আমি বাংলায় কথা কই: একুশে ফেব্রুয়ারিই নয় প্রতিদিনই হোক মাতৃভাষা দিবস

বুবাই চক্রবর্তী

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির জীবনে অবিস্মরণীয়। বাঙালির চেতনার প্রতীক। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণ। ঝরে যায় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর-সহ নাম অজানা অসংখ্য ভাষাশহিদের তাজা প্রাণ। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়।

এই আত্মত্যাগের স্মরণ করতে গিয়ে প্রতি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিত হয় ভাষা শহিদ দিবস। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০-এর ২১ ফেব্রুয়ারি এ বিশেষ দিবসটিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ প্রথমবারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। বর্তমানেও এই দিবসটি সমাদরে পালিত হয়। আর কবির ভাষায়, “একুশ আমার ব্যথায় কাতর চোখের বারিধারা। একুশ আমার শূন্য হিয়ায় আকাশ ভরা তারা। একুশ আমার রক্ত রঙ্গিন কৃষ্ণ চূড়ার ডাল। একুশ আমার ঝাঁজরা হওয়া ছোট্ট ঘরের চাল।“

ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বাঙালিকে। তাজা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল একটি ভাষা- যার নাম বাংলা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই একমাত্র ঘটনা যে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য এত মানুষ প্রাণ দিয়েছে।

তবে, বর্তমানে বাংলার ভাষার সমাদর কী করা হচ্ছে! ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা মাতৃভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হই। বাকি à§§à§§ মাস ঘুম পাড়িয়ে রাখি মাতৃভাষার চেতনাকে। ভুলে যাই আমারা আমাদের ভাষার অতীতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মৃতিকে। “চিঠিটা তার পকেটে ছিল, ছেড়া আর রক্তে ভেজা।” বিখ্যাত এই কবিতার লাইন দুটি প্রতিবেশী দেশের কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সন্তান রাজপথে নেমেছে আন্দোলনে। মা সন্তানকে চিঠি দিয়েছে বাড়ি ফেরার জন্য। কিন্তু সেই চিঠি বুক পকেটে নিয়ে ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে ভাষা সংগ্রামীরা। শহিদ হওয়ার পর সন্তানের পকেটে পাওয়া যায় মায়ের চিঠি। লাল রক্তে ভিজে ছিঁড়ে গিয়েছে। এরকম নানা দুঃসহ ঘটনার মধ্যে দিয়ে মিলেছে বাংলাকে মাতৃভাষার করার অধিকার। কোনকিছু উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া খুবই সহজ। কিন্তু তার অবিকৃত রূপ ঐতিহ্য ধরে রাখা কষ্টের। এখন নানা সময় বিকৃত ভাবে বাংলা শব্দ উচ্চারণ করা হয়। বাংলা ভাষার মধ্যে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয় যেটির প্রকৃত অর্থই পাল্টে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় সেটা হল, কম সময়ে বেশি কাজ করা। অল্প সময়ে বেশি বুঝিয়ে দেওয়া। তাই সবাই সংক্ষিপ্ত বা শর্টকাট রাস্তা খুঁজতে থাকে তাঁরাষ সেটা যদি কথায় ও লেখায় হয় তাহলে তো আর কোনও কথাই নেই। আর এই শর্টকাট করতে গিয়েই তৈরি হয় ভাষার বিকৃত রূপ। এভাবে নানা বাংলা শব্দ বিকৃতি ঘটছে অহরহ। যা বাংলা ভাষার জন্য ‘হুমকি’ স্বরূপ।

সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হল, নীচের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এসব পরীক্ষার খাতাতেও লিখছে। তাদের দোষ কী! তারা যা শিখছে-বলছে, তাই তো পরীক্ষার খাতায় লিখবে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব এসব পরিহার করা উচিত। কথা বলুন সম্পূর্ণ বাংলা ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষায়। আঞ্চলিকতার ব্যবহার থাকবে কিন্তু বাংলা ভাষার বিকৃতি কেন? বিষয়টা যেন অশনি সংকেত। এক্ষেত্রে সবারই সচেতন হওয়া দরকার। বন্ধ করতে হবে ভাষার বল্গাহীনব্যবহার। উচিত ছোটোদেরকে এই ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন করা।

আরও পড়ুন- মঙ্গলে শিলিগুড়িতে সরকারি অনুষ্ঠান,বুধে মেঘালয়ে যাবেন মমতা

ভাষা পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তন বা আধুনিকতার নামে ভাষার বিকৃতি কখনোই কাম্য নয়। পরিবর্তন যেমনই হোক, ভাষার মাধুর্য সৌন্দর্য ও বোধগম্যতা রক্ষা করা জরুরি।বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে। না হলে আগামী কয়েক দশক পরে ‘প্রমিত বাংলা ভাষা’ জাদুঘরে ঠাঁই পাবে।

মনে রাখতে হবে ইতিহাস। ফিরে যেতে হবে ভাষার কাছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে যে চেতনার উন্মেষ ঘটে, তার চরম বিস্ফোরণ ঘটে ঊনসত্তর থেকে একাত্তরে। একুশে ফেব্রুয়ারি একটি সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ চেতনা। বাঙালি জাতি কোনও দিন এ দিনটির স্মৃতি ভুলতে পারবে না। তাই তো প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা বাঙালিরা পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে সমস্বরে গেয়ে উঠি—”আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি।” নতুন প্রজন্মকেও মনে রাখতে হবে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার অহংকার, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।