেঁটে পোস্টাপিসে পৌছে, খামে টিকিট লাগিয়ে এক কাগজের অফিসের ঠিকানায় দিল পাঠিয়ে।‌ জানাই তো আছে এ গল্প ছাপা হবে না। ওরাই ফেলে দিন না হয়।
সে বছরই সেই কাগজের পুজোবার্ষিকীতে অনেক বড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে এই নবীন লেখকের গল্পটিও প্রকাশিত হয়েছিল। নবীন লেখকের তো আত্মহারা অবস্থা। পত্রিকা হাতে নিয়ে লাফায় ঝাঁপায়, পারলে ডিগবাজি খায়। তার কাছে পুজোয় আনন্দ বেড়ে যায় কয়েকশো গুণ। সেই বালক বয়স থেকে পুজোসংখ্যায় লেখবার স্বপ্ন সে দেখে এসেছে। কল্পনাও করতে পারেনি, সেই স্বপ্ন তার এভাবে সত্যি হবে।
নবীন লেখকের পরিচয় ফাঁস করছি না, শুধু এটুকুই বলি, সে আমার অতি পরিচিত। আজও একটু আধটু লেখালিখি করে। তার সিরিয়াস লেখার আত্মপ্রকাশ পুজোসংখ্যা দিয়েই। তার প্রথম বড়দের গল্প, প্রথম বড় উপন্যাস দুটোই ছিল পুজোর সাহিত্য।
গল্প ৩
এ বছরের কথা।
এক রাজনৈতিক নেতা। প্রবীণ এই মানুষটি সারা বছর খুব ব্যস্ত। মিটিং, মিছিল লেগেই রয়েছে। জেলায় জেলায় ছুটতেও হয়। দলের কর্মসূচি বাদ দেওয়ার উপায় নেই। কর্মী-সমর্থকরাও অপেক্ষা করে থাকে। ক’দিন আগে তাঁর কাছে অনুরোধ এল, নতুন এক পুজোবার্ষিকীর মোড়ক উন্মোচন করতে হবে। যে ছেলেটি তাঁকে নিত্যদিনের কাজে সাহায্য করে, সে ডায়েরি উলটে বলল, ‘স্যার, অসম্ভব। সেদিন সতেরোটা প্রোগ্রাম। এক মিনিটও সময় নেই।’
নেতা বললেন, ‘আমারও অসম্ভব। নতুন পুজোবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে না গিয়ে পারব না। আপনি একটা পথ বের করুন।’
‘স্যার, আগে তো রাজনৈতিক কর্মসূচি সামলাতে হবে, তারপর না হয় শিল্প–সাহিত্য.‌.‌.‌।’
নেতা বললেন, ‘রাজনীতি তো মানুষের জন্যই, সাহিত্য ছাড়া মানুষকে বুঝব কী করে? আর পুজোবার্ষিকীর লোভ আমার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।’
‘তাহলে কী হবে স্যার? সেদিন সন্ধ্যেতে তো আপনার কর্মীদের সঙ্গে বসবার কথা রয়েছে।’
নেতা বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, এই মিটিং আপনি বেশি রাতে সরিয়ে দিন। কর্মীদের আমি বুঝিয়ে বলব।’
‘স্যার, ওখান থেকে বাড়ি ফিরতে আপনার রাত হয়ে যাবে যে।’
নেতা‌হেসে বললেন, ‘পুজোবার্ষিকীর জন্য না হয় একদিন রাত হবে। আপনি উদোক্তাদের জানিয়ে দিন, ঠিক সময় পৌঁছে যাব।’
এই সাহিত্য অনুরাগী রাজনৈতিক নেতা ভদ্রলোকটিকে আমি যেমন চিনি, আপনারাও চেনেন।
এই তিন গল্পে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলায় পুজোসাহিত্যের রমরমার খানিকটা আঁচ নিশ্চয় পাওয়া গেল। সে তার ঐতিহ্য শুধু বহন করেছে না, আরও মাথা উঁচু করেছে। আসলে বাংলার পুজোসাহিত্য একমেবাদ্বিতীয়ম্। দুনিয়ায় জুড়ি নেই। কোনও দেশে, কোনও উৎসবকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের এই বিপুল আয়োজন হয় বলে কারও জানা নেই। হয় না। আর সাহিত্য মানে মেধা। বালক থেকে প্রবীণ, দরিদ্র থেকে ধনী, উচ্চশিক্ষিত থেকে স্বল্প শিক্ষিত, দলমত নির্বিশেষে রাজনীতির মানুষ, প্রশাসনের চরম ব্যস্তজন, সব ধরনের পেশার বাঙালি এই মেধা চর্চায় যুক্ত থাকেন। পুজো সাহিত্য পড়েন। উৎসবের দিনে একদিকে যেমন পথে লক্ষ মানুষে আনন্দে মেতে থাকা, মণ্ডপে মণ্ডপে শিল্পীদের মুগ্ধ করা কারুকাজ, আলোর রোশনাই, ঢাকের বাদ্যি, তেমনই আরেক দিকে, ঘরে নিভৃতে বসে, কোলের ওপর পুজোবার্ষিকীটি খুলে গভীর মনোযোগে গল্প উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ পাঠ। দুই মিলেই আমাদের উৎসব।
পুজো সাহিত্য নিয়ে যদি দেশে কোনও হিসেবনিকেশ হয়, আমরা হব একমাত্র। সেরার সেরা শিরোপা দিতে হবে আমাদেরই। একজন সামন্য লিখিয়ে হয়ে ভাবতে অবাক লাগে, যাঁরা সর্বক্ষণ বাংলার খুঁত ধরছেন, নিন্দে করছেন, বাংলাকে নস্যাৎ করতে সদা উদগ্রীব, তাঁরা কি একবারও এদিকটা ভেবে দেখেন না? পুজোসাহিত্যের আকর্ষণ এবং উৎকর্ষতা যেমন বহু বছরের, তেমন তার আয়োজনও বছরের পর বছর বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝেই প্রচার ছড়ায়, বই-পত্রিকা পড়বার অভ্যেস নাকি যাচ্ছে কমে। হাতে বই নিয়ে পাতা উলটে আর কেউ পড়ে না। অথচ এবার পুজোর গত বছরের তুলনায় অন্তত দু’গুণ বেশি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ পেয়েছে। বেশিও হতে পারে। গত বছর যত লেখক পুজো সাহিত্যে অবদান রেখেছিলেন, এ বছর তার সংখ্যা বেড়েছে অনেক। যদি পড়বার অভ্যেস কমে গিয়েই থাকে, তাহলে এমনটা হল কী করে? পুজোবার্ষিকী শুধু প্রকাশিত হচ্ছে না, প্রচার সংখ্যাও বাড়চ্ছে। ‘বই পত্রিকা পড়ে না’ প্রচারটিকে পুজো সাহিত্য একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছে। একটা উদাহরণ দিই।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত জানতাম, পুজোর উদোক্তারা মণ্ডপ, মূর্তি, আলো, সাজসজ্জা, প্রসাদ বিতরণ, বিসর্জন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বড়জোর পুজোর ক’দিন কেটে গেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। কিছুদিন হল দেখতে পাচ্ছি, এসবই শেষ কথা নয়, পুজো কমিটি নিজেদের মতো করে শারদ সংখ্যাও প্রকাশ করছে। সেখানে গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধ সবই রয়েছে। সুসম্পাদিত সেই পত্রিকা বাকিদের থেকে কোনও দিকে কম নয়। নামীদামি থেকে নতুন লেখকরা সবাই লেখেন সেখানে। দক্ষিণের এক পুজো কমিটি এই দারুণ কাজটি শুরু করেছিল, এখন এই আয়োজন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার কত কমিটি যে শারদ সংখ্যা প্রকাশ করেছে! লক্ষণেই বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা বাড়বে। গুণমান নিয়ে হবে সুস্থ প্রতিযোগিতা। যাঁরা পুজোর সময় সেরা মূর্তি, সেরা আলোকসজ্জায় পুরস্কার দিচ্ছেন, তাঁরা অদূর ভবিষ্যতে কমিটি সম্পাদিত সেরা পুজাবার্ষিকীকে পুরস্কার দেবেন। এই ধরনের পুজাবার্ষিকী আসলে সাধারণ মানুষকে সাহিত্য পাঠে আগ্রহী করছে। যিনি কোনওদিনও পুজো সাহিত্যের স্বাদ পাননি, তিনিও পড়বার সুযোগ পাবেন। তার থেকেও বড় কথা, মানুষ জানছে, উৎসব মানে শুধু বাইরের আনন্দ নয়, মনের ভিতরে আনন্দটিকেও অনুভবের প্রয়োজন রয়েছে। মনের সেই আনন্দ পাওয়া যায় সাহিত্য পাঠে। এ আমাদের সাহিত্যের গর্ব, বাংলার গর্ব, উৎসবের গর্ব। যাঁরা পুজো কমিটিগুলির পিছনে থেকে এই কাজে উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না করে উপায় নেই। আবারও বলছি, বাংলা ছাড়া এ আর কোথাও হয় না।
আর একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলে পুজো সাহিত্যের প্রতি অবিচার হবে।
উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পুজোসংখ্যা প্রকাশ করে। মূলত সাহিত্যের আয়োজন। বাম-ডান কেউ বাদ নেই। সরকার পক্ষের দলও যেমন সেখানে উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধে মন দেয়, সরকার-বিরোধী পক্ষও একই ভাবে শারদ পত্রিকা সাজায়। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন শাখা সংগঠন থেকেও সাধ্যমতো পুজোসংখ্যা বেরোয়। যাঁরা তথাকথিত বড়, বহুল প্রচারিত পুজোসংখ্যায় লেখালিখি করেন, তাঁরা রাজনৈতিক দলের এই সব শারদসংখ্যায় লিখতে দ্বিধা করেন না। সে তিনি যে মতেরই হোন না কেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা কেমন হবে সে ব্যাপারেও কোনও ‘বিশ্বাস’ চাপিয়ে দেওয়া হয় না। বাকিটা লেখকদের ওপর নির্ভর করে। এটাই বাংলার পুজো–সাহিত্য আয়োজনের শিষ্টাচার। হাজার জরুরি কাজ থাকলেও দলের পুজোসংখ্যা প্রকাশে নেতা-নেত্রীরা পৌঁছে যান। এতে কর্মীদের কাছে সুস্থ মনের বার্তা পৌঁছয়। এমনটি আর কোথায় হয়? কোনও নজির নেই।‌ পুজো মণ্ডপকে ঘিরে যেমন মেলা বসে, তেমনই সাজানো হয় বইয়ের সম্ভার। মত, বিশ্বাস নির্বিশেষেই রাজনৈতিক কর্মীরা টেবিলে বই সাজিয়ে বসেন। নিজেদের পছন্দ, বিশ্বাস, মত, দর্শন, সাহিত্যের বই পত্রিকা থাকে। খুব বিক্ষিপ্ত একটা-আধটা ঘটনা ছাড়া, আমি শুনিনি, এই সাহিত্য পশরায় হামলা হয়েছে। কেউ কাউকে বাধা দেয় না। এই বইবেলায় (পত্র-পত্রিকাও)‌ সরকার বা বিরোধিতা বলে আলাদা কিছু থাকে না। পুজো দেখতে আসা মানুষ স্টলে ভিড় করে। এ-ও যে পুজোর সাহিত্য। পুজোর উৎসবকে কেন্দ্র সাহিত্যকে ছড়িয়ে দেওয়া। বিরল ঘটনা। এই উৎসাহের কয়েকটি কারণের একটি হল, বাংলার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা নিজেরাও সাহিত্যচর্চা করতে ভালবাসেন। এ আজকের কথা নয়। বহুদিনের বৈশিষ্ট্য। হাজার কাজের ফাঁকেও কেউ গল্প উপন্যাস লেখেন, কেউ নাটক, কেউ আবার কবিতা। নেতা-নেত্রী যদি সাহিত্য ভালবাসেন, কর্মীরা তা নিয়ে আগ্রহী তো হবেনই।
এই লেখার গোড়ার দিকে পুজোবার্ষিকীতে এক নবীন লেখকের সুযোগ পাওয়া নিয়ে গল্প বলেছি। তখন নবীনের সুযোগ পাওয়া গল্পের মতোই ছিল, আজ পরিস্থিতি বদলেছে।‌ এখন বহু নবীন লেখক পুজোসংখ্যায় সুযোগ পান। বড়, মেজ, মাঝারি, ছোট সব ধরনের পুজোসংখ্যাতেই নবীনদের জয়জয়কার দেখি। কী ভাল যে তাঁরা লিখছেন!‌ প্রবীণদের পাশে তাঁরা উজ্জ্বল। অন্যদিকে প্রবীণ সাহিত্যিকরা প্রতি বছরই নিজেদের উজাড় করে দেন। তাঁদের কারও কলমে ইতিহাস আলো ফেলে, কেউ পুরাণে ঝলমলে, কেউ প্রেমে, কেউ প্রতিবাদে পাঠকদের মাতোয়ারা করছেন। কেউ রহস্যে ভরা, কেউ জীবনবোধে ঋজু, কেউ বিরহের কথা বলছেন, কারও গল্প, উপন্যাস, কবিতায় জীবনের জয়গান শোন। গভীর দর্শন বোধে, চেতনায় কোনও কোনও লেখা ঝলসে উঠে চিরকালীন হয়ে উঠছে। এবার পুজো সাহিত্যের ঐতিহ্য, আর অনেকে ভাল লাগবার কথা।
এক সময়ে কোনও কোনও সমালোচক বলবার চেষ্টা করেছিলেন, পুজোসাহিত্য খাঁটি সাহিত্য নয়। চাপে পড়ে লিখতে হয়, ফলে লেখার গুণমান বজায় থাকে না। লেখকদের অনেক লিখতে হয়, সেটাও সমস্যার। এই সমালোচনা একেবারেই ঠিক নয়। যাঁরা পুজোসাহিত্যের স্বর্ণখনির সঙ্গে অনেকদিন পরিচিত তাঁরা জানেনই, তাও একটু পিছন ফিরে তাকানো যাক। সাহিত্যের স্বর্ণখনি চোখ ধাঁধায় না, মন ভরায়।
বাংলায় বহু ‘সেরা লেখা’র আত্মপ্রকাশ হয়েছে এই পুজোর সময়তেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ল্যাবরেটরি’ পুজোসংখ্যাতেই লেখা।‌ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী’, ‘মন্বন্তর’ শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস। এ-ছাড়াও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়রা অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন পুজোসাহিত্যে পাতায়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল কর, সন্তোষকুমার ঘোষ, মতি নন্দী, বুদ্ধদেব গুহ, বিমল মিত্র, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়রা পুজোয় যে কত দুর্দান্ত উপন্যাস, ছোট গল্প লিখেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘সারারাত’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অসিধারা’র মতো লেখা তো পুজোতেই হয়েছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ পুজোরই। তালিকায় পরশুরামও রয়েছেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের পুজোতে লেখা ‘অবতরণিকা’ গল্পটি নিয়ে পরে সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’ ছবি তৈরি করেন। এই প্রসঙ্গে বলি, সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’, ‘প্রফেসর শঙ্কু’ কিন্তু পুজোর প্রাপ্তি। বুদ্ধদেব গুহর ‘ঋজুদা’ পুজোর সময় কমবার জঙ্গলে গিয়েছে? ঔপন্যাসিক হিসেবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আর্বিভাব পুজোতেই। উপন্যাসের নামটি ছিল ‘ঘুণপোকা।’ সমরেশ বসু ‘বিবর’ লিখেছেন পুজোতেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাসে ‘আত্মপ্রকাশ’ তাই। শংকরের পুজো উপন্যাস নিয়েই সত্যজিৎ রায়ের ছবি হয়েছে। পুজো সাহিত্যে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়ের অবদান চির উজ্জল। উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন আশাপূর্ণা দেবী, সুচিত্রা ভট্টাচার্য। সমরেশ মজুমদার তো জোরকদমে লিখছেন।
যাঁদের কথা লিখলাম, তাঁদের বাইরে অসংখ্য গুণী মানুষ পুজো সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছেন। আমার এই তালিকা কোনও পূর্ণাঙ্গ মোটেই নয়, আভাস মাত্র। শুধু গদ্য সাহিত্যের কথা বলেছি। কবিতা, প্রবন্ধ তো বাদই র‌য়ে গেল। এই লেখাতেই আমি তেমন করে পুজোয় লেখা কবিতার কথায় আসিনি। সজনীকান্ত দাস, প্রমথনাথ বিশী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী থেকে পরে সুনীল গাঙ্গুলি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সহ অনেকে পুজোর কাব্যকে গৌরবান্বিত করেছেন। এখন লিখছেন জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকারসহ বহু প্রবীন ও নবীন। অতীতের শারদ সাহিত্য নিয়ে গবেষকদের কাজ রয়েছে। আগ্রহ থাকলে পাঠক পড়ে নিতে পারেন। দু-একজন সিনিয়র ছাড়া, এই সময়ের বহু শক্তিশালী লেখকদের নাম এখানে বললাম না। অনুরোধ, কার নাম বাদ গেল পাঠক সেই সন্ধান এখানে করবেন না। বরং বাংলার পুজোসাহিত্যের কিছু ‘মণি- মুক্তো’র ঝলক দেখে খুশি হবেন। সেই ঝলক আজকের নবীন লেখকরা বহন করে নিয়ে চলেছেন।

পুজো সাহিত্য ছাড়া বাংলার পুজোকে ভাবাই যেত না, ভাবা যাবেও না।


spot_img

Related articles

পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর জন্মদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য মুখ্যমন্ত্রীর

ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ মদনমোহন মালব্যর (Madan Mohun Malbiya) জন্মদিবসে নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা...

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মবার্ষিকীতে মুখ্যমন্ত্রীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

২৫শে ডিসেম্বর ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Bajpeyee) জন্মবার্ষিকী আর সেই উপলক্ষে নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে...

১৭ বছর পর বাংলাদেশে ফিরলেন খালেদাপুত্র, তারেককে ঘিরে উচ্ছ্বাস-বিএনপি সমর্থকদের

বাংলাদেশের ফিরলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান (Tarique Rahman returns in Bangladesh)। বৃহস্পতি সকালেই তিনি সিলেট...

এক দশক পর শীতলতম বড়দিন পেল বাংলা!

যিশু জন্মদিনের সকালে (Christmas morning) কলকাতার তাপমাত্রা (Kolkata temperature) নামলো ১৩.৭ ডিগ্রিতে। শীতের আমেজে জমজমাট বড়দিনের আবহাওয়া। দক্ষিণবঙ্গে...