Tuesday, August 26, 2025

মায়ের গানের স্বরলিপি, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

ছাড়ি চিরকালের বসতবাড়ি
দিলাম পাড়ি অজানায়
তোমাদের হাসিখেলায়
আমাকে আর পাবে না …

এটা অনিকেতের মায়ের গান । যদিও মায়ের লেখা নয় গানটি । কথাগুলো এসেছে অনিকেতের মাথায় । আর , লিখলে তো এমনই লিখতেন মা । বাড়ি ছেড়ে কখনও কোথাও যেতে চাইতেন না যে মা , আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি গিয়ে এক রাত থাকলেই ঘরে ফেরার জন্য ব্যাকুল হতেন যে মা , সেই মা নিজের প্রাণের বসতবাড়িটি ছেড়ে চিরদিনের জন্য যখন চলে যাচ্ছেন তখন অন্য আর কী-ই বা গাইতেন মা ?

মায়ের প্রাণহীন দেহের পাশে বসে সারারাত এইসব ভেবেছে অনিকেত । পরদিন সকালে শ্মশানবন্ধুদের সঙ্গে মায়ের দেহ কাঁধে তুলে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরনোর সময় সবাই যখন হরিধ্বনি দিচ্ছে অনিকেত তখন মনে মনে গাইছে মায়ের গান । হৃদয় বিদীর্ণ করা এই দুঃসহ শোকের আবহে গান আসে কী ক’রে ?
একদা অনিকেত লিখেছিলো :
আমার শুধু গানের জন্য
গান না
গান আমার শ্মশানবন্ধু
আগুনছোঁয়া কান্না ।

শ্মশানে গনগনে চুল্লির মাঝে মা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরে অন্তত একটা ঘন্টা শুধু বসে থাকা । বাবার কথা মনে পড়ছে অনিকেতের । আট বছর আগের এক দুপুরে বাবাকে এনেছিল এখানেই । এই দামোদরের তীরে । শ্মশানের নাম ‘ বৈতরণী ‘ ।
চুল্লি তখনও চালু হয় নি ।
তখন ‘ চিতাতেই সব শেষ ‘ ।

শ্মশানে বাবাকে আনার কথায় মনে পড়লো সরোজ দত্তের কবিতা :
চাপায়ে চায়ের জল
নিভে আসা চিতার আগুনে
ডোমেরা বসিয়া আছে
বারাঙ্গনা করে গঙ্গাস্নান ;
ভাড়াটে ব্রাক্ষ্মণ ফেরে
রোঁয়াওঠা কুকুরের সাথে ,
তোমারে এনেছি হেথা
বলিহারি মৃতের সম্মান ।

চিতা সময় নিতো তিন ঘণ্টা তো বটেই । কখনও এর চেয়ে বেশিও । বাবার পার্থিব অবশেষ চিতার আগুনে তুলে দিয়ে দুঃসহ সেই তিন ঘণ্টা কীভাবে কাটিয়ে ছিল অনিকেত ? ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শ্মশানবন্ধুদের থেকে কিছুটা দূরে নির্জনে একা বসে একের পর এক গান লিখেছিলো । সবই মনে মনে । অবশ্য মনে পড়ছিলো অজস্র কবিতাও । সেই সময়ে অনিকেত এও ভেবেছে যে , প্রিয়জনের পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে গান গাওয়া ও কবিতা আওড়ানো কি অন্যায় ? অপরাধ ? পাপ ? কিন্তু কী করবে সে ?
গান ও কবিতাকে আটকাবে কীভাবে ? কী ক’রে ফিরিয়ে দেবে দরজা থেকে ? মৃত্যুর ভয়াবহ অভিঘাতকে একপাশে সরিয়ে রেখে প্লাবনের মতো ধেয়ে আসে কথা ও সুর পরম বন্ধুর বার্তা নিয়ে । দাহপর্বের স্বরলিপি লেখা হতে থাকে ।

প্রাণহীন মা-কে নিয়ে বেরোনোর সময় অনিকেতের চোখ একবার গেলো রান্নাঘরে , পরমুহূর্তেই মায়ের ঠাকুরঘরে । রয়ে গেল মায়ের ছোঁয়া মউরি , এলাচ, লবঙ্গ , তেজপাতা , দারুচিনি ও গোলমরিচ গুঁড়ো । রয়ে গেল চিনি, গুড়, কদমা,বাতাসা আর নকুলদানা । থেকে গেলো চাল , ডাল , তেল , নুন ও চা-পাতা । থেকে গেলো ধূপদানি , চন্দনপিঁড়ি আর ফুলপঞ্জিকা । পড়ে রইলো ফুলে ভরা দোলনচাঁপা গাছ ও একটুকরো ছোট্ট বাগান । পড়ে রইলো আঁচলের খুঁটে বাঁধা চাবির গোছা । পড়ে রইলো চিরকালের বসতবাড়ি । শ্মশানমাঠে ব’সে সুরসমেত একের পর এক গান আসছে অনিকেতের খাঁ খাঁ করা মনে । ফিরিয়ে দেবে কোন মুখে ? ফেরানো যায় ?

অনিকেত সান্যাল । মাত্র ২৮ , মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। বাবা নেই । আজ মা চলে গেলেন । এখন সম্পূর্ণ একা । কাজে বেরিয়ে প্রখর রোদেও কবিতা আসে তার । স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পথে আসে গান । প্রতিদিন বাড়ির দরজায় এসে হাঁক পাড়ে ,
‘ মা , ও-মা , মা-গো ‘ । এবার কে সাড়া দেবে তার ডাকে ?
যাকে নিয়ে উদ্বেগ ও দুঃশ্চিন্তার শেষ ছিল না অনিকেতের , ছিল একবুক আতঙ্ক , হ্যাঁ আতঙ্ক-ই , এই বুঝি পড়ে গেলো মা , এই বুঝি ঠোকা খেলো কোথাও , এই বুঝি প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে অসতর্কতায় আগুন ধরে গেলো মায়ের শাড়িতে , এই বুঝি মায়ের দুর্বল হাত ফসকে পড়ে গেলো গরম ভাতের হাঁড়ি , সেই মা আজ চলে গেলো চিরদিনের মতো । মায়ের স্মৃতিশক্তি ছিল তুখোড় । উচ্চারণ স্পষ্ট । আর সুরে ভরা কণ্ঠ ।
আজ সমস্ত উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার অবসান । এবার আতঙ্কহীন নিরুদ্বিগ্ন জীবন । একই সঙ্গে মাথার ওপর বিশাল বটগাছের স্নেহশীতল ছায়াহীন রুক্ষ কর্কশ জীবন।

এবার কাজের শেষে সন্ধ্যায় কার কাছে ফিরবে অনিকেত ?
তার মনে পড়ছে শক্তিকবির লেখা :
কী হবে জীবনে লিখে
এই কাব্য এই হাতছানি ;
এই মনোরম মগ্ন দীঘি
যার দু’পাশে চৌচির ধমনী ।
ভাবতে ভাবতে কখন যেন অতল এক অন্ধকার নেমে আসে অনিকেতের ক্লান্ত দুচোখে । ঘোর লাগে ঘুমের ।
আর তখনই স্বপ্নের মতো এসে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ । তাঁর গলায় অবিনশ্বর গান । তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে অনিকেতও গাইতে থাকে ,
… তবুও শান্তি , তবু আনন্দ ,
তবু অনন্ত জাগে …

আরও পড়ুন- সুন্দরবনের দুই গ্রামে সাড়ে তিনশো কম্বল বিতরণ করল ‘মৈত্রেয়ী’

 

spot_img

Related articles

দুর্গাপুজোর আগে রাজ্যে ডেঙ্গি-উদ্বেগ! টানা বৃষ্টিতে বাড়ছে আশঙ্কা 

দুর্গোৎসবের মুখে একদিকে নিম্নচাপের জেরে টানা বৃষ্টি, অন্যদিকে ডেঙ্গি সংক্রমণ রাজ্যবাসীর কপালে ভাঁজ বাড়াচ্ছে। জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে...

মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী! কিনলেন শাড়ি 

বর্ধমানে প্রশাসনিক সভায় এসে হঠাৎ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে হাজির মুখ্যমন্ত্রী। শুধু মহিলাদের হাতের কাজই ঘুরে দেখলেন না, কেনাকাটাও...

ধনধান্যে ভরে, মা এসেছে ঘরে: মুখ্যমন্ত্রীর লেখা-সুরে গান এবার দুর্গাপুজোয়

বাংলা ও বাঙালির বড় উৎসব আর পুজোর গান— এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এখন দুর্গাপুজোয় মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা...

প্রধানমন্ত্রী বাংলা ছাড়তেই জীবনকৃষ্ণের গ্রেফতারি তৃণমূলকে অপদস্থ করার চক্রান্ত, তোপ কুণালের      

ইডির (ED) হাতে জীবনকৃষ্ণ সাহার (Jiban Krishna Saha) গ্রেফতারি আসলে তৃণমূল কংগ্রেসকে (TMC) অপদস্থ করার চক্রান্ত। প্রধানমন্ত্রী বাংলায়...